You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.09.06 | এবার পাশপাের্ট নিয়ে টানাটানি | যুগান্তর - সংগ্রামের নোটবুক

এবার পাশপাের্ট নিয়ে টানাটানি

ঢাকায় ফুটবল খেলে নি পাক-সৈন্যরা। খেলেছে রক্তহহালী। গর্বের সঙ্গে বলেছেন ইয়াহিয়া খান। প্রায় সাড়ে পাঁচ মাস ধরে বাংলাদেশে ঝরছে অবিশ্রান্ত রক্ত। রক্তের নেশায় এখন ঝিমুচ্ছেন ইসলামাবাদের ডিকটেটর। মাঝে মাঝে চিমটি কাটছেন বিদেশে পাক-দূতাবাসগুলাের বাঙালী কর্মীরা। ভাঙ্গছে ইয়াহিয়ার তন্দ্রা। মুক্তিবাহিনীকে ঠাণ্ডা করার জন্য আছে কামান, বন্দুক এবং জঙ্গীবিমান। দখলদার সৈন্যরা মারছে গেরিলাদের। নিজেরাও মরছে দলে দলে। লড়াই করতে গেলে এড়ান যায় না এসব ঘটনা। এ বাস্তব সত্য ভাল করেই জানেন পাকিস্তানের সামরিক শাসকগােষ্ঠী। কিন্তু পাক-দূতাবাসগুলাের বাঙালীদের নিয়েই যত ভাবনা। পররাষ্ট্র বন্দুক-কামান অচল। বাঙালীরা ইসলামাবাদের নকরি ছাড়লে ঘাড় ধরে টেনে আনা যায় না তাদের। অথচ সায়েস্তার একটা উপায় বার না করলেই নয়। নয়াদিল্লীর পাক-হাইকমিশনের একজন বাঙালী কর্মীকে সেদিন দেওয়া হল প্রচণ্ড ধােলাই। সন্ত্রাসের বদলে দেখা দিল বিক্ষোভ। বাংলাদেশে খাটে নি টিক্কা খানের দাওয়াই।
গণহত্যা এনেছে সেখানে গণজাগরণ। তারই পরিণতি স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের প্রতিষ্ঠা এবং মুক্তিবাহিনীর পাল্টা আঘাত। ভেবেছিলেন ইয়াহিয়া খান বিদেশে পাক-দূতাবাসগুলাের মাথায় এক একজন। জেনারেল বসিয়ে দিলেই চুকে যাবে ল্যাঠা। ভয়ে সাত হাত মাটির নীচে সেধিয়ে যাবেন বাঙালী কর্মীরা। আর পাক-প্রচারও চলবে মিলিটারী তালে। ইয়াহিয়া নিজে মিলিটারী। তাই খুঁজেন সব সমস্যায় মিলিটারী সমাধান। টিক্কার ব্যর্থতা করেছে তাকে সাবধানী। বুঝেছেন মিলিটারীর বাবা জনরােষ। একে ঠাণ্ডা রাখার দাওয়াই আলাদা। লােকমুখে হয়ত তিনি শুনেছেন-গণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা ছাড়া শান্ত হবে না বাংলাদেশ। এই বিচিত্র চিকিৎসা পদ্ধতি স্বৈরচারীদের অজানা। তবু একটা ব্যবস্থা না করলেই নয়। মরতে বসেছে পাকিস্তান। তার গলায় মরণ কামড় দিয়েছে বাংলাদেশ। ওটা হাল্কা না হলে বন্ধ হবে শ্বাস-প্রশ্বাস। টিক্কার বদলে পূর্ব বাংলার গবর্ণরের আসনে বসালেন তিনি ডাঃ মালেককে। অসামরিক এই দ্রলােক দাঁতের ডাক্তার। মুক্তিবাহিনীর মারে ভোতা হয়ে গেছে পাক-নেকড়েদের দাঁত। দাঁতের ডাক্তার অন্য কিছু না পারুন, অন্তত মেরামত করতে পারবেন তাে এই ভােতা দাঁতগুলাে। বাঙালীরাও জানবে মিলিটারী শাসন আর নেই। এসে পড়েছে। গণতন্ত্রীরাজ। স্বয়ং গবর্ণর অসামরিক শাসক। চাল কিটা ধরে ফেলেছেন সবাই। দালাল কথাটি বাংলাদেশে খুবই চালু। ডাঃ মালেকের অঙ্গে অনেক আগেই পড়েছে দালালীর ছাপ। বাংলাদেশের দখলীকৃত এলাকায় যে দাওয়াই দিয়েছেন ইয়াহিয়া খান তা ভেজাল। ভেজাল ওষুধে কোনদিনই সারে না অসুখ। তবু চেষ্টার ত্রুটি নেই ইসলামাবাদের। এলােপ্যাথী, হােমিওপ্যাথী, হেকেমী এবং সার্জারী একসঙ্গে চালাচ্ছেন তারা বাংলাদেশে। তাতে পার না পেয়ে এখন পাক মিলিটারী শাসকেরা খুলে বসেছেন প্রজাপতি দপ্তর যেসব বাঙালী মেয়েকে তারা করেছেন অপহরণ, বিধবা এবং অনাথিনী তাদের সঙ্গেই বিয়ে দিচ্ছেন পাক-সৈন্যদের। একাধিক বিধিও জুটছে অনেকের কপালে। বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ সন্তানদের দেহে এসব বর্বররা আনবে পাঞ্জাবী এবং পাঠান রক্ত। নাৎসীদেরও হার মানছে পাক দুবৃর্ত্তরা।
এতসব নারকীয় ঘটনার অবতারণ করেও স্বস্তি পাচ্ছেন না ইয়াহিয়া খান। কাঁটার মত সর্বাঙ্গে ফুটছে বিদেশে পাক-দূতাবাসগুলাের বাঙালী কর্মীদেরর মি চিমটি। ওদের জন্য দরকার আচ্ছা দাওয়াই। প্রবাসীদরে আত্মরক্ষার বড় অস্ত্র পাশপাের্ট। এটা হাতে থাকলে বাধা নেই অবাধ বিচরণের। পাক দূতাবাসগুলাের বাঙালী কর্মীদের নাগরিকত্বের পরিচয় পাক—পাশপাের্ট। এর বলেই ইরাকের পাক রাষ্ট্রদূত আবদুল ফতে সপরিবারে হাজির হয়েছিলেন লণ্ডনে। নিয়েছিলেন বাংলাদেশের আনুগত্যে। দুনিয়ার সর্বত্র পাক দূতাবাসগুলাের বাঙালী কর্মীদের মধ্যে চলেছে আনুগত্য পাল্টাবার হিড়িক। ইসলামাবাদের গােলামী করতে কেউ রাজী নন। যারা এখনও চাকরিতে টিকে আছেন তারা হয়ত খুঁজছেন গােলামখানা থেকে মুক্তির সুযােগ। ওদের আটক রাখার জন্য প্রয়ােজন পাশপাের্ট আটক। ওটা ছাড়া থাকবে না পাক নাগরিকত্বের প্রমাণ। বিপদে পড়বেন সম্ভাব্য ইসলামাবাদের চাকরি ত্যাগীর দল। ইয়াহিয়ার হুকুম পাক-দূতাবাসগুলাের সব কর্মীর পাশপাের্ট জমা রাখতে হবে মিশনের প্রধানের কাছে। বিশ্বাসযােগ্য কারণ না দেখালে কেউ ফেরৎ পাবেন না এই পাশপাের্ট। হুকুমটা যদিও বাঙালী অবাঙালী নির্বিশেষে সব কর্মীর উপরই প্রযােজ্য তবু তার আসল আঘাত আসবে বাঙালীদের উপর। কারণ তারাই বিদ্রোহী এবং স্বৈরচারী পাক ডিকটেটরের অনাস্থাভাজন। আগ্নেয়গিরির মুখ গহব্বরে ক’বস্তা বালু চাপা দেিয় অগ্নিস্রাব ঠেকাতে চাচ্ছেন সামরিক শাসকগােষ্ঠী। তাতেও কাটছে না বিপদ। পিকিংএ পাক-দূতাবাসের প্রধান জনাব কাইজার। তিনি আবার বাঙালী। হুকুম অনুযায়ী তার হাতেই জমা পড়ার কথা দূতাবাসের সব কর্মীর পাশপাের্ট। বাঙালীকে বিশ্বাস নেই। তাই আগেভাগেই এসেছে তার বদলীর আদেশ। ফিরে যেতে হবে তাকে ইসলামাবাদে। সেখানে নাকি তার উপস্থিতির বড় দরকার। বুদ্ধিমানের চালাকি দুরদর্শিতার লক্ষণ। আর বেকুবের চালাকি শয়তানের ইতরামী। ভদ্র রাজনীতি ছেড়ে এই ইতরামীর পথ ধরেছেন জঙ্গীনেতা ইয়াহিয়া খান। তা পাশপাের্ট নিয়ে সুরু করেছেন টানাটানি।

সূত্র: দৈনিক যুগান্তর, ৬ সেপ্টেম্বর ১৯৭১