বাঙলাদেশ : সংক্ষিপ্ত পটভূমিকা
যীশু চৌধুরী
বাঙলাদেশের আগেকার নাম ছিল পূর্ব পাকিস্তান। পশ্চিম পাকিস্তানের করাচি বন্দর-শহর ছিল যুক্ত পাকিস্তানের রাজধানী। পাকিস্তান ভারতবর্ষ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট, হিন্দু ও মুসলমান এই দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে। পাকিস্তানের পশ্চিমাঞ্চল ও পূর্বাঞ্চলের মধ্যে ব্যবধান দীর্ঘ এক হাজার মাইল । পাকিস্তানের শাসন ব্যবস্থায় পশ্চিমারাই প্রভুত্ব কায়েম করল, কিন্তু দেশের অধিকাংশ সম্পদ আসত পূর্ব থেকে। এই অংশের জনসংখ্যাও সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিল। ফলে জনগণের মধ্যে দেখা দিল বিক্ষোভ। এই বিক্ষোভের প্রথম প্রকাশ ঘটল রাষ্ট্রভাষার প্রশ্নে। পশ্চিমারা চাইলেন উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে ঘােষণা করতে কিন্তু পূর্বের সাড়ে সাত কোটি বাঙালি সেই ফরমানকে অস্বীকার করলেন। ১৯৫০, ৫১ ও ৫২তে তার আন্দোলন চলল পশ্চিমাদের বিরুদ্ধে। অবশেষে ১৯৫২র ২১ ফেব্রুয়ারি শহীদী বরণ করলেন ৯ জন যুবক, ভাষার মর্যাদা রক্ষায় প্রাণ দিলেন তারা। ২১ ফেব্রুয়ারি, সেই থেকে বাঙালিদের কাছে শহিদ দিবস বলে গণ্য হলাে। এই ভাষা আন্দোলনের ফলে বাঙালিরা একটি জিনিস উপলব্ধি করলেন, পশ্চিমা প্রভুরা পূর্বাঞ্চলকে একটি উপনিবেশ হিসেবে দেখতে চায়। এই ঐতিহাসিক আন্দোলন চলেছিল ৫৩ সাল পর্যন্ত, প্রাণ দিয়েছিলেন ১৮৩৬ জন। পাকিস্তানি শাসকবর্গ শেষ পর্যন্ত বাঙলাকে দেশের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা বলে স্বীকার করে নিতে বাধ্য হলেন।
১৯৫৪ সালে পাকিস্তানের সাধারণ নির্বাচনে পূর্বে বাঙলায় যে মুসলিম লীগ বিরােধী ফ্রন্ট বিধানসভার ৩০৯টি আসনের মধ্যে ২১৫টি আসন পেয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। ফলে ৩ এপ্রিল তারা মন্ত্রিসভা গঠন করলেন। এ.কে. ফজলুল হক মুখ্যমন্ত্রী নির্বাচিত হলেন। তাঁর আমলে পাকিস্তানের স্বার্থন্বেষী গােষ্ঠী নারায়ণগঞ্জের আদমজী মিলে বাঙালি ও অবাঙালিদের মধ্যে দাঙ্গা বাধিয়ে দিল। ফলে ৩০ মে এই প্রগতিশীল সরকার কেন্দ্রীয় সরকারের স্বার্থপুষ্ট নির্দেশ বাতিল হয়ে গেল। ফজলুল হক দেশদ্রোহী অভিযােগে অন্তরীণ হলেন, মন্ত্রিসভার বন্দি হলেন এবং রাজনৈতিক পাটিগুলাে নিষিদ্ধ হয়ে গেল।
কেন্দ্রেও চলছিল অনবরত মন্ত্রিসভা বদল। প্রথমে সুরাবর্দি, পরে ফিরােজ খা নুন, এবং অবশেষে ১৯৫৮-র ২৭ অক্টোবর সংবিধান বাতিল করে দিয়ে, এলেন সৈন্যবাহিনীর প্রধান মার্শাল আয়ুব খান। বাঙালিরা সহজে এই স্বৈরশাসন মেনে নিলেন না। প্রতিবাদ জানালেন তাঁরা, দীর্ঘ এগারাে বছর ধরে পূর্বাঞ্চলের রােষবহ্নি সহ্য করতে না পেরে বিদায় নিলেন তিনি। এর মধ্যে শেখ মুজিবুরকে আয়ুব ‘দেশদ্রোহী’ ঘােষণা করলেন এবং আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা নামে এক সাজানাে মামলা চালালেন তার বিরুদ্ধে। কিন্তু প্রত্যাহৃত হলাে সেই মিথ্যা মামলা। লােকচক্ষে আয়ুব হেয় প্রতিপন্ন হলেন। ৬৯-র ২৫ মার্চ আয়ুবের বিদায় নেবার পর নতুন জঙ্গীনায়ক ইয়াহিয়া ক্ষমতা দখল করলেন। তিনি ঐ বছর ২৮ নভেম্বর ঘােষণা করলেন যে প্রাপ্তবয়স্কদের ভােটাধিকারের ভিত্তিতে নির্বাচন সম্পন্ন করবেন। নানা টালবাহনার পর ১৯৭০-এর ৭ ডিসেম্বর নির্বাচন অনুষ্ঠান শুরু হলাে। এর মধ্যে পূর্ববাঙলার উপকূলে ঘটে গেছে ভয়াবহ। সামুদ্রিক ঘূর্ণিঝড়। তবু ৬ দফা কর্মসূচি নিয়ে নির্বাচনে নামলাে আওয়ামী লীগ। শেখ মুজিবুরের নেতৃত্বে তারা বিপুল সংখ্যাধিক্যে জয়লাভ করলাে। ফলে পাকিস্তানের প্রকৃত শাসনভার গ্রহণ করার কথা শেখ মুজিবুর রহমানের ও তাঁর পার্টি আওয়ামী লীগের। কিন্তু সব ধূলিসাৎ হয়ে গেল ২৫ মার্চ রাত্রে । ইয়াহিয়া ও পশ্চিমের সর্ববৃহৎ দল পিপলস পার্টির নেতা ভুট্টো, মুজিবুরের সঙ্গে আলাপ আলােচনা চালাবার সময়ে ঢাকায় সৈন্যবাহিনী আমদানী করলেন এবং ২৫ মার্চ সেই বাহিনীকে স্বায়ত্ত্ব শাসনকামী জনগণের ওপর লেলিয়ে দিলেন। পরের দিন পূর্ব বাঙলার নেতারা। বাঙলাদেশের স্বাধীনতা ঘােষণা করলেন। শুরু হলাে নতুন ইতিহাসের। সেই ইতিহাসকে সম্মান দেবার জন্যেই বাঙলাদেশের বীর তরুণেরা পশ্চিমা হানাদারদের বিরুদ্ধে তীব্র লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন।
সূত্র: সপ্তাহ, ১০ ডিসেম্বর ১৯৭১