পাক-ভারত যুদ্ধ এবং চীন ও রাশিয়া
১লা নভেম্বর নিউ ইয়র্কের খবরে প্রকাশ যে, বিখ্যাত মার্কিন সাপ্তাহিক পত্র ‘নিউজ উইকের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ঘােষণা করিয়াছেন যে, ভারতবর্ষের সঙ্গে যুদ্ধ আসন্ন।
“এমনকি ভারতীয়রা ইতিপূর্বেই আমাদের সঙ্গে যুদ্ধ বাধাইয়াছে। তবে, আমরা এখনও প্রত্যাঘাত করি নাই। কিন্তু ভারতীয়রা যদি এই সংঘাত বাড়াইতে চায়, যদি আমাদের ভূমি দখল করে এবং একটি তাঁবেদার বাঙলাদেশ সরকারের প্রতিষ্ঠা দেয়, তবে, তার অর্থ হইবে নিশ্চিত নিশ্চিত যুদ্ধ।” সঙ্গে সঙ্গে তিনি একথাও স্মরণ করাইয়া দিয়াছেন যে, পাকিস্তানকে ধ্বংস করার উদ্দেশ্যে ভারতের এই যুদ্ধ চীন নিশ্চয়ই সহ্য করবে না এবং চীন পাকিস্তানকে সমস্ত প্রকার অস্ত্রশস্ত্র ও গােলাবারুদ দিয়ে সাহায্য করিবে। একমাত্র চীনা সৈন্য পাঠানাে ছাড়া চীন তার সমস্ত সামরিক সাহায্যই পাকিস্তানকে দিবে। লন্ডনের রক্ষণশীল দৈনিক পত্রিকা ডেইলি মেলের প্রতিনিধির নিকটও ইয়াহিয়া খান প্রায় অনুরূপ একটি বিবৃতি দিয়াছেন। ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী এই সময় লন্ডনে ব্রিটিশ সরকারের নেতাদের সঙ্গে আলােচনা করিতেছিলেন – বােধ হয় সেই পরিপ্রেক্ষিতেই ইয়াহিয়া খানের এই বিবৃতি এবং এই বিবৃতিতে কিছুটা অশালীন ও ঔদ্ধত্যের সুরে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর উদ্দেশ্য ইয়াহিয়া খান শাসানি দিয়া বলিয়াছেন—“আমি ভগবানের কাছে কামনা করি এই স্ত্রীলােকটি (ওম্যান) যেন বুঝিতে পারেন যে, স্বাধীন বাঙলাদেশের অর্থ কেবল পাকিস্তান ভাঙিয়া যাওয়া নয়, এর দ্বারা ভারতীয় ইউনিয়নেরও ভাঙনের সূত্রপাত হইবে।” অর্থাৎ ইয়াহিয়া খান আমাদের তিন রকমের শাসানি দিতেছেন— প্রথমত, পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধ, দ্বিতীয়ত, সেই যুদ্ধে চীনের সর্বপ্রকার সামরিক সাহায্য দান, এবং তৃতীয়ত, ভারতীয় ইউনিয়নের ভাঙন। এই শেষােক্ত শাসানি কিংবা ভারতীয় ইউনিয়নের ভাঙনের কথা বলা হইয়াছে বােধ হয় পশ্চিমবঙ্গের দিকে তাকাইয়া। অর্থাৎ ইয়াহিয়া খান বুঝাইতে চাহিয়াছেন যে, পূর্ববঙ্গে স্বতন্ত্র স্বাধীন রাষ্ট্রে পরিণত হইলে পশ্চিমবঙ্গেও একদিন তার সঙ্গে হাত মিলাইতে পারে এবং এভাবে একটি স্বাধীন যুক্তবঙ্গের প্রতিষ্ঠা হইতে পারে। এই দৃষ্টান্তে দক্ষিণ ভারতে ডি এম কেএর বিচ্ছিন্নতা ও স্বতন্ত্র দ্রাবিড়িস্থান এবং উত্তর-পশ্চিমে শিখিস্থান ইত্যাদি আন্দোলন দানা বাঁধিতে পারে । অবশ্য এই সমস্ত জুজুর ভয় দেখানাে মাত্র। কারণ, বাঙলাদেশের সমস্যার উদ্ভব হইয়াছে পার্টিশান থেকে এবং হাজার মাইল ব্যবধানের এই বাঙলাদেশ পশ্চিম পাকিস্তানের উপনিবেশ মাত্র ছিল-যে কথাটা এতদিন পর ‘নিউজ উইক’ সাপ্তাহিকের নিকট স্বয়ং ইয়াহিয়া খানই স্বীকার করিতে বাধ্য হইয়াছেন। তিনি বলিয়াছেন, “একথা সত্য যে, পশ্চিম পাকিস্তান কখনও বাঙলাদেশের উপর ন্যায়বিচার করে নাই।” সােজা কথায় পূর্ববঙ্গে ও পশ্চিমপাকিস্তানের মধ্যে যে সমস্যা গত ২৪ বছরের ক্রমাগত অত্যাচার-অনাচারের ফলে উদ্ভব হইয়াছে, তার সঙ্গে ভারতবর্ষের কোন অঙ্গরাজ্যের কোন তুলনাই হয় না। এগুলাে মনগড়া অভিযােগ এবং ভারত সরকারকে ভয় দেখানাে মাত্র। যার আলােচনা এখানে নিরর্থক।
অবশ্য ইয়াহিয়া খান এর আগেও চীনের নাম করিয়া ভারতবর্ষকে জানাইয়াছেন এবং বলিয়াছেন— “আমরা একলা নই।” উত্তরে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সর্দার শরণ সিংও বলিয়াছিলেন—“আমরাও একলা নই!” এর পরেই ভারতবর্ষ ও সােভিয়েত রাশিয়ার মধ্যে গত অগস্ট মাসে মৈত্রীও সহযােগিতার চুক্তি স্বাক্ষরিত হইয়াছে। এই চুক্তি স্বাক্ষরের পর স্বয়ং সােভিয়েত ইউনিয়নের রাষ্ট্রপতি এবং সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী এবং তারপর বিমানবাহিনীর সর্বাধ্যক্ষ-পর পর এই সমস্ত শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তি নয়াদিল্লীতে আসিয়াছেন এবং ভারত সরকারের সঙ্গে পরামর্শ করিয়াছেন। বলা বাহুল্য যে, পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধ বাধিবার আশঙ্কার জন্যই এই সমস্ত আনাগােনা ও সলাপরামর্শ ঘটিতেছে। ভারত ও সােভিয়েত রাশিয়ার মধ্যে যে মৈত্রী ও সহযােগিতার চুক্তি স্বাক্ষরিত হইয়াছে, তার অন্যতম উদ্দেশ্য পাক-ভারত উপমহাদেশ তথা সমগ্র এশিয়াতে শান্তি রক্ষা। পাকিস্তান ভারতবর্ষকে আক্রমণ করিলে নিঃসন্দেহে উপমহাদেশে, এমন কি এশিয়া মহাদেশে আগুন জ্বলিবে। সােভিয়েত নীতি আক্রমণাত্মক যুদ্ধের বিরােধী। সুতরাং পাকিস্তানকে বাধা দেওয়া সােভিয়েত দায়িত্বেরও অন্তর্গত। এই প্রসঙ্গে ভারত- সােভিয়েত চুক্তির নবম ধারা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
এই ধারায় বলা হইয়াছে—“কোন পক্ষে যদি আক্রান্ত হয়, অথবা আক্রমণের আশঙ্কার সম্মুখীন হয়, তাহলে চুক্তিবদ্ধ উভয়পক্ষ সেই আশঙ্কা দূর করার জন্য এবং তাদের নিজ নিজ দেশের শান্তি ও নিরাপত্তাকে সুনিশ্চিত করার উদ্দেশ্যে উপযুক্ত কার্যকর ব্যবস্থা অবলম্বনের জন্য তৎক্ষণাৎ পারস্পরিক আলােচনার প্রবৃত্ত হইবেন।” অতএব দুই রাষ্ট্রের মধ্যে স্বাক্ষরিত চুক্তি অনুসারে সােভিয়েত রাশিয়া আক্রান্ত ভারতবর্ষের পার্শ্বে দাঁড়াইতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। এ জন্যই ইয়াহিয়া খানের মনে রাখা দরকার যে, “ভারতবর্ষও একলা নয়” এবং চীনের ভয় দেখাইয়া ইসলামাবাদের ফ্যাসিস্তচক্র ভারতবর্ষকে ৯০ লক্ষ শরণার্থীর অভূতপূর্ব দায়িত্ব বহনে অনিশ্চিতকাল পর্যন্ত বাধ্য করিয়া রাখিবে, এমন আশা করা নিতান্তই মূর্খতার পরিচায়ক। সােভিয়েত ইউনিয়ন পৃথিবীর অন্যতম সেরা সামরিক শক্তি এবং সেই শক্তি আজ অকৃত্রিম বন্ধুর মতাে ভারতবর্ষের পার্শ্বে দণ্ডায়মান। অতএব চীনের ভয় দেখাইয়া গর্জন করা ইয়াহিয়া খানের পক্ষে বুদ্ধিমত্তার পরিচায়ক নয় । পাকিস্তানের মিলিটারি জুন্টার আরও জানা উচিত যে, বাঙলাদেশের স্বাধীনতার প্রশ্ন, শরণার্থীদের সমস্যা এবং পূর্ববঙ্গে পাকিস্তানি নৃশংস অত্যাচার-এই সমস্ত আর ভারত ও সােভিয়েত রাশিয়ায় কিংবা বিভিন্ন সরকারের একমতে “কূটনৈতিক স্তরে” আলােচনার মধ্যে সীমাবদ্ধ নাই। এই নিদারুণ সমস্যার প্রতিক্রিয়া বিভিন্ন দেশের জনগণের মধ্যে বে-সরকারি স্তরে অনেক আগেই ছাড়াইয়া পড়িয়াছে। এক্ষেত্রে সােভিয়েত দেশের জনগণ এবং বিভিন্ন সংস্থার মধ্যেও এই সমস্যা আলােড়ন তুলিয়াছে। সােভিয়েত শান্তি কমিটি, সােভিয়েত ট্রেড ইউনিয়নসমূহ, সােভিয়েত আফ্রো-এশীয় সংহতি কমিটি, সােভিয়েত সাংবাদিক ইউনিয়ন, সােভিয়েত রেড ক্রস, এমন কি সােভিয়েত নারী সমাজ পর্যন্ত বিভিন্ন বিবৃতির মাধ্যমে ইসলামাবাদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ ও বাংলাদেশ সমস্যার আশুমীমাংসা দাবি করিয়াছেন। তারা দাবি করিয়াছেন—“পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের ইচ্ছা, অধিকার ও আইনসঙ্গত স্বার্থকে যথাযথ মর্যাদা দিয়া উদ্ভুত সমস্যার এক রাজনৈতিক সমাধান অর্জনের জন্য এবং শরণার্থীদের যথাশীঘ্র সম্ভাব স্বদেশে প্রত্যাবর্তনের উপযােগী অবস্থা সৃষ্টি করার জন্য জরুরি ব্যবস্থা গ্রহণ করেন।”
সােভিয়েত রাশিয়ার জনগণ ও গভর্নমেন্টের এই পরিষ্কার মনােভাবের সামনে যদি ইয়াহিয়া খান ও তার নেকড়ের দল ভারতবর্ষের ঘাড়ে ঝাপাইয়া পড়ে, তবে, সােভিয়েতের পূর্ণ সহযােগিতায় ভারতবর্ষ তার উপযুক্ত জবাব দেবে। ইয়াহিয়া খান বর্ণিত চৈনিক ভীতি প্রদর্শনের জন্য ভারতবর্ষের ৫৫ কোটি মানুষ পিছু হটিয়া যাইবে না। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান নিজেই স্বীকার করিয়াছেন যে, সামরিক দিক দিয়ে ভরতবর্ষ পাকিস্তানের তুলনায় পাঁচ গুণ বেশি শক্তিশালী। এই অবস্থায় যদি পাকিস্তান উন্মাদের মতাে ভারতবর্ষকে আক্রমণ করে, তবে পূর্ব বাঙলার জনগণ সেই সুযােগে পাকিস্তানি ফ্যাসিস্ট বাহিনীকে বিতাড়িত করিয়া নিজেদের স্বাধীনতা কায়েম করিবে এবং ভারতবর্ষ সরকারিভাবে সামরিক দিয়া বাঙলাদেশের মুক্তিযােদ্ধাদের প্রতি সহযােগিতার হাত বাড়াইয়া দিবে। সেই অবস্থায় সমগ্র পূর্ব বাঙলায় মুক্তি ঘটিতে ৭২ ঘণ্টার বেশি সময় লাগিবে না।
কিন্তু ভারতবর্ষ বা সােভিয়েত রাশিয়া কেউ যুদ্ধ চায় না। নয়া দিল্লী ও মস্কো শান্তি ও মৈত্রীর নীতিতে বিশ্বাসী। এ জন্যই “রাজনৈতিক মীমাংসার উপর এত দেওয়া হইতেছে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী অপরিসীম ধৈর্য ও সহিষ্ণুতা দেখাইতেছেন এবং পৃথিবীর বিভিন্ন রাষ্ট্রের কাছে এই সমস্যার মীমাংসার জন্য কার্যত আবেদনপত্র নিয়া দ্বারে দ্বারে গিয়াছেন। তার এই আন্তরিক শান্তি প্রচেষ্টা যদি ব্যর্থ হয়, তবে, তার দায়িত্ব ভারতের ঘাড়ে বসিবে না। কিন্তু শেষ পর্যন্ত রাজনৈতিক মীমাংসার কালে পাকিস্তান যদি “সামরিক মীমাংসার” পথ ধরিতে চায়, তবে, পাকিস্তানের যদি “সামরিক মীমাংসার” পথ ধরিতে চায়, তবে, পাকিস্তানের অস্তিত্বের পক্ষে সেই অংশটা আদৌ সুখকর হইবে না-ইয়াহিয়া খান যতই চীনের দোহাই দেন না কেন।
কিন্তু পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে যুদ্ধ ও রক্তপাত আসন্ন বলিয়া স্বয়ং ইয়াহিয়া খান যে ভয় দেখাইয়াছেন, তা নিশ্চয়ই উড়াইয়া দেওয়ার মতাে নয়। কারণ, ৯০ লক্ষ শরণার্থী ও বাঙলাদেশের স্বাধীনতার প্রশ্নে যে ভয়ঙ্কর জটিল অবস্থার সৃষ্টি হইয়াছে, তার পরিণতিতে যুদ্ধ বাধার বারােআনা সম্ভাবনা। এই কথা আমি ইতিপূর্বেই সপ্তাহ কাগজের আগেকার প্রবন্ধগুলােতে উল্লেখ করিয়াছি। কারণ, ইয়াহিয়া খানের রাজত্বের অবসান ও বাঙলাদেশের স্বাধীনতা ছাড়া ৯০ লক্ষ শরণার্থীর পক্ষে স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করা। সম্ভব নয়। আবার এই শরণার্থী সমস্যার মীমাংসা না হইলে ভারতেবর্ষের পক্ষেও আর্থিক সর্বনাশ ও সামাজিক বিপদ অবশ্যম্ভাবী। এ জন্যই ভারত সরকারের পক্ষ থেকে প্রধানমন্ত্রী বার বার রাজনৈতিক মীমাংসার দাবি জানাইয়াছেন। এবং এই রাজনৈতিক মীমাংসার অর্থ হইতেছে পূর্ববঙ্গের জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার স্বীকার করা, যার অর্থ বর্তমান পাকিস্তানের বিলােপ। ইয়াহিয়া খানের আশা এই যে, চীন পাকিস্তানের বিলােপ মানিয়া লইবে না। অতএব পাক-ভারত যুদ্ধে চীন আগের মতই পাকিস্তানের পক্ষে দাঁড়াইবে। পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট মাও সে-তুংয়ের চীনের “মনের কথা জানেন কি না, তা আমরা জানি না। তবে, একথা সত্য যে, চীন এতদিন পর্যন্ত ভারতের প্রতি বৈরিতা এবং পাকিস্তানের প্রতি পক্ষপাতদুষ্ট মনােভাবই দেখাইয়া আসিয়াছে। কিন্তু ১৯৭১ সালের চীন ও তার পূর্ববর্তী চীন মানসিকতার দিক থেকে একই পর্যায়ে আছে কি না, সন্দেহ। কারণ, দুটি বিরাট পরিবর্তন ঘটিয়াছে কিংবা ঘটিতে চলিয়াছে। মনে রাখা দরকার যে সাংস্কৃতিক বিপ্লবের পর চীন তার বৈদেশিক সম্পর্কের নূতন মূল্যায়ন ঘটাইয়াছে। মর্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সমঝােতার চেষ্টা, প্রেসিডেন্ট নিক্সনের প্রস্তাবিত পিকিং পরিদর্শন এবং রাষ্ট্রসংঘ বা ইউনাইটেড নেশন্সে চীনের প্রবেশ এই সমস্তই গভীর ঐতিহাসিক তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা। জনগণতন্ত্রী চীনের প্রতিষ্ঠা হওয়ার ২২ বছর পর মাও সে-তুংয়ের চীন রাষ্ট্রসঙ্ েএবং সিকিউরিটি কাউন্সিলের সদস্য পদে অভিষিক্ত হওয়ার অধিকার পাইল। এতদিন পর্যন্ত ফরমােজা বা তাইওয়ান দ্বীপের চিয়াংকাই সেকের জাতীয়তাবাদী চীন ছিল রাষ্ট্রসঙ্রে অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা রাষ্ট্ররূপে সিকিউরিটি কাউন্সিলের সম্মানিত সদস্য ! কিন্তু আজ চিয়াংকাই চীন সমগ্র রাষ্ট্রসংঘ থেকেই বহিস্কৃত হইল। অর্থাৎ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার তাবেদারগণ “দুই চীন নীতি” চালাইবার যে চেষ্টা করিতেছিল, তা সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থ হইল এবং পিকিং সরকার নূতন মর্যাদার সঙ্গে আন্তর্জাতিক সভায় নিজের আসন দখল করিলেন। রাষ্ট্রসঙ্ঘের সদস্যপদে গৃহীত হওয়ার পর পিকিং থেকে ঘােষণা করা হইয়াছে যে, চীন কখনও “বৃহৎ শক্তির” বা “বিগৃপাওয়ারের’ দম্ভ নিয়া চলিবে না, কিন্তু সেই সঙ্গে এমন আভাষও দেওয়া হইয়াছে যে, চীন তার মূলনীতি হইতে সরিয়া যাইবেনা। পরাধীন জাতির মুক্তি এবং ঔপনিবেশিক দাসত্ব থেকে ত্রাণ লাভ এই মূলনীতিগুলাে চীন স্বীকার করে। পূর্ববঙ্গের সাড়ে সাত কোটি মানুষ এই ঔপনিবেশিক দাসত্ব থেকে মুক্তি লাভের জন্য পশ্চিম পাকিস্তানের ফ্যাসিজমের বিরুদ্ধে লড়াই করিতেছে। চীন বাঙলাদেশের এই স্বাধিকার স্বাধীনতা অর্জনের বিরুদ্ধে এখন পর্যন্ত প্রকাশ্যে কোন ঘােষণা হইয়াছে এমন কথা আমার জানা নাই। তবে, একথা সত্য যে, ইয়াহিয়া খানের প্রতি চীন স্পষ্টতঃই সমর্থন জানাইয়াছে। কিন্তু হাতে-কলমে ভারতবর্ষকে আক্রমণ করিলে এবং পাক-ভারত যুদ্ধ শুরু হইয়া গেলে চীন “সামরিক দিক দিয়া” পাকিস্তানকে সহায়তা করিবে কি না, সেটা নিশ্চিত বলা কঠিন। কারণ, পাকিস্তান ও চীনের মধ্যে আপাতত কোন স্বাক্ষরিত চুক্তি নাই। অথচ চীন সবে মাত্র রাষ্ট্রসঙ্ঘে প্রবশ করিয়াছে এবং আন্তর্জাতিক জগতে নূতন ভূমিকা গ্রহণের ভঙ্গি দেখাইতেছে। বিশেষত ভারতবর্ষের সঙ্গে বিরােধ মিটাইবার এবং বুঝাপড়া করার মতাে একটা মনােভাবের কিছু কিছু ইঙ্গিত পিকিং থেকে পাওয়া যাইতেছে। এমন কি, নূতন করিয়া রাষ্ট্রদূত বিনিময়ের কথাও উঠিয়াছে। সুতরাং ভারতের বিরুদ্ধে পাকিস্তানি যুদ্ধে চীন কতখানি সামরিক সাহায্য দেবে, সেকথা এখনও বলা কঠিন।
সূত্র: সপ্তাহ, ৫ নভেম্বর ১৯৭১