এম মনসুর আলীর অন্তিমযাত্রায় লাশ নিয়ে টানাটানি
====================
ভয়ার্ত মানচিত্র—শােকস্তব্ধ জাতি। মাত্র ৮০ দিনের ব্যবধানে জাতির জনকের হত্যার পর জাতীয় চারনেতা নিহত। সমগ্র জাতি দিকভ্রান্ত। আশাহত। শােকাচ্ছন্ন। নেতৃত্বশূন্য। জাতীয় চারনেতার লাশ অযত্নে পড়ে আছে। কারাভ্যন্তরে । হস্তান্তর প্রক্রিয়া শেষ হতে ২ দিন কেটে গেল। এই যে সুরতহাল রিপাের্ট লিখে গেলেন ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব। তখনও মনসুর আলীর সফেদ শরীর রক্তাক্ত অবস্থায় পাঁজর ভেদ করা বুলেট চিহ্ন নিয়ে পড়ে আছে। ওদিকে সেনানিবাসে চলছে পরস্পরের বুলেট বিনিময়ের মহড়া। খন্দকার মােশতাক নিয়ন্ত্রণহারা। সবকিছু ভেঙে পড়ছে। জিয়া-তাহের-খালেদ মােশারফ অভ্যুত্থান, পাল্টা অভ্যুত্থান চলছে। এমন ভয়ার্ত সময়ে যখন পাওয়া গেল মনুসর আলীর মৃতদেহ-তার অন্তিমযাত্রা পর্বটিও ছিল উন্মাদ প্রহরের পথে পথে পাথর ছড়ানাে, মসৃণ হলাে না শেষযাত্রাও। ভয় আতঙ্ক বিভীষিকা চারিদিকে।
ডিআইজি প্রিজন-এর রিপাের্টে দেখা যাচ্ছে, ৫ নভেম্বর ভােরে এএইচএম কামারুজ্জামান এবং এম মনসুর আলীর লাশ তাদের আত্মীয় স্বজনদের হাতে তুলে দেয়া হয়। পুলিশ পাহারায় সেসব লাশ বহনের জন্য ডিআইজি প্রিজন ব্যবস্থা নিয়েছিলেন বলে জানান। এদিকে হত্যার খবর যখন মনসুর আলীর পরিবারে পৌঁছেছিল তখন পরিস্থিতি সম্পর্কে একটি বিবরণ পাওয়া যায় তাঁর স্ত্রী আমিনা মনসুরের স্মৃতিকথায়। তিনি লিখেছেন :
এর পরেই ৩ নভেম্বর এসে গেল, দিনটা কীভাবে কেটে গেল জানি না। রাতে কে যেন মিষ্টি দিয়ে গেল আর বলে গেল, মােস্তাকদের বন্দি করা হয়েছে, তাই এই মিষ্টি। মনে করলাম সত্যি তাে! এর পরের দিন ৩ নভেম্বর আমাদের দুর্ভাগ্যের দিন। সবেমাত্র ওজু করেছি। নামাজ পড়তে যাবাে। ঐ সময় বেগম নজরুল আর শেখ শহীদের স্ত্রী ঘরে ঢােকে। বেগম নজরুল কাঁদতে কাঁদতে বললাে, ভাবী খবর জানেন, তাঁরা কেউ নেই, সব শেষ। এরপর সেলিম বললেন, আম্মা আমাদের এখনই অন্য বাড়িতে চলে যেতে হবে। তখনই আমরা আমার চাচা শ্বশুরের বাড়িতে উঠলাম। আমার হাতে তখনও কোরআন শরিফ। তখন আফজাল, রেজা, রােমিও, মঞ্জু, শিরি সবাই কেঁদে উঠলাে। আমার বুকে কে যেন পাথর চাপা দিল। আর কাদাকাটি কিছুই করতে পারলাম না। আমাদের আবার নিয়ে গেল আমার বােনের বাসায়। আত্মীয়স্বজন সবাই ভীড় করে সান্ত্বনা দিচ্ছে। কার থেকে যেন শুনি বারেক ভাই আর বড় বেয়াই সাহেব উনার লাশ নিয়ে এসেছে। উনার বুকে গুলির দাগ দেখে সেলিম, রেজা, রােমিও, মঞ্জু, শিরি সবাই অজ্ঞান হয়ে পড়লাে। আমি শুধু মুখটা দেখলাম, মনে হয় আগের দিন সেভ করেছে। কি সুন্দর মৌন চেহারা, মনে হলাে ঘুমিয়ে পড়েছে।
মনসুর আলীর অন্তিমযাত্রাকালে তাঁর নিজ বাসভবনে যেতেও পারেননি। কারণ, তাকে আফজাল সাহেবের বাড়ির সামনে নিয়ে আসা হয়। আর কামারুজ্জামানের লাশ নিয়ে যাওয়া হয় তাঁর এক আত্মীয়ের ভূতের গলির বাড়িতে। সেখান থেকে রাজশাহীতে হেলিকপ্টারযােগে নেয়ার ব্যবস্থা করা হয়। মনসুর আলী ও কামারুজ্জামানের ঢাকা শহরে নিজের কোন বাড়ি নাই। সুতরাং দুইজনের লাশ তাদের আত্মীয়ের বাড়ির উঠোনে নিয়ে আসা হয়। মনসুর আলীর লাশের কথা প্রসঙ্গে প্রত্যক্ষদর্শী জনাব ওয়ালিউর রহমান রেজা লিখেছেন : “আমরা প্রথমে মনসুর আলীর ওঠানে গেলাম। তাকে যেখানে রাখা হয়েছিল সেটি তার ভাতিজা আফজাল সাহেবের বাড়ি। আফজাল সাহেবের সঙ্গে আমার পরিচয় দীর্ঘদিনের। পাকিস্তান আমলে তিনি সরকারী চাকরি করতেন এবং সােবহানবাগে কোয়াটারে থাকতেন। সত্তর সালে মনসুর আলী সাহেবের সঙ্গে আমি অনেক সময় কাটিয়েছি। আমার বাড়ি যেখানে-যে এলাকার সংসদ সদস্য ছিলাম সেই গাইবান্ধায় মনসুর আলী বিয়ে করেছেন। ভাবী আমাদের দীর্ঘদিনের পরিচিত। বাসার ভেতর যখন তার কান্নাকাটি সহ্য করা সম্ভব হচ্ছিল না বেরিয়ে মােড়ের কাছে আমরা বসলাম। কোথায় কবর দেয়া হবে সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্য আলাপ শুরু হলাে। শেষে ঠিক হলাে সােহরাওয়ার্দী উদ্যানের কাছে যে তিনজন নেতার কবর আছে তাদের পাশে কবর দেয়া হবে। এই ব্যবস্থা করার জন্য দু’জন গেলেন। তাঁদের মধ্যে একজন মহীউদ্দীন আহমদ, অন্যজন খন্দকার মােহাম্মদ ইলিয়াস অথবা ব্যারিস্টার শওকত আলী। কিছুক্ষণ পর খবর পাওয়া গেল তাদের দুজনকে আটক করা হয়েছে। জেলে নেওয়া হয়নি। তবে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। ওস্থানে কবর দেওয়ার অনুমতি দেওয়া হবে না। সে সময় মতিউর রহমান, মালেক উকিলের সঙ্গে আলাপ করে একজন ছাত্রনেতাকে বললেন খালেদ মােশাররফকে টেলিফোন করতে। আমার যতদূর মনে পড়ে, সম্ভবত এই ছাত্রনেতা বর্তমান যুব প্রতিমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। বহুক্ষণ চেষ্টার পর খালেদ মােশাররফকে ফোনে পেয়ে মালেক উকিল তার সঙ্গে কথা বললেন। তিনি প্রথমে তাকে অভিনন্দন জানালেন, এ যাবৎ যে সব ব্যবস্থা খালেদ মােশাররফ নিয়েছেন তার জন্য। তারপর বললেন, তার কাছে একটাই অনুরােধ যেন লাশ নিয়ে মিছিল বের করেন। বেশ কিছুক্ষণ কথা হওয়ার পর মালেক উকিল টেলিফোন ছেড়ে দিয়ে জানালেন যে, এসব বিষয়ে কোন রাজনৈতিক স্ট্যান্ড নিতে খালেদ মােশাররফ অনীহা প্রকাশ করেছেন। এ সময় একটা বিষয় আমি বিশেষভাবে লক্ষ্য করছি, প্রচুর লােকজন সুশৃঙ্খলভাবে তাজউদ্দীন আহমদ ও মনসুর আলীর প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে এসেছিলেন।
এই পরিস্থিতিতে ঢাকা পুলিশের পক্ষ থেকে মনসুর আলীর লাশ নিজেদের হেফাজতে নিতে আসে। কিন্তু মনসুর আলীর আত্মীয়স্বজন লাশ দিতে অস্বীকৃতি জানান। পুলিশ ও জনতার মধ্যে একপর্যায়ে বেশ বাক-বিতণ্ডা হলে অবশেষে পুলিশ আধাঘণ্টা সময় দেন জানাজা সমাপ্ত করার জন্য। এই ভাবেই রাস্তার ওপর জনতা দাঁড়িয়ে পড়েন এবং রাস্তায় বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী এম মনসুর আলীর জানাজা পড়া হয়। জানাজার পরপরই পুলিশ মনসুর আলীর লাশ তাদের ট্রাকে তুলে নেয় এবং যেকোন একজন আত্মীয়কে সঙ্গে যাবার অনুমতি দেয়। একটি চাদরে জড়িয়ে পুলিশ দুই জাতীয় নেতার লাশ তুলে নিয়ে যায়।
ওদিকে প্রচুর মুসল্লি বায়তুল মােকাররম মসজিদে তাজউদ্দীন আহমদ ও মনসুর আলীর জানাজা পড়ার জন্য অপেক্ষা করছিলেন। সেখানেও খবর পৌছে যায় যে, লাশ পুলিশ নিজের হেফাজতে নিয়েছে। প্রচুর ছাত্র-জনতা শেষপর্যন্ত গায়েবানা জানাজা পড়ে জাতীয় নেতৃবৃন্দের প্রতি শ্রদ্ধা জানান। অবশেষে স্বল্প কয়েকজন আত্মীয় পরিজনের ও পুলিশের উপস্থিতিতে বনানী কবরস্থানে তিন জাতীয় নেতা এম মনসুর আলী, তাজউদ্দীন আহমদ ও সৈয়দ নজরুল ইসলামকে সমাহিত করা হয়।
স্বাধীন বাংলার ইতিহাসের একটি অধ্যায়ের সমাপ্তি ঘটে এই করুণ ও বর্বরােচিত হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে। বাংলাদেশে আবারও সামরিক স্বৈরাচার ফিরে আসে। অন্ধকার গ্রাস করে নেয় চারিদিকে। দুই দশক জুড়ে চলে অন্ধকারের শাসন। আবার যমুনায় ভাের আসে। জেগে ওঠে পদ্মা মেঘনা যমুনা। জেগে ওঠে ছাপান্ন হাজার বর্গমাইলের বাংলাদেশের মানচিত্র। জেগে ওঠে বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার যুগপৎ আহ্বানে ও নেতৃত্বে। সারা বাংলার মতাে কাজিপুরের মানুষও মনসুর আলীর উত্তরাধিকারী সুযােগ্য সন্তান ড. মােহম্মদ সেলিম, মােহাম্মদ নাসিম-এর মধ্যেই খুঁজে নিয়েছেন প্রিয়তম নেতাকে। যমুনার স্রোতের ওপর দিয়ে নির্মিত হয়েছে মনসুর আলীর স্বপ্নের সেতু। সেতুবন্ধ হয়েছে সারা বাংলাদেশ। কাজিপুরের সবুজ গ্রামের সন্তান এম মনসুর আলী বনানী কবরস্থানের সবুজ উদ্যানে শুয়ে আছেন বাংলাদেশের এপিটাফ হয়ে।
Reference: এম মনসুর আলী – সালিম সাবরিন
(বইটির লিংক https://songramernotebook.com/archives/124442 )