২২ অক্টোবর কসবা যুদ্ধঃ ডা: এম. এস. এ. মনসুর আহমেদ এর সাক্ষাতকার
গ্রাম : চরভাগল
ইউনিয়ন : গোবিন্দপুর (দক্ষিণ)
থানা : ফরিদগঞ্জ
জেলা : চাঁদপুর
১৯৭১ সালে বয়স : ১৯/২০
১৯৭১ সালে পেশা : চিকিৎসা মহাবিদ্যালয়-এর দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র
বর্তমান শিক্ষাগত যোগ্যতা : এম.বি.বি.এস.পি. এইচ (যুক্তরাষ্ট্র) চিকিৎসক
বর্তমান পেশা : সহযোগী অধ্যাপক মেডিক্যাল কলেজ
চট্টগ্রাম চিকিৎসা মহাবিদ্যালয়ের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র ডা: এম. এস. এ. মনসুর আহমেদ মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। চিকিৎসকের অভাবের কারণে তাঁকে দেওয়া হয় চিকিৎসার দায়িত্ব। চিকিৎসক হিসাবে তিনি নরসিংগড়,মনতলা, বিশ্রামগঞ্জ,কোনাবন,সালদা নদী ইত্যাদি এলাকায় চিকিৎসা সেবা দিয়েছেন। তিনি আহত মেজর খালেদ মোশাররফ,ক্যাপ্টেন সুজাত আলীসহ অসংখ্য মুক্তিযোদ্ধার প্রাথমিক চিকিৎসা করেছেন। ডা: মনসুর আহমেদ জানিয়েছেন তাঁর বিচিত্র অভিজ্ঞতার কথা।
প্র: ২৫শে মার্চে ঢাকায় যখন ক্র্যাকডাউন হলো তখন আপনি কোথায় ছিলেন?
উ: ২৫-২৬শে মার্চে ঢাকায় যখন ক্র্যাকডাউনটা হলো তখন আমি চাঁদপুরে। ১৯৭১ সালের মার্চ মাসের প্রথম দিকে চট্টগ্রামে দাঙ্গা লাগলো বাঙালি-বিহারি। ঐ দাঙ্গার পরে আমাদের মেডিক্যাল কলেজ বন্ধ হয়ে গেল। একই সঙ্গে মেডিক্যাল কলেজ হোস্টেলও বন্ধ হয়ে গেল। কলেজ কর্তৃপক্ষ আমাদের প্রতি নির্দেশ দিলেন যে তোমরা যে যার বাড়ি চলে যাও। তখন আমি বাড়ি চলে গেলাম চাঁদপুরে। এই সময় চাঁদপুরে আমরা সংগঠিত হওয়ার চেষ্টা করি।
প্র: ক্র্যাকডাউনের পরে আপনি কি করলেন?
উ: তখন আমাদের সমমনা ছাত্র,আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দ ও অন্যান্যরা মিলে চাঁদপুর শহরে ট্রেনিং-এর ব্যবস্হা করে। তারপর আমরা চাঁদপুর আনসার ক্লাব মাঠে একজন আনসার অ্যাডজুডেন্টের নেতৃত্বে প্যারেড পিটি শুরু করলাম। আমরা ডামি থ্রি নট থ্রি রাইফেল নিয়ে রোজ প্যারেড পিটি করতাম। এর মধ্যে চাঁদপুরে একদিন বিমান হামলা হলো। মেশিনগান থেকে ওরা চাঁদপুর শহরে গুলি চালালো। তারিখটা মনে নেই। সম্ভবত এপ্রিলের প্রথমার্ধে। বিমান হামলার পর মনে হলো পূর্ণ সামরিক প্রস্তুতি ছাড়া এভাবে পাকিস্তান বাহিনীর সাথে সম্মুখ যুদ্ধে মোকাবেলা করা সম্ভব না। এরমধ্যে আমরা শুনলাম যে পাকিস্তানিরা চাঁদপুর দখল করতে আসছে। তখন আমি গ্রামের বাড়িতে চেল গেলাম। গ্রামের বাড়িতে গিয়ে অপেক্ষা করছিলাম যে আবার কিভাবে সংগঠিত হওয়া যায়। এর মধ্যে আমরা খবর পেলাম যে অনেক ছাত্র,যুবক ভারতে চলে গেছে ট্রেনিং নেয়ার জন্য। আমি ভেবে পাচ্ছিলাম না কিভাবে কার সঙ্গে ভারতে যাবো ট্রেনিংয়ের জন্য। এরমধ্যে গ্রামের বাড়িতে দুটো মাস কেটে গেল। জুনের প্রথম দিকে আমাদের বাড়িতে শহীদ ভাইয়ের ছোটভাই রফিক আসলো। রফিক এসে আমাকে জানালো ভাই এসেছেন আগরতলা থেকে। আমাদের বাড়িতে তিনি কালকে আসবেন আমাকে নিতে। এটা শুনে আমি বেশ খুশি হলাম। আব্বা তখন বাড়িতেই এবং উনিও থানা আওয়ামী লীগের নেতা হিসাবে থানাতে যোগাযোগ রক্ষা করছিলেন। এই সময়ের মধ্যে চাঁদপুর শহর আর্মি দখল করে নিয়েছে। আমি আব্বাকে বললাম যে শহীদ ভাই আসবেন। উনি আমাকে নিয়ে যাবেন। তখন আব্বা বললেন যে ঠিক আছে আমিতো চাই যে তুমি দেশের সচেতন নাগরিক হিসাবে দেশের খেদমত কর,ট্রেনিং-এর জন্য ভারতে যাও। শহীদ ভাই পরের দিন আসলেন। আগরতলার উদ্দেশ্যে লুঙ্গি পরলাম,আর একটা সাদা রংয়ের শার্ট গায়ে দিয়ে শহীদ ভাইয়ের সাথে বাড়ি থেকে বের হয়ে গেলাম। সেটা কত তারিখ চিল তা আমার মনে নেই।
প্র: আপনি আগরতলা গিয়ে কি দেখলেন?
উ: আমরা যেখানে বর্ডার পার হলাম সেখানে ভারতের সেই গ্রামের নাম দুর্গাপুর। সেখান থেকে উত্তর দিকে আগরতলার দিকে জঙ্গল কাদা ভেঙ্গে পায়ে হেঁটে গেলাম কাঁঠালিয়া। সেখান থেকে জিপে করে গেলাম আমরা সোনামুড়া। এরপূর্বে সম্ভবত গেলাম মতিনগর। মতিনগর যেয়ে আমরা মুক্তিযোদ্ধাদেরকে খুঁজেছি। শহীদ ভাই চিনেন সব। আমিতো উনার ফলোয়ার। সোনামুড়া গিয়ে দেখি যে অনেক বাঙালি ওখানে আছে। অনেক মুক্তিযোদ্ধা যুদ্ধে যাওয়ার জন্যে ভিড় জমাইছে,লোকে লোকারণ্য। মুক্তিযোদ্ধা প্লাস শরণার্থী। আমরা ওখানে আর থাকি নাই। সোনামুড়া থেকে আমরা বাসে করে সন্ধ্যার আগে রওয়ানা দিলাম। আগরতলা যেয়ে পৌঁছলাম সন্ধ্যার পরে আনুমানিক ৭টা হবে। আগরতলায় যেয়ে একটা ডিগ্রি কলেজে উঠলাম। সেখানে যেয়ে দেখলাম অসংখ্য বাঙালি যুবক,ছাত্র-কলেজের ছাত্র,ইউনিভার্সিটির ছাত্র ওখানে সব অপেক্ষা করছে। আমাদের লিডাররা মাঝে মাঝে আসেন। আবদুল কুদ্দুস মাখন,আ.স.ম. আবদুর রব,মেজর হায়দার আসতেন। যা হউক,রাতটা ওখানে আমরা কাঠালাম। রাত্রে খাবার দিল আনুমানিক ১০টা ১১টার দিকে। খাবারের করুণ অবস্হা। আর রাত্রে যখন শুতে গেলাম দেখি গায়ের সাথে গা ঠাসাঠাসি হচ্ছে। চিত হয়ে শুতে এদিকে ধাক্কা লাগে ওদিকে ধাক্কা লাগে। কাত হয়ে শুলে একটু ঠিকমত শোয়া যায় এমন অবস্হা। মেজর হায়দার এসে আমার পরিচয় জানলেন। পরিচয় দিলাম যে আমি মেডিক্যাল কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। হায়দার ভাই বললেন যে তাহলে তুমিতো ডাক্তার হিসাবে কাজ করতে পারো। আমাদেরতো ডাক্তারের অভাব।
পরদিন উনারা আমাকে নিয়া গেলেন নরসিংগড় মুক্তিযোদ্ধা শিবিরে। এখানে ক্যাম্প প্রধান ছিলেন তখন ক্যাপ্টেন হারুন। অ্যাকচুয়েলি উনি লেফটেন্যান্ট ছিলেন। বিকালে হারুন সাহেব আসলেন। উনার সাথে পরিচয় হলো। প্রথম রাত্রে থাকার ব্যবস্হা হলো নরসিংগড় একটা প্রাইমারি স্কুলে। বিছানা-পত্র কিছুই নেই। দুইটা লম্বা টুল একত্রে জোড়া দিয়ে। মাথার নিচে দেওয়ার মত বালিশ ছিল না। মশারিও নাই। আমার নিজের পুটুলিটাই মাথায় দিয়ে সেদিন আমি শুইলাম। আমি আবার শহীদ ভাইকে বলে এসেছি বিকাল বেলায় যাব। আমি মনে হয় পরের দিন যেতে পারি নাই। তার পরের দিন গেছি আগরতলায় শহীদ ভাইয়ের সাথে দেখা করতে। কিন্তু শহীদ ভাইকে যেয়ে আমি আর পাইনি। যেয়ে শুনি আগের দিন উনাকে নিয়া গেছে ট্রেনিং-এ। শহীদ ভাইয়ের সাথে আর আমার দেখা হয়নি। এরপরে উনি বাংলাদেশে যুদ্ধ করতে এসে অক্টোবর মাসের ১৩ তারিখে মারা গেছেন। উনি শহীদ জাভেদ হিসাবে এখন আমাদের এলাকায় পরিচিত। যাক সেটা,এরপরে আমি আবার ফিরে গেলাম নরসিংগড়ে। আনুমানিক জুনের ২০/২৫ তারিখের দিকে আমি নরসিংগড়ে জয়েন করলাম। তখন থেকে এখানে ছিলাম আনুমানিক সেপ্টেম্বর পর্যন্ত। হারুন সাহেবের সাথে থাকাকালীন শিংগারবিলে অনেকগুলো অপারেশন হয়েছে। সেগুলা আমি স্বচক্ষে দেখেছি। এখানে অনেকগুলো পাকিস্তান আর্মিকে,প্যারামিলিশিয়াকে শিংগারবিল এলাকা থেকে,বাংকার থেকে ধরে নিয়ে আসা হয়েছে। কিছু কিছু পাঞ্জাবির ডেডবডিও আনা হয়েছে। বিভিন্ন অপারেশনে মুক্তিযোদ্ধারা অনেক পাকবাহিনীকে জীবিতও ধরে নিয়ে এসেছে। আমার মনে আছে একটা পাঠান ছেলেকে ধরে নিয়ে এসেছিল। হারুন সাহেবের ওখানে ক্যাম্পে থাকাকালীন দেখেছি। পরে বোধহয় তাকে বি.এস.এফ-এর কাছে বা ইন্ডিয়ান আর্মি কাছে হ্যান্ডওভার করা হয়েছিল। শিংগারবিল এলাকায় থাকাকালীন সময়ে একবার আমার মনে আছে যে একদিন রাতে হঠাৎ করে খুব ব্রাশফায়ার হচ্ছে। ব্রাশ ফায়ার হচ্ছে আমাদের ক্যাম্পকে লক্ষ্য করে। তখন সবাইকে হারুন সাহেব নির্দেশ দিলেন শেল্টার নিতে। তখন আমরা ক্রলিং করে সবাই একটা বাংকারে যেয়ে আশ্রয় নিলাম। খুব সম্ভব পাকবাহিনী অথবা ওদের সহযোগী যারা তারা এসে হামলা করার চেষ্টা করেছিল আমাদের ক্যাম্পের উপরে। আমরা কেউ আহত হই নাই। তবে অনেক গোলাগুলি হয়েছিল। ক্রলিং করতে যেয়ে আমার দুই কনুই ছিঁড়ে গিয়েছিল।
সেপ্টেম্বর মাসের প্রথম দিক পর্যন্ত এখানে ছিলাম। তারপরে আমাকে এখান থেকে নেওয়া হল মনতলায় হেডকোয়ার্টারে। মনতলা হেডকোয়ার্টারে অর্থাৎ ব্যাটেলিয়ান হেড কোয়ার্টারে আমাকে প্রমোশন দেয়া হলো। প্রমোশন না আসলে যেখানে দরকার সেখানে যেতে হয় আরকি। নরসিংগড়ে আরেকজন ডাক্তার ছিল মহসীন বলে। ডেন্টাল কলেজের ছাত্র। সে ছিল সেকেন্ড ইয়ারের। আমিও ছিলাম সেকেন্ড ইয়ারের। ঐ মহসীন কিন্তু মেডিক্যাল কলেজের ছাত্র বলে পরিচয় দিত। যাক,সেও ডাক্তার হিসাবেই কাজ করতো। আমি ওখান থেকে চলে আসলাম আর মহসীন সাহেব ওখানে থেকে গেলেন। আমি চলে গেলাম আইনউদ্দিন সাহেবের হেডকোয়ার্টারে। ব্যাটেলিয়ান হেডকোয়ার্টার তখন মনতলা। মনতলাতে গিয়ে আইনউদ্দিন সাহেবের ব্যাটেলিয়ানের ডাক্তার হিসাবে জয়েন করলাম। এখানে আমাদের প্রধান কাজ ছিল ইমারজেন্সি চিকিৎসা দেওয়া এবং প্রাথমিক চিকিৎসা দেয়া। ডাক্তারিটা হলো মোস্টলি ম্যালেরিয়ার চিকিৎসা মাইনোর এলিমেন্টস। জ্বরের চিকিৎসা আর বেশি অসুবিধা হলে পেট ব্যথার চিকিৎসা। আরও বেশি অসুবিধা হলে নির্দেশ ছিল জিপে করে রোগীকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া। আমরা আগরতলা হাসপাতালে রোগীদেরকে নিয়ে যেতাম। নরসিংগড় থেকেও আগরতলা হাসপাতালে নিয়ে যেতাম। আর বাকি রোগীগুলো যেগুলো আমরা পারতাম সেগুলোর চিকিৎসা করতাম। ঐ সময় তো অনেক মাস হয়ে গেল। জুন মাস থেকে জুলাই আগস্ট-সেপ্টেম্বর। সেপ্টেম্বর মাসের মাঝামাঝি মোটামুটি ডাক্তারিতে একটু হাস এসে গেছে চিকিৎসা করতে করতে। আর একটা কথা,আইনউদ্দিন সাহেবের এইখানে থাকাকালীন সময়ে আমাদেরকে আইনউদ্দীন সাহেব খুব ভালো ব্যবহার করতেন। অফিসারের মর্যাদাই উনি আমাদেরকে দিতেন। একইভাবে ডাক্তার হিসাবে জোয়ানরাও আমাদেরকে অফিসার হিসাবে সম্মান করতো।
প্র: মনতলাতে কোনো উল্লেখযোগ্য ঘটনার কথা মনে পড়ে কি?
উ: মনতলাতে যাওয়ার পরে অক্টোবর মাসের ২২ তারিখে আমাদের একটা প্রোগ্রাম ছিল যে কসবা দখল করবো। এর আগে আইনউদ্দিন সাহেব ২১ তারিখ বা খুব সম্বব ২০ তারিখে আমাকে নিয়ে ঐ এলাকাটা রেকি করতে গিয়েছিলেন। অবশ্য প্রথমে আমি বুঝতে পারি নাই। কারণ উনি আমাকে আগে থেকে বলেননি। আমি ভেবেছি আমি গিয়েছি এমনি উনার সঙ্গী হিসাবে। এরপরে আমাকে উনি ২১ তারিখে বললেন যে ডাক্তার সাহেব কালকে সকালবেলা আমরা কসবা যাব। কসবায় আমাদের একটা অপারেশন আছে। আমি বললাম ঠিক আছে অসুবিধা নাই। ২২শে অক্টোবর সকালে আমরা ভোর সাড়ে চারটার দিকে রওয়ানা দিলাম। আমি,কর্নেল খালেদ মোশাররফ,ক্যাপ্টেন সুজাত আলী-সুজাত আলী সাহেব। হলেন আওয়ামী লীগের এম. পি (কুমিল্লার দেবীদ্বার থেকে ১৯৭০ সালে নির্বাচিত) এবং মেজর আইনউদ্দিন সাহেব-এই চারজন উনার জিপে করে রওয়ানা দিলাম।
আমরা মনতলা থেকে এসে পৌছলাম এটা নির্দেশ ছিল যে খালেদ মোশাররফ সাহেব এসে পৌছবেন এবং পৌছার পরে আক্রমণটা অর্থাৎ আমাদের এদিক থেকে শেলিংটা শুরু হবে। আমরা একটু দেরি করে ফেলেছি। আমরা জিপ থেকে নামার পূর্বেই আমাদের পক্ষ থেকে শেলিং শুরু হয়ে গেছে। খালেদ মোশাররফ সাহেব এবং আইনউদ্দিন সাহেব টিলার উপর থেকে যুদ্ধ পরিচালনা করবেন। আমরা জায়গায় পৌছার একটু আগেই টাইম যেহেতু ফিক্সড করা ছিল-তাই প্রথম শেলিং ইন্ডিয়া থেকে শুরু হলো কসবা পুরান বাজারের উপরে। আমাদের টার্গেট হলো কসবা পুরাণ বাজার দখল করা। প্রথম শেলিং শুরু হওয়ার পরে শব্দ শুনে আমি একটু সারপ্রাইজড হয়ে গেলাম। কেননা খুব গল্প করতে করতে পাসাচিলাম এর মধ্যে প্রচন্ড শব্দে একটু হতচকিত হয়ে গেলাম। পরে বুঝলাম যে শেলিংটা আমাদের পক্ষ থেকে শুরু হয়েছে। তখন আমরা আরেকটু সামনে আগাইলাম। আগানোর পরে জিপ থেকে আমরা ৪ জন নামলাম। নামার পরে দেখি যে ঐ মহসীনসহ আরও কয়েকজন মেডিক্যাল টিম নিয়া আমার জন্যে অপেক্ষা করতেছে। আমি আসলাম। আমাকে আইনউদ্দিন সাহেব বললেন ডাক্তার সাহেব এই মেডিক্যাল ক্যাম্প আপনার দায়িত্বে। আপনি সবকিছু দেখাশোনা করবেন। মহসনি সাহেবও আছে। দুইজনে মিলে আপনারা ম্যানেজ করবেন। আর উনারা মেডিক্যাল টিমটার জন্য যে স্হান নির্ধারণ করলেন সেটা হলো বি.এস.এফ. ক্যাম্পের যে পাহাড়টা ছিল সে পাহাড়ের পিছনে। সেটা অবশ্য উন্মুক্ত খোলা জায়গা ছিল। কোনো শেল্টার নাই। তিনি বলেন যে আপনারা এখানে থাকেন। মেডিক্যাল ক্যাম্পের উদ্দেশ্য হলো আমাদের মুক্তিযোদ্ধা আহত হয়ে যারা আসবে তাদের কাছে যাওয়ার জন্য যত কাছাকাছি থাকা যায়। কিন্তু আমার বিচারে দেখলাম যে এই স্হানটা উপযুক্ত নয়। আমাদের জন্য নিরাপদ নয়। কারন বি.এস.এফ ক্যাম্পতো পাকবাহিনীর টার্গেট হবেই। তখন ন্যাচারেলি বি.এস.এফ ক্যাম্পের উপর গোলা এসে যদি পড়ে তা হলে সেটার ভিকটিম তো আমরাও হতে পারি। আমি আশঙ্কা করেছি কিন্তু কিছুই করবার ছিল না। আমরা ওখানে অপেক্ষা করলাম। কর্নেল খালেদ মোশাররফ,ক্যাপ্টেন সুজাত আলী সাহেব এবং আইনউদ্দীন সাহেব উনারা ঐ পাহাড়ের উপরে উঠে গেলেন বি.এস.এফ. ক্যাম্পে। বি.এস.এফ ক্যাম্পের উপরে যে বাংকার সেই বাংকার থেকে উনারা নির্দেশ দিচ্ছেন। আমরা এইদিকে অপেক্ষা করছি। প্রথমতো একচেটিয়া ভারতের দিক থেকে কসবার উপরে ফায়ার হয়। আমাদের লোকরা যাতে কসবা দখল করার জন্য যেতে পারে,যেন কভারেজ পায় সেইজন্য ফায়ার দেওয়া হচ্ছে। এরপরে পাকবাহিনী তাদের প্রথম ধকলটা কাটিয়ে উঠার পরে তারা মোটামুটি পাল্টা শেলিং শুরু করলো। কসবার পশ্চিমে কুঠি এবং আরও কিছু জায়গা থেকে পাকবাহিনী তাদের শেলিং শুরু করলো,পাল্টা শেলিং। এভাবে তারা যখন শেলিং শুরু করলো তখন প্রচুর আর্টিলারি শেল এসে এই বি.এস.এফ ক্যাম্পের উপরে,কসবার উপরে পড়তে শুরু করলো। তখন আমরা লক্ষ্য করলাম যে বি.এস.এফ ক্যাম্পে তারা যে টার্গেট গুলা করে সেগুলা অনেক সময় ক্যাম্প পার হয়ে আমাদের কাছাকাছি এসে পড়ে। হঠাৎ করে দেখলাম যে আমাদের প্রায় ২০ গজ দূরে একটা শেল মাটিতে এসে পড়লো এবং বিকট শব্দে বিস্ফোরিত হলো। তারপরে অনেক ধুলাবালি উঠে,মাটি উঠে আমাদের গায়ে পড়লো। কিন্তু সৌভাগ্য যে কোনো সিপ্রন্টার এসে আমার গায়ে লাগে নাই। আমার যে অনুমান ছিল সেই অনুমান সত্যি হলো। এটা আমাদের জন্য অর্থাৎ কোনো মেডিক্যাল টিমের জন্য নিরাপদ জায়গা নয়। এই চিন্তা ভাবনা যখন করছি,এরইমধ্যে দেখি আরও কিছুটা দূরে আরেকটা শেল পড়লো। মেডিক্যাল টিমে আমরা যারা আছি তারা ভাবলাম এটাতো বিপজ্জনক ব্যাপার। তখন সবাই বললো যে না,এখন আমরা একটু শেল্টার নেই। আমাদের এছাড়া কোনো উপায় নাই। তখন যে যেদিকে পারলো শেল্টার নিল। আমি কিছুক্ষণের জন্য কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে ভাবলাম যে কোথায় শেল্টার নিব। আমি কোনদিকে যাব? এখানেতো আশে পাশে কোনো শেল্টার দেখছি না। কোনো বাংকার নাই। তারপরে কোনো ট্রেঞ্চ নাই যে সেখানে আমি নিজে আত্মরক্ষা করবো।। আমি যখন এই সমস্ত চিন্তা করছি তখন দেখলাম যে আমার আশে পাশে কেউ নাই। প্রত্যেকেই যার যার শেল্টার যে যেদিকে পেরেছে নিয়েছে। তারপরে এক দৌড়ে আমি কতটুকু গেলাম মনে হয় হাফ মাইল হবে। যেয়ে আমি মাটিতে পড়ে গেলাম। পড়ে যেয়ে দেখি যে,ঠিক যেখানে পড়েছি তার পাশে একটা পাহাড়ের গুহা। সেই গুহার মধ্যে দেখলাম আমাদের ডা: মহসীন,কাইয়ুম ভাই-এখন উনি জুট রিসার্চে আছেন এসপিও হিসাবে এবং আরও কয়েকজনকে। উনারা তাড়াতাড়ি আমাকে টেনে গুহার ভিতরে ঢুকিয়ে ফেললেন। এই সময় হঠাৎ করে একজন জোয়ান দৌড়ে আসলো,বললো যে ডাক্তার সাহেব কোথায়? ডাক্তার সাহেব কোথায়? আমি বললাম যে কি হইছে ভাই? সে বললো যে কর্নেল খালেদ মোশাররফ উনডেড,তাড়াতাড়ি আসেন। উনাকে ফাস্ট এইড দিতে হবে। যখন শুনলাম যে আমাদের কমান্ডিং ইন চীফই উনডেড তখন নিজের জীবনের আর মায়া টায়া থাকলো না। তখন আমি আর মহসীন ভাই দুইজনে বেরিয়ে গেলাম। শেলিং তখন বোধহয় একটু কমে আসছে। আমরা এই শেলিং-এর ভিতর দিয়া আবার ক্যাম্পের দিকে গেলাম অর্থাৎ বিএসএফ ক্যাম্পের দিকে। যেয়ে দেখি যে আইনউদ্দিন সাহেব কর্নেল সাহেবকে ধরে নিয়া আসতেছেন এবং কর্নেল সাহেবের মাথায় একটা গামছা বাঁধা। আমরা যেয়ে ধরলাম উনাকে। দেখলাম যে উনি বেশ স্বাভাবিক। কর্নেল সাহেবের মাথায় আঘাত লেগেছে। উনাকে দেখলাম যে যুদ্ধের ময়দানে একজন সেনা নায়কের যেরকম অভিব্যক্তি উনারও তাই ছিল। উনি এইটাকে কোনো পাত্তা দিচ্ছেন না। উনার মাথা ফেটে গেছে তারপরও উনি স্বাভাবিক ভঙ্গিতে কথাবার্তা বলছেন। বলে হাঁ একটু মাথায় লেগেছে। আমরা দুইজন একটু চেক করলাম। উনার ব্যান্ডেজটা আরও ভালো করে,সুন্দর করে বেঁধে দিলাম। তারপর দেখলাম যে ব্লিডিং এখনও হচ্ছে কিনা। তখন দেখলাম ব্লিডিং আর হচ্ছে না। আমরা নিশ্চিত হলাম যে উনার ব্লিডিং আর নাই। যুদ্ধক্ষেত্রে আমাদের প্রথম কাজ ছিল ব্লিডিং বন্ধ করা।
প্র: খালেদ মোশাররফ কোন এরিয়ার ভেতরে উনডেড হলেন,ভারতে না বাংলাদেশে?
উ: বি.এস.এফ ক্যাম্পতো ভারতে। বি.এস.এফ ক্যাম্পের ভিতরে ভারতের ভূমিতে উনি উনডেড হয়েছেন।
প্র: সেটা কি পাকিস্তানি শেলিং-এর আঘাতে?
উ: পাকিস্তানি শেলিং-এর আঘাতে অর্থাৎ ঐ সিপ্রন্টারের আঘাতে সিপ্রন্টার এসে উনার মাথার সামনে আঘাত করে এবং এতে উনার মাথা ফেটে যায়। মাথা ফেটে ব্রেইনে টাচ করেছে। আমরা ফার্স্ট এইড দিলাম। এরপর উনাকে হাসপাতালে পাঠানোর জন্য মেজর আইনউদ্দিন সাহেব গাড়ি ডাকতে বললেন। গাড়িতে উনি উঠলেন। উনি উঠার পরে মহসীন সাহেবও গাড়িতে উঠলেন। উনি খালেদ মোশাররফ স্যারকে নিয়ে চলে গেলেন। এরমধ্যে একটু শেলিং কমে আসছে। আমরা আবার সংগঠিত হলাম। আমরা মেডিক্যাল টিমটাকে প্রায় আধা মাইল পিছনে এনে ওখানে রইলাম। এখানে যখন এভাবে অরগানাইজ করলাম তার কিছুক্ষণের মধ্যেই ক্যাপ্টেন সুজাত আলী সাহেবকে নিয়ে এসে হাজির। মনে হয় ধরাধরি করে নিয়ে আসছেন কারণ গাড়ি ছিল নাতো। নিয়া আসলো যে কে সেটা আমার ঠিক মনে নাই। ক্যাপ্টেন সাহেব উনডেড উনার পেটে সিপ্রন্টার ঢুকে গেছে। তখন আমি আর আমার সাথে সঙ্গী যারা ছিল-তারা সবাই মিলে উনার যাতে ব্লিডিং না হতে পারে সেরকমভাবে বেঁধে দিলাম। আমার মনে হয় উনার হাতে প্রথম লেগেছিল। হাতের থেইকা সিপ্রন্টারটা পেটে যেয়ে ঢুকেছিল। ফাস্ট এইড দেয়ার পরে উনাকে হাসপাতালে পাঠিয়ে দিলাম। তখন দেখি যে সকাল প্রায় ১১টা বাজে। আস্তে আস্তে সময় পার হয়ে গেছে। যা হউক,আমি লক্ষ্য করলাম যে আমাদের মুক্তিযোদ্ধারা মাইনের আঘাতে আহত অবস্হায় আসছে। যারা কসবা দখল করার জন্য গেছে পাকবাহিনীর মাইনের আঘাতে তাদের অনেকের পা বিধ্বস্ত হয়ে গেছে,ভেঙ্গে গেছে,হাত বিধ্বস্ত হয়েছে। এমন অবস্হায় বেশকিছু মুক্তিযোদ্ধাকে নিয়ে আসা হলো। বি.এস.এফ-এর গাড়িতে করে নিয়ে আসছে। সে এক বীভৎস দৃশ্য। সে দৃশ্য না দেখলে ভাবা যায় না। যে কোনো সাধারণ মানুষ এগুলা দেখলে অজ্ঞান হয়ে যাবার কথা। কারও পা নাই,পা উড়ে গেছে,পায়ের ওখানে শুধু স্কিনের সাথে পা-টা ঠেকে আছে। হাড্ডি একদম সব গুড়া হয়ে গেছে। এটার ফাস্ট এইড হলো আমরা শুধু প্রেসার ব্যান্ডেজ দিয়ে বেধে দিই। আর ঔষধ-ওখানে কি ঔষধ দিব? এভাবে তাদেরকে আমরা ব্যান্ডেজ করে শুধু ব্লিডিংটা বন্ধ করে হাসপাতালে পাঠিয়ে দিলাম। আবার দেখলাম যে কিছুক্ষণ পরে কিছু বি.এস.এফ আসলো। বি.এস.এফ জোয়ানরা কিন্তু অনেকে উনডেড হইছে। উনাদেরকেও ফাস্ট এইড দিলাম। দিয়ে পাঠিয়ে দিলাম হাসপাতালে। আস্তে আস্তে শেলিং বন্ধ হয়ে গেল। দুপুর প্রায় ১২টার মতো হয়ে গেল। আমাদের অপারেশন শেষ। এই কসবা অপারেশনের কথাটা আমার খুব মনে থাকবে যে এইখানে আমি অ্যাকচুয়েলি মৃত্যুকে খুব কাছ থেকে দেখেছি। এইখানে অনেকে মারা গেছে।
প্র: আমাদের মুক্তিযোদ্ধারা কসবা আক্রমণ করে কতক্ষণ ধরে রাখতে পেরেছিল?
উ: কতক্ষণ ধরে রাখতে পেরেছিল? আইনউদ্দিন সাহেব অ্যাকুরেটলি বলতে পারবেন,আমিতো অতটুকু পারবো না। আমরা যেহেতু রিয়ারে ছিলাম। আমার মনে হয় অ্যাটাকতো শুরু হলো। সকাল ৫টা বা সাড়ে ৫টার দিকে। এই যুদ্ধে কসবা পুরান বাজার আমরা দখল করে নিয়েছি। আমার যতটুকু মনে পড়ে। পুরাণ বাজার এলাকাটা আমরা ধরেই রেখেছিলাম এবং পাকবাহিনী নতুন বাজারে চলে গেছিল।
প্র: এর পরের ঘটনা বলুন?
উ: আমার মুক্তিযুদ্ধ লাইফ শুরু হলো জুনের শেষের দিকে। এরমধ্যে জুলাই,আগস্ট,সেপ্টেম্বর এবং অক্টোবর চারমাস হয়ে গেল। এসময় আমি খুব ক্লান্ত হয়ে পড়ি। তখন আমি অসুস্হ হয়ে পড়েছিলাম। আমি কয়েক দিনের জন্য অন্যত্র যেতে চাইলাম একটু পরিবর্তনের জন্য। কমান্ডিং অফিসার বললেন যে ঠিক আছে তুমি যদি পরিবর্তনে এ যাও তাহলে তুমি বিশ্রামগঞ্জে যেয়ে ঘুরে আস। বিশ্রামগঞ্জ হাসপাতাল আছে। বিশ্রামগঞ্জ হাসপাতালে তুমি চাইলে কাজ করতে পার,অথবা বিশ্রাম নিতে পার। তারপর আমি ওখানে গেলাম। ওখানে গিয়ে বেশ কয়েকদিন ছিলাম। সেখানে দেখলাম ক্যাপ্টেন সিতারাকে,সে মেজর হায়দার সাহেবের বোন। তিনি সেখানে একজন ডাক্তার ছিলেন। তারপরে ক্যাপ্টেন আখতার আহমেদ উনি ওখানকার ডাক্তার। বিশ্রামগঞ্জ হাসপাতালটা ডা: মবিন ইউএসএ থেকে যন্ত্রপাতি নিয়ে এসে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। আর ওখানে নার্সিং সার্ভিস দিত ঢাকা ইউনির্ভাসিটির কয়েকজন মেয়ে-সুলতানা কামাল,সাইদা কামাল-কবি সুফিয়া কামালের মেয়ে,মিশুল বিল্লাহ তারপরে পদ্মা রহমান,জাকিয়া আপা-উনি ইডেন কলেজের শিক্ষিকা ছিলেন। আরও ছিল টুলু,নীলিমা,অনুপম,লুলু,খুকু আহমেদ। খুকু আহমেদ ছিলেন মেজর আখতার সাহেবের ওয়াইফ। তারপরে ছিলেন প্রকৌশলী মাহবুব আলম,রেশমা,মিনু,আসমা,তাজুল ইসলাম,ডাক্তার কিরণ-এরা ছিল।
প্র: আচ্ছা,এই ফিল্ড হসপিটালে গিয়ে তার ব্যবস্হাপনা কি রকম দেখলেন?
উ: আমিতো অল্প সময় সেখানে ছিলাম। সেখানে একটা ওটি ছিল। ওটি তে আমি যেয়ে দেখেছি প্রচুর যন্ত্রপাতি সেখানে ছিল। মবিন ভাই এবং অন্যান্যরা সাপ্লাই দিয়েছেন। জাফরুল্লাহ চৌধুরী এটার অরগানাইজার ছিলেন। ব্যবস্হা যা ছিল ফিল্ড হসপিটাল হিসাবে আমি বলবো যে এটা আমাদের বেশ প্রয়োজন মিটিয়েছে। প্রচুর রোগী আসতো। বেডগুলো সবই বাঁশ দিয়ে তৈরি,মাচা করেছিল। বেশিরভাগ রোগী আসতো ডিসেন্ট্রির রোগী। ক্যাপ্টেন সিতারাকে দেখেছি মেক্সাফরম ট্যাবলঠে দিয়ে চিকিৎসা করছেন। অবশ্য আরও অন্যান্য এন্টিবায়োটিক ঔষধ ব্যবহার করা হত। তবে ঔষদের বোধহয় স্বল্পতা ছিল। আমার যতটুকু মনে পড়ে ক্যাপ্টেন সিতারা বলতেন যে ঔষধ আরও দরকার বা ঔষধ কম। যাইহোক,ওখানে আমি কিছুদিন কাটানোর পরে আবার আমাকে ফোর্থ বেঙ্গল রেজিমেন্টে যেতে অর্ডার দেওয়া হলো।
এরপরে আমি ফোর্থ বেঙ্গল রেজিমেন্টে গেলাম। তারিখটা হলো ১০ নভেম্বর। ১০ নভেম্বর ১৯৭১-এ ভারতীয় এলাকা কোনাবনে ডাক্তার হিসাবে এলাম। এই কোনাবনে থাকাকালীন ২০শে নভেম্বর আমার আব্বা আমাকে অনেক ক্যাম্পে খুঁজতে খুঁজতে এখানে এসে আমাকে পান। আব্বাকে পেয়ে আনন্দে আমার বুক ভরে গেল। দেশের খবর নিলাম। মা,ভাই-বোনদের খবর নিলাম। কিন্তু বজ্রাঘাতের মতো যে সংবাদটি পেলাম তা হলো শহীদ ভাই যিনি আমাকে ইন্ডিয়া নিয়ে গিয়েছিলেন তার মৃত্যুর খবর। আমাদের গ্রামের এলাকায় যুদ্ধ করাকালীন সময়ে তার বুকে গুলিবিদ্ধ হয়ে তিনি শহীদ হন। অনেকক্ষণ কাঁদলাম শহীদভাই এর বিভিন্ন স্মৃতি মনে করে। আব্বা সান্ত্বনা দিলেন। মনে হলো এভাবে একদিন আমিও মরে যাব। যা হোক,কিছুদিন পর সালদা নদীর উল্টাদিকে মুক্ত এলাকা সাগরতলায় এলাম। মনটা এইখানে খুব খুশি লাগলো যে মুক্ত এলাকায় এসেছি। এতদিন ছিলাম ইন্ডিয়াতে। এবার মুক্ত এলাকায় আসলাম। এইখানে কমান্ডিং অফিসার ছিলেন ক্যাপ্টেন গাফফার।
সালদা নদীতে এসে আমি জয়েন করার কিছুদিন পরেই যুদ্ধ হলো,সালদা নদী যুদ্ধ। তারিখটা এখন বলতে পারবো না। তবে নভেম্বর মাসের মাঝামাঝি হবে। সালদা নদী দখল হলো ক্যাপ্টেন গাফফারের নেতৃত্বে। এর আগে কিন্তু সালদা নদী দখল করার জন্য কর্নেল খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বে ব্রিগেড অ্যাটাক করেও এই সালদা নদী দখল করতে পারে নাই। পাকিস্তানিদের এত শক্ত ঘাঁটি ছিল সেটা। যাই হউক,নভেম্বর মাসে ক্যাপ্টেন গাফফারের নেতৃত্বে নাটকীয়ভাবে ব্যতিক্রমধর্মী আক্রমণ করে সালদা নদী উনি দখল করলেন। সাধারণত অ্যাটাক হয়ে রাত্রে যখন মানুষ ঘুমে থাকে বা অপ্রস্তুত থাকে। কিন্তু এই অ্যাটাকটা হয়েছিল একেবারে সকাল দশটার দিকে। সালদা নদী দখল হওয়ার পরে আমরা সালদা নদী দেখতে গেলাম। দেখলাম যে ওদের যে বাংকার চিন্তা করা যায় না কত স্ট্রং। উপরে ঘরের চাল,টিনের চাল। টিনের চালের নিচে কাঠ দিয়ে কাঠের উপরে চুন সুরকি দিয়ে পাকা করে বাংকার করেছে। এগুলা অ্যাকচুয়েলি শেলিং-এ কিছু করা যায় না। অ্যাটাকটা হয়েছে সম্পূর্ণ অপ্রস্তুত অবস্হায়। এটা বোধহয় রমজান মাস ছিল আমার যতটুকু মনে পড়ে। রমজান মাসে সাধারণত সেহেরি খেয়ে ঘুম দিয়েছে এই সময় অ্যাটাকটা হয়েছে। আর পাক বাহিনী মোরালি ডাউন হয়েছিল। যার ফলে ক্যাপ্টেন গাফফার সুন্দরভাবে এই বিজয়টা ছিনিয়ে নিতে পেরেছিলেন।
এরমধ্যে আখাউড়াতে প্রচণ্ড যুদ্ধ শুরু হলো। আমরা তখনও সালদা নদী এলাকা দখলে রেখে সেখানে অবস্হান করছি। ডিসেম্বরের প্রথম দিকে সম্ববত ৩রা অথবা ৪ঠা ডিসেম্বর হবে আমাদেরকে নির্দেশ দেয়া হলো যে তোমরা চট্টগ্রামের দিকে অগ্রসর হও। আমরা আবার আমাদের পুরা কনভয় নিয়ে ফেনীর বেলুনিয়া,বেলুনিয়া থেকে ছাগলনাইয়া গেলাম। সেখান থেকে সম্ভবত ৬ই ডিসেম্বর ফেনী দখল করলাম। ৮ই ডিসেম্বর শুভপুর ব্রিজ অতিক্রম করলাম। আমরা ছাগলনাইয়াতে এক রাত্র ছিলাম। এরপরে রামগড়ে গেলাম। ওখানেও জায়গায় জায়গায় আমরা ক্যাম্প করেছি। থেকেছি দু-একদিন করে। রামগড় সীমান্ত দিয়ে ঢুকে ৯ই ডিসেম্বর ফটিকছড়ি যেয়ে আমরা ক্যাম্প করলাম। কয়েকদিন ছিলাম ফকিটছড়িতে। ফটিকছড়ি থেকে পরে আমরা নাজিরহাট গেলাম। নাজিরহাটে যেয়ে আমাদের সাথে পাকবাহিনীর আবার একটা ফেস টু ফেস মোকাবেলা হলো। অতঃপর ১০ বা ১১ই ডিসেম্বর নাজিরহাট আমরা দখল করতে পারলাম। ক্যাপ্টেন গাফফার সাহেবের নেতৃত্বে নাজিরহাট দখল হলো। নাজিরহাট অবস্হান কালীন সময়েই বোধহয় ১৬ তারিখে দেশ স্বাধীন হয়ে গেল।
প্র: একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে আপনি আগরতলাতে দীর্ঘসময় ছিলেন। আগরতলাতে যারা আমাদের মুক্তিযোদ্ধা এবং শরণার্থী ছিল এদের ব্যাপারে আগরতলার সাধারণ মানুষের মনোভাব কি ছিল? সাধারণ মানুষ তাদের জন্য কি করেছে?
উ: এইটা খুব ভালো প্রশ্ন। আমি আশ্চর্য হয়ে যাই যে আমরা এত মানুষ বাংলাদেশ থেকে আগরতলায় গিয়েছি। আমরা প্রথম শরণার্থী হিসাবে যে শিবিরে যাই সেটা হইল রাধানগর। সেই রাধানগরে যেয়ে ভারতীয় যেসব হিন্দুর দোকানে বসে চা নাস্তা খেয়েছি,কথাবার্তা বলেছি তারা সবাই এত কোঅপারেটিভ ছিল যে আমার চিন্তায় আসে না। আমরা যদিও বিদেশী কিন্তুআমাদের সাথে তারা যেভাবে ব্যবহার করেছিল সেটা মনে হয় আমরা তাদের অনেক অনেক দিনের পরিচিত,অনেক আপন জন। আমাদেরকে তারা সহানুভূতির চোখে দেখতো। পরে আগরতলাতে যখন আমরা গিয়েছি বা আগরতলা ক্যাম্পে যখন মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে থেকেছি তখন ভারতীয় লোকদের কাছ থেকে যে সহানুভূতি পেয়েছি তা আজও ভুলতে পারি না। উদাহরণ স্বরূপ বলতে পারে যে আমিতো ছাত্র ছিলাম,মেডিক্যাল স্টুডেন্ট। আমি তখন চিকিৎসা সম্পর্কে ভালো জানতাম না। কিন্তু যখনই প্রয়োজন হত আমি আগরতলা হাসপাতালে যেয়ে তখন আমার সেই ডাক্তার সাহেবের নাম মনে নাই ডাক্তার চৌধুরী হবে বোধহয় উনি আমাকে হেলপ করতেন। উনার মামার বাড়ি ছিল ব্রাহ্মণবাড়িয়াতে। ঐ ডাক্তার সাহেব আমাকে মিকচার তৈরি করা শিখিয়ে দিলেন। উনি বিন্দুমাত্র বিরক্ত হতেন না। উনি বলতেন যখনই আপনি সমস্যায় পড়বেন তখনই চলে আসবেন। আমার ডায়েরিতে লেখা আছে বিভিন্ন মিকচারের নাম। অনেকগুলো মিকচার,এত মিকচার বাংলাদেশের ডাক্তাররাও বোধহয় ব্যবহার করে নাই। কিন্তু উনি আমাকে লিখে দিয়েছেন নিজ হাতে। ইনফ্লুয়েঞ্জা,এজমা,কারমিনেটিব মিকচার-এগুলা সব উনি নিজ হাতে লিখে দিয়েছেন। যখনই যেতাম বলতেন যে কোনো সমস্যা হলে আপনি চলে আসবেন। আমি আপনাকে শিখিয়ে দিব।
আমি মাসে দেড়শ টাকা করে ভাতা পেতাম। আমি মাস শেষে যেতাম এবং আমার ভাতা পেতে কোনো ভোগান্তি হতো না। যাওয়া মাত্র আমি টাকাটা পেয়ে যেতাম। যেতে পারি নাই বলে নভেম্বর-ডিসেম্বর-এই দুই মাসের টাকা আমি পাই নাই। কিন্তু আমি যখনই গিয়েছি তারা সহযোগিতা করেছে। অনেক সময় রাত্রবেলা আমি ওদের কাছে যেতাম। এক রোগীর এপেনডিসাইটিস হয়েছিল এবং নরসিংগড় থেকে আমি জিপে করে অনেক রাতে তাকে হাসপাতালে নিয়ে গেছি। সেখানেও দেখেছি যে আমার রোগীকে তারা মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে যথেস্ট সম্মান দেখিয়ে তাকে চিকিৎসা করেছে। আমাদের মুক্তিযোদ্ধা যারা অসুস্হ অবস্হায় হাসপাতালে যেত তাদের প্রতি খুব ভালো ব্যবহার করা হতো এবং তাদের চিকিৎসা করা হতো যথেষ্ট সহানুভূতি সহকারে। আমার মনে আছে যে কসবা যুদ্ধে আমাদের যে এম.পি ক্যাপ্টেন সুজাত আলী সাহেব যখন উনডেড হলেন তখন উনাকে আমরা আগরতলা ভিক্টোরিয়া হাসপাতালে পাঠিয়ে দিয়েছিলাম। সেখানে আমি পরে যেয়ে দেখেছি যে উনাকে ওরা চিকিৎসা করছে যত্ন সহকারে। তারপরে কয়েকটা ফ্যামিলির কথা আমার মনে আছে। রমেশ বাবু বলে এক ভদ্র লোক ছিলেন। রমেশ বাবুর পুরা ফ্যামিলি আমাদেরকে দাওয়াত দিয়ে এনে তাদের বাড়িতে খাইয়েছেন। রমেশ বাবুর ছেলেমেয়েরা এসে আমাদের কোনো হেলপ লাগতে পারে কিনা তারা সে খবর নিয়েছে। রমেশ বাবু নিজেও আসতেন। তারপরে আগরতলা এয়ারপোর্টের কাছে আরেকটা ফ্যামিলি তাদের নাম আমার মনে নাই। সেই ফ্যামিলিতে আমাদের আদর-আপ্যায়ন করেছে। তারপরে আজকে যে জেনারেল হারুন সাহেব এবং আমার বন্ধু বান্ধব তাদেরকে দাওয়াত দিয়ে তারা খাইয়েছে। এখনও মনে পড়ে যে উনার বাড়িতে আমরা মাটিতে বসে সে বিরাট কাসার থালায় হিন্দুয়ানি স্টাইলে আমাদেরকে খেতে দিয়েছিলেন। তাদের আতিয়েতা এবং তাদের আন্তরিকতা এত ছিল যে মনে হতো আমরা তাদের পরিবারের সদস্য। আমরা যে মুসলমান,তারা যে হিন্দু এই জিনিসটা আমাদের অনুভূতিতে আসে নাই। তারা এমন আচরণ করেছে যে আমাদের কালচারাল যে একটা দূরত্ব সেইটাও উনারা রাখে নাই। আমাদের প্রতি তাদের সহানুভূতি বা আন্তরিকতা বেশি ছিল বলেই এটা হয়েছে। আমি ভারতে যাওয়ার পরে যে কয়দিন ছিলাম,আমি বলতে পারি যে ওদের আচরণ একেবারে মনে হয়েছে আমরা যেন ওদের আপনজন।
প্র: মেডিক্যাল কোরের মেম্বার হিসাবে আপনি যুদ্ধ করেছেন সরাসরি উর্ধ্বতন সামরিক অফিসারদের সাথে। যাদের সাথে যুদ্ধ করেছেন এদের সম্পর্কে একটু মূল্যায়ণ করবেন? কর্নেল খালেদ মোশাররফ,ক্যাপ্টেন গাফফার, ক্যাপ্টেন সুজাত আলী বা আরও যাদের সান্নিধ্যে আপনি এসেছিলেন?
উ: আমি প্রথম ছিলাম আজকের মেজর জেনারেল হারুন সাহেবের সাথে। উনি ছিলেন লেফটেন্যান্ট। উনি যোদ্ধা হিসাবে মুক্তিযুদ্ধের যে বিভিন্ন অভিযানগুলো পরিচালনা করেছেন সেগুলি নৈপুন্যের সাথেই করেছিলেন। যেমন-নরসিংগড়ে,সিঙ্গারবিলে। একদিন সকালবেলায় একটা অপারেশন হলো এবং সেখানে পাকিস্তানি বাংকারে যেয়ে চার্জ করে কয়েকজন পাকিস্তানিকে জীবিত ধরে এনেছিলেন এবং কয়েকজন মারা গেছিল। সেখানে আমি দেখেছি যে যথেস্ট সাহসী ভূমিকা উনি পালন করেছেন। তাঁর দলের সদস্য যারা ছিল তাদের প্রতি তিনি সঠিক নেতৃত্ব দিতে পেরেছিলেন। আইনউদ্দিন সাহেবের সাথে মনতলাতে আমি পরিচিত হই। আমি তখন ছিলাম সিংগারবিলে। তখন ঐ এলাকায় তিনি মাঝে মাঝে আসতেন দেখতাম। আর ঐ মনতলা থেকে যুদ্ধের যে নেতৃত্ব দেওয়া সেটাতো আমি মনে করি যথেষ্ট দক্ষতার সাথে উনি দিতেন। কসবা যুদ্ধের সময় খালেদ মোশাররফ সাহেবের মনোবল আইনউদ্দিন সাহেবের মনোবল ছিল দৃঢ়। খালেদ মোশাররফ সাহেব উনডেড হওয়ার পর যখন আইনউদ্দিন সাহেব তাঁকে ধরে ঐ ক্যাম্প থেকে নিচে নামিয়ে নিয়ে আসছেন তখন খালেদ মোশাররফ সাহেবের দিকে তাকিয়ে দেখলাম যে যদিও উনার মাথা ফেটে গেছে,মাথা একটা গামছা দিয়ে বাঁধা কিন্তু তারপরও উনার এক্সপ্রেশান স্বাভাবিক। উনি কমান্ড দিয়ে যাচ্ছেন যেন কোনো কিছু হয নাই। আইনউদ্দিন সাহেব যাতে ঠিকমত যুদ্ধ পরিচালনা করেন সেভাবেই তিনি নির্দেশ দিয়ে যাচ্ছেন। আইনউদ্দিন সাহেবও যখন শেলিং চলছিল তখন সেই শেলিং-এর মধ্যে দিয়ে উনি ফিল্ডে যেতেন অদম্য সাহস নিয়েই। সালদা নদী যুদ্ধে যেভাবে সালদা নদীতে পাকিস্তান বাহিনীকে হারিয়ে দিয়েছিলেন সেটা তাঁর অদম্য সাহসের জন্যই হয়েছে। আমি নিজেকে দিয়ে বলি যে জীবনের মায়াতো ছিল না। নিজের জীবনের মায়া যদি থাকতো তাহলেতো মুক্তিযুদ্ধে আসতাম না। কাজেই ঐ রকম একটা মনোবল আমাদের ভিতর ছিল এবং আমাদের ভিতরে এটা কাজ করেছে। সমর নায়কদের ভিতরেও এটা কাজ করেছে। ঐ তিন জনকে আমি কাছ থেকে দেখেছি এবং আমি বলবো যে তাঁরা তখন যে নেতৃত্ব দিয়েছেন উপযুক্ত নেতৃত্বই দিয়েছেন।