বাংলাদেশের মীরজাফর
মৃতের শহর ঢাকা। মাটির সঙ্গে মিশে গেছে অধিকাংশ ঘরবাড়ি। আকাশে উড়ছে শকুনি আর পাক জঙ্গী বিমান। খােলা মাঠে জল্লাদরা খুড়ছে বিশাল কবর। ঘুমুচ্ছেন সেখানে হাজার হাজার নারী পুরুষ এবং শিশু। যাদের ভাগ্যে মাটি জোটে নি তাদের শব পঁচছে রাস্তায়। বুড়িগঙ্গার জলে ভাসছে অসংখ্য মৃতদেহ। পশ্চিমা সৈন্যরা মাঝে মাঝে শিকারে বেরয়। স্তব্ধ পরিসরের মধ্যে মানুষ পাওয়া মুশকিল। সব ছেড়ে গ্রামাঞ্চলে পালিয়ে গেছেন তারা। বেশীদূর এগুবার সাহস পায় না পশ্চিমা নেকড়ের দল। গেলে তাড়া করেন মুক্তিযােদ্ধারা। ইয়াহিয়ার ভাড়াটিয়া নুরুল আমিনের। পাক বেতারে তার নির্লজ্জ ভাষণে ঘৃণায় মুখ বিকৃত করেছেন বাঙালী। যারা বাঙলাদেশে চালাচ্ছে গণহত্যা তাদের বেয়নেটের আড়ালে দাঁড়িয়ে হুঙ্কার ছেড়েছেন নুরুল। তার অভিযােগ পাকিস্তানের আভ্যন্তরীণ সমস্যায় হস্তক্ষেপ করছে ভারত। ঢাকা থেকে সুদুর সীমান্ত পর্যন্ত তার দৃষ্টি প্রসারিত। তিনি কি তার পায়ের নীচে রক্ত পিছল পথ দেখতে পাচ্ছেন না? ইয়াহিয়ার নারকীয় তান্ডবের উল্লেখ নেই কেন তার বেতার বক্তৃতায়? মীরজাফরের প্রকৃতি আলাদা। সত্য, সমাজ, দেশপ্রেম এবং আত্মমর্যাদা-সব মিথ্যা। একমাত্র সার কথা ক্ষমতা। যে ক্ষমতা দিতে পারবে তার পদলেহন। বিশ্বাসঘাতকদের চিরাচরিত অভ্যাস।
নুরুল আমিনের জিহ্বায় রয়েছে রক্তের স্বাদ। ভাষা আন্দোলনের সময় তিনি ছিলেন পূর্ব বাংলার মুখ্যমন্ত্রী। তাঁর হুকুমেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে সেদিন চলেছিল ছাত্র হনন। ইয়াহিয়া আজ এই বৃদ্ধ শয়তানের কপালে এঁকে দিয়েছেন বাঙালীর দেহ ক্ষরিত রক্ততিলক। এই কলঙ্ক চিহ্ন কপালে নিয়ে উধ্ববাহু হয়ে নাচছেন নির্বোধ নুরুল আমিন। ভাবছেন, পশ্চিমাদের অপঘাতে মরবে বাঙালী। তাদের কবরের উপর মসনদ বানাবেন ইয়াহিয়া খান। আর তার উপর বসবেন সাঙ্গোপাঙ্গোরাসহ নবাব মীরজাফর। তার মাথায় নিরাপত্তার ছত্র ধরবেন কুচক্রী ভুট্টো। একটি জাতির মুক্তি সংগ্রামে একাধিক জাতিদ্রোহীর আবির্ভাব নূতন নয়। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় জার্মানি পদনত ইউরােপে জন্ম নিয়েছিল অসংখ্য কুইসলিং। তাতে মুক্তি সংগ্রামের জয় হল্লায় ছেদ পড়েনি। বাঙলাদেশের মীরজাফর নুরুল আমিন একা নন। দুচারজন মুসলীম লীগ প্রার্থী যােগ দিয়েছেন তাঁর সঙ্গে। ওরাই মুক্তিযােদ্ধাদের গােপন সংবাদ পাচার করছেন দখলদার পশ্চিমা বাহিনীর কাছে। তাতে কিছু আসে যায় না। সাড়ে সাত কোটি মানুষের মধ্যে দুচারজন কুলাঙ্গার ইতিহাসের গতি পিছনে টেনে রাখতে পারে না। কে এই নুরুল আমিন? মুসলীম লীগের প্রাক্তন নেতা। গণতন্ত্রের প্রচণ্ড জোয়ারে সাম্প্রদায়িক প্রতিষ্ঠান মুসনিম লীগের ভরাডুবির পর ভােল পাল্টিয়েছেন তিনি। পাকিস্তান ডেমােক্র্যাটিক পার্টির নেতা হিসাবে সম্প্রতি নির্বাচিত হয়েছিলেন পাক-জাতীয় পরিষদে। সেখানে তিনি একা। মুখ থুবড়ে পড়ে গেলে হাত ধরে টেনে তােলার জন্য নেই কোন দ্বিতীয় সমর্থক। মুজিবর রহমানের দুর্বার সংগ্রামের প্রতিবন্ধক হিসাবে ইয়াহিয়া বেছে নিয়েছেন এই অথর্বকে। নুরুল আমিনের জানা উচিত, বাঙলাদেশে মীরজাফরের যুগ শেষ হয়েছে। শত চেষ্টাতেও ইয়াহিয়া খান পুরােনাে যুগের পুনরাবির্ভাব ঘটাতে পারবে না।
ভারত এখন পর্যন্ত বাঙলাদেশের ঘটনাস্রোতে নৌকা ভাসায়নি। মানবতার খাতিরে যতটুকু করা দরকার ততটুকুই করে যাচ্ছে মাত্র। বাঙলাদেশের রক্তস্রোত সীমান্তের বাধা মানছে না। বিশ্বের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছে তার বীভৎস কাহিনী। সােভিয়েট রাশিয়া চঞ্চল। আমেরিকার নীরবতা তােঙ্গে পড়ার উপক্রম। প্রতিবেশী ভারত নিশ্ৰুপ বসে থাকতে পারবে না। স্বাধীন বাঙলাদেশের সরকারকে স্মীকৃতি দিতেই হবে। এটা ভারতের কোটি কোটি মানুষের দাবী। এ দাবী অগ্রাহ্য করা কোন গণতন্ত্রী সরকারের পক্ষে সম্ভব নয়। প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি গান্ধী উপযুক্ত পরিবেশের জন্য অপেক্ষা করছেন। দুদিন আগেই হােক, আর পরেই হােক চরম মুহূর্ত আসবে। বাঙলাদেশের যে মানুষগুলােকে বুলেটের ঘায়ে ঠাণ্ডা করতে পারলেন না ইয়াহিয়া খান, তাদের শাসন করবেন পশ্চিমের শিখন্ডী নুরুল আমিন। বেয়াকুবের বেহস্ত তৈরীর স্বপ্নে মশগুল হয়ে পড়ছেন পশ্চিমা পদলেহী বাঙালী সারমের। নুরুল আমিন সাবধান। দুনিয়ার কোন মীরজাফর ইতিহাসের পদাঘাত থেকে রেহাই পায় নি। বাঙলাদেশে যে যুগে চলছে তা মুক্তির যুগ। প্রতি ধুলিকণায় রয়েছে তার রক্ত স্বাক্ষর। আধুনিক মীরজাফরদের জাতির কণ্ঠের সঙ্গে তিনি যদি কণ্ঠ মিলাতে না পারেন এবং জয় বাঙলা ধ্বনি তুলতে তার জিহ্বা যদি আড়ষ্ট হয়ে আসে তবে তার পরিণাম—গণ-আদালতে উপযুক্ত বিচার। এ বিচারের নিশ্চিত রায়—মৃত্যু।
সূত্র: দৈনিক যুগান্তর, ৭ এপ্রিল ১৯৭১