You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.04.21 | মতান্ধতার পরিণতি | কালান্তর - সংগ্রামের নোটবুক

মতান্ধতার পরিণতি

সিপিএম নেতা শ্রীনামুদিরিপাদের মৌলিকত্ব আছে, কাণ্ডজ্ঞান থাক আর নাই থাক, নিত্যনতুন তত্ত্ব ও রাজনীতি আবিষ্কারের তার খ্যাতি আছে। কোটায়ামে এক সাংবাদিক সম্মেলনে তিনি বলেছেন যে, জনগণের অধিকতর ক্ষমতা ও অর্থনৈতিক স্বয়ম্ভরতার দাবি উপেক্ষা করলে ভারতকেও পাকিস্তানের পরিণতির সম্মুখীন হতে হবে। শ্রীনামুদিরিপাদ বলবেন কী যে ওপার বাংলায় সাড়ে সাতকোটি মানুষ কি আজ অধিকতর ক্ষমতা ও অর্থনৈতিক স্বয়ম্ভরতার জন্য লড়ছে? ওপার বাংলার মানুষ যখন পাকিস্তান রাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কচ্ছেদ করে স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের জন্য সশস্ত্র লড়াই করছে এবং স্বাধীন সরকার প্রতিষ্ঠা করেছে, তখন তিনি বলছেন, বাংলাদেশের মানুষ নাকি অধিকতর ক্ষমতার জন্য লড়ছে। পাকিস্তান রাষ্ট্রের মধ্যে থেকে অধিকতর ক্ষমতার লড়াই যে কখন শেষ হয়ে গেছে তার খবরও বােধহয় শ্রীনামুদিরিপাদ রাখেন না। বাংলাদেশের স্বাধীন রাষ্ট্র বিশ্বের সকল রাষ্ট্রের কাছে যে কূটনৈতিক স্বীকৃতির জন্য আবেদন করেছেন সে খবরও বােধহয় তার কাছে পৌছায়নি। আহা! কী বিচিত্র রাজনীতি।
কেবল কি তাই? তিনি ভারত ও পাকিস্তান সরকারকে সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন যে, অনতিবিলম্বে রাজ্যসমূহের স্বায়ত্তশাসনের দাবি মেনে না নিলে এই সকল দেশেও বাংলাদেশের পুনরাবৃত্তি ঘটবে। স্বায়ত্তশাসনের দাবি তিনি কার কাছে করছেন? চলতি শাসকশ্রেণীর উপর তার এমন অগাধ বিশ্বাস যে তিনি দাবি করেই স্বায়ত্তশাসন আদায় করতে চান। অথচ লােকসভায় সংবিধান সংশােধন করে এ রাজ্যসমূহের সাংবিধানিক ও আর্থিক ক্ষমতা বৃদ্ধি করা সম্ভব এবং বিগত নির্বাচনে জনসাধারণ এ বিষয়ে সুস্পষ্ট রায় দিয়েছে, এদিকে মােটেই তাঁর নজর নেই। এটাও জনসাধারণর উপর আস্থার নজির বৈকি।
শ্রীনামুদিরিপাদ ভারতের রাজ্যসমূহের সঙ্গে ওপার বাংলাদেশকে এক পর্যায়ে ফেলেছেন। বাংলাদেশের জনগণের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক স্বাধীকার, এমনকি নির্বাচিত গণপরিষদ ও সংবিধান রচনার প্রচেষ্টাকে সামরিক শাসন গুলি, বেয়নেট ও গণহত্যার দ্বারা রােজই স্তব্ধ করার চেষ্টা করছে। আর ভারতের রাজ্যসমূহ একটা সংবিধানের দ্বারা পরিচালিত, তাদের নিজ নিজ সরকার গঠনের অধিকার আছে এবং স্বাধীকার প্রতিষ্ঠায় সগ্রামের স্বাধীনতা আছে। এই অধিকার কেড়ে নেয়া হয়েছে বলে বাংলাদেশ পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে স্বাধীনতা ঘােষণা করেছে। কিন্তু ভারতে রাজ্যসমূহের কেন্দ্র থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে স্বাধীনতা ঘােষণার প্রশ্ন অবাস্তব কেবল নয়, বিভেদমূলকও বটে। এখানে সংবিধান সংশােধন করে রাজ্যসমূহের স্বাধীকার সম্প্রসারণের প্রশ্নই হচ্ছে আসল সমস্যা। বাংলাদেশে ও ভারতের রাজ্যসমূহকে এক পর্যায়ভুক্ত করা কাণ্ডজ্ঞানহীন মতান্ধতার পরিচয়। এর সঙ্গে মার্কসবাদের কোনাে সম্পর্ক নেই। বলাবাহুল্য এটা বুদ্ধি-বিভ্রাটের লক্ষণ।
শ্রীনামুদিরিপাদ ভারত ও পাকিস্তান সরকারকেও সমপর্যায়ভুক্ত করে তত্ত্ববাগীশ সেজেছেন। সামরিক জোট ভুক্ত ও সামরিক একনায়কত্বের দ্বারা পরিচালিত পাকিস্তান সরকার হচ্ছে নয়া উপনিবেশবাদের বাহন। আর ভারত সরকার জাতীয় বুর্জোয়াদের প্রতিনিধি হয়েও সাম্রাজ্যবাদ ও নয়াউপনিবেশবাদ বিরােধী। এই কারণেই ভারত সরকার বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও স্বাধীকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামকে আন্তরিকভাবে সমর্থন করছেন। কেবল তা নয়, বিভিন্ন দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতি ভারত সরকারের সমর্থন সুবিদিত। উল্লেখ করা প্রয়ােজন যে, মাও-সে-তুং বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে পাকিস্তানের সমর নায়ক ইয়াহিয়াকে সমর্থন করছেন, আর ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী গান্ধী সমর্থন করছেন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে। এই মৌলিক পার্থক্যটা শ্রীনামুদিরিপদের মতান্ধ দৃষ্টির বহির্ভূত। তাই তার ‘মার্কসবাদী পার্টি ‘আমরা বাঙ্গালা’ ও ‘বিএনভিপি দলের মতাে স্লোগান তুলেছেন ইয়াহিয়া-ইন্দিরা এক হ্যায়, দুই বাংলার চেকপােস্ট উড়িয়ে দাও, পুড়িয়ে দাও দুই বাংলার এক নাম কেন্দ্রের বিরুদ্ধে সংগ্রাম।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে বিশ্বাসঘাতকতার এমন নজির আর কেউ উপস্থিত করেননি। শ্রীনামুদিরিপাদ এই বিশ্বাসঘাতকতাকে তত্ত্ব ও রাজনীতি দিয়েছেন। তিনি ও তাঁর পার্টি সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদকে মার্কসবাদ বলে গ্রহণ করেছেন।

সূত্র: কালান্তর
২১.৪.১৯৭১