You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.03.25 | ইয়াহিয়া খানের টালবাহানা | যুগান্তর - সংগ্রামের নোটবুক

ইয়াহিয়া খানের টালবাহানা

পাকিস্তান জাতীয় দিবস উদযাপিত হয় নি বাংলাদেশে। বাঙালীরা ওটাকে পরিণত করেছেন প্রতিরােধ দিবসে। পাঞ্জাবী শােষণের বিরুদ্ধে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে পূর্ব বাংলা। স্বাধীকারের দাবীতে চলছে সেখানে অহিংস অসহযােগ আন্দোলন। উত্তাল স্রোতের মুখে টাল সামলাতে পারেন নি ইয়াহিয়া খান। ঢাকায় বসে তিনি এখন বুড়িগঙ্গার তরঙ্গ লহরী গুনছেন। মুজিবরের সঙ্গে বসছে তার ঘন ঘন বৈঠক। জুটেছেন এসে ভুট্টো এবং পশ্চিম পাকিস্তানের আরও অনেক নেতা। দ্বিতীয়বার জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত রয়েছে অনিষ্টকালের জন্য। এবার ইয়াহিয়া আর একমেব অদ্বিতীয় নন, মজিবর এবং অন্যান্যের সঙ্গে পরামর্শ করেই তিনি এ সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। পাক জাতীয় দিবসের বেতার বক্তৃতা ইয়াহিয়া খান করেন নি। জাতির উদ্দেশ্যে দিয়েছেন তিনি এক বাণী। এ বাণীর ছত্রে ছত্রে ফুটে ওঠেছে ভন্ডামী। এক হাতে তিনি গণতন্ত্রের গলা টিপে ধরেছেন এবং অপর হাতে দিচ্ছেন অভয়। নিজে ভাল মানুষ সেজে রাজনৈতিক দলগুলােকে মিলে মিশে কাজ করার উপদেশ বর্ষণ করেছেন। এ চাতুরী বিদ্যা হয়ত তার রকেয়াশ্বেতাঙ্গ মনিবদের কাছে শেখা। উপনিবেশিক শাসক বিরােধী জাতীয়তাবাদী আন্দোলন বিপথগামী করার জন্য তারাও এ টেকনিক প্রয়ােগ করতেন। জাতীয় পরিষদে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাধিক্যের অধিকারী। সংবিধান রচনা এবং অসামরিক সরকার গঠনে তাদের প্রাধান্য অনস্বীকার্য। গণতন্ত্রের মৌলনীতি ইয়াহিয়া খান মানতে চান নি। তার ফলেই এসেছে বর্তমান সঙ্কট।
জাতীয় পরিষদে যযাগদানের শর্ত হিসাবে মজিবর করেছিলেন চার দফা দাবী। অবিলম্বে অস সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর এই দাবীগুলাের অন্যতম। মনে হয়, ইয়াহিয়া খান তাতে রাজী। কিন্তু এই ক্ষমতা হস্তান্তর হবে কার হাতে? ন্যায়নীতি অনুযায়ী তা হওয়া উচিত জাতীয় পরিষদের নিরঙ্কুশ সংখ্যাধিক দলের নেতা মুজিবরের হতে। সােজা পথে যাচ্ছেন না ইয়াহিয়া খান। তিনি চান রাজনৈতিক দলগুলাের ঐক্যমত। ইতিমধ্যেই ফোড়ন দিয়েছেন ভুট্টো সম্ভাব্য লােকায়ত্ত সরকারে তার দলের প্রতিনিধিত্ব চাই। যিনি মন্ত্রিসভা গঠন করবেন মন্ত্রী মনােনয়ন একমাত্র তারই এক্তিয়ার। সংখ্যালঘু দলনেতার আবদার মানতে তিনি বাধ্য নন। ভুট্টোর পিপলস পার্টিকে পাত্তা না দিয়ে মুজিবর যদি বেলুবিস্তান এবং উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের সংখ্যাগুরু দলনেতাদের নিয়ে মন্ত্রিসভা গঠন করেন তাতে আপত্তির কিছু নেই। সিন্ধু এবং পাঞ্জাব থেকে অন্য দলের প্রতিনিধিরাও মন্ত্রিসভায় আসতে পারেন। ভুট্টো তার পিপলস পার্টি নিয়ে থাকুন বিরােধী দলের ভূমিকায়। ছলচাতুরী ভূলতে পারছেন না ইয়াহিয়া খান। মুজিবরের সঙ্গে তাঁর কোন প্রাথমিক বােঝাপড়া হয়ে থাকলেও তার কোন চূড়ান্ত রূপ নেয় নি। ফলেই ওয়াকেফহাল মহলের বিশ্বাস। ভুট্টোর সম্মতির জন্য সব কিছু অপেক্ষা করছে। কৌশল সময় কাটাচ্ছেন ভুট্টো। তিনি করাচী যাবেন এবং আলাপ আলােচনা সেরে ঢাকা ফিরবেন। ভুট্টো ইয়াহিয়া হয়ত ভাবছেন, এভাবে বেশ কিছুদিন নষ্ট করতে পারলেই বঙ্গদেশের আন্দোলনে ভাটা পড়বে। তারপর তারা গুছিয়ে নিতে পারবেন।
বাঙালীরা বেকুব নন। তেইশ বছরের পশ্চিমা চালাকি তারা ধরে ফেলেছেন। অত্যন্ত সহনশীলতার পরিচয় দিচ্ছেন মুজিবর। তাঁর উপর জনতার চাপ সাংঘাতিক। বেশীদিন ভুট্টো-ইয়াহিয়ার টালবাহানা চলবে না। বঙ্গদেশের দাবী অতি পরিষ্কার। অবিলম্বে লােকায়ত্ত সরকার প্রতিষ্ঠা। আওয়ামী লীগের ছ’দফা দাবীর উপর ভবিষ্যৎ সংবিধানের ভিত্তি রচনা। জাতীয় পরিষদে সংখ্যাধিক্যের মতের উপর ভিটো দিতে পাবেন না ইয়াহিয়া খান। এই মৌলনীতি স্বীকৃত হবার পরই আসবে অন্যন্য সংখ্যলঘু দলের মদতের প্রশ্ন। এ দায়িত্ব থাকবে মুজিবরের উপর। ঢাকার আলােচনার প্রকৃতি দেখে মনে হয়, মৌল প্রশ্নের পাশ কাটিয়ে খুটিনাটি নিয়ে জল ঘােলা করছেন ইয়াহিয়া খান। ভুট্টে ভাবছেন, অখণ্ড পাকিস্তানের কথা। জিন্নার দোহাই দিয়ে ইয়াহিয়া খানও করেছেন তার প্রতিধ্বনি। অখণ্ড পাকিস্তান রাখার জন্য সংখ্যাধিক্যের মতামতে ভিটো দেবেন। পশ্চিমের ডিকটেটর ও সংখ্যালঘু জনতার নেতা ভুট্টো। এটা কি অখণ্ডত্ব রক্ষার আন্তরিক স্পৃহা, না গণতন্ত্রে জবাই? স্বাসত্বশাসন কার্যতঃ আদায় করে নিয়েছে বঙ্গদেশ। আসল প্রশ্ন কেন্দ্রীয় সরকারের প্রকৃতি নিয়ে। গণতন্ত্রের বড়াই মাঠে মারা যাবে। পাকিস্তানের অখণ্ডতু রক্ষা স্থায়ী ভিত্তি আওয়ামী লীগের ছ’দফা দাবী সম্বলিত ফরমূলা। ওখানে কারচুপির কোন সুযােগ নেই। বেশী চাতুরী করতে গেলে বঙ্গদেশ হয়ত বেরিয়ে আসবে। তারপর পশ্চিমাঞ্চলে শুরু হবে রাজ্যে রাজ্যে মারামারি। পাঞ্জাবী সৈন্যরা ঘটনাস্রোত রুখতে পারবে না। গােটা বঙ্গদেশে উড়ছে এখন বাঙালীর নিজস্ব পতাকা। শত শহীদের রক্তে এ পতাকার প্রাণ। প্রতিষ্ঠা। ভুট্টো, ইয়াহিয়া এবং পাঞ্জাবী সৈন্যরা স্পর্শ করতে পারবেন না বঙ্গদেশের বঙ্গদেশের গৌরব ধ্বজা। মিথ্যা কাল হরণ। অনিবার্যকে স্বীকার করুণ পাঞ্জাবী শাসকচক্র। নবযুগকে অভিনন্দন জানান। তা হলে রক্ষা পাবে না পাকিস্তান।

সূত্র: দৈনিক যুগান্তর, ২৫ মার্চ ১৯৭১