You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.03.13 | বাঙালী হত্যার সুযােগ ইয়াহিয়া পাবেন না | যুগান্তর - সংগ্রামের নোটবুক

বাঙালী হত্যার সুযােগ ইয়াহিয়া পাবেন না

কুম্ভকর্ণের দ্রিাভঙ্গ হয়েছে। ইয়াহিয়া খান জেগে উঠেছেন। লাহাের বিমান ঘাঁটিতে ভারতীয় বিমান পােড়ানাের তদন্তের ভার নেবেন। ঘটনাটি ঘটেছে গত তিরিশে জানুয়ারী। কাশ্মীরী বােম্বেটেরা পেয়েছে পিন্ডির আশ্রয়। পাক-বেতারের ভাষ্যে তারা মুক্তিযােদ্ধা। আকাশপথে বিমান ছিনতাই আন্তর্জাতিক অপরাধ । টোকিও কনভেনশন অনুযায়ী তারা শাস্তির যােগ্য। যে রাষ্ট্রে ছিনতাই বিমান নামানাে হয় সে-রাষ্ট্র কিম্বা যে রাষ্ট্রে বিমানটি রেজিস্ট্রীকৃত সে রাষ্ট্র বােম্বেটেদের বিচারের অধিকারী। আন্তর্জাতিক বিমান চলাচল সংস্থার এই নিয়ম। পাকিস্তান এ সংস্থার সদস্য। নিয়ম মানতে সে বাধ্য। ইসলামাবাদের সামরিক শাসকদল আত র্জাতিক বিধির ধারে কছে যান নি। পাক-পুলিশের চোখের সামনেই বােম্বেটেরা ভারতীয় বিমান পুড়িয়ে দিয়েছে। তার জন্য পাক কর্তৃপক্ষ বিন্দুমাত্র অনুতপ্ত ছিলেন না। বাধ্য হয়ে কেন্দ্রীয় সরকার ভারতীয় আকাশপথে পাকিস্তানের সামরিক এবং অসমারিক বিমান চলাচল নিষিদ্ধ করেছিলেন। তাতে সামরিক শাসকদের সম্বিত ফিরে নি। সিংহল ঘুরে তাদের বিমান পূর্ব বাংলায় যাতায়াত করছে। তাতে সমর লাগছে অনেক এবং অর্থব্যয় হচ্ছে প্রচুর।
ইতিমধ্যে পূর্ব বাংলার বাঙালীরা করেছেন বিদ্রোহ। ইয়াহিয়া খানের স্বৈরাচারী শাসনের বিরুদ্ধে চলছে। সেখানে অসহযােগ আন্দোলন। গণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা ওপারের বাঙালীর প্রধান লক্ষ। মুজিবর রহমান এবং তার আওয়ামী লীগ বঙ্গদেশে ইয়াহিয়ার শাসন অচল করে দিয়েছেন। গণসহযােগিতায় সেখানে চলছে বিকল্প শাসন। পাঞ্জাবী সৈন্যরা ক’দিন আগে চালিয়েছে গণহত্যা। ব্যারাক বসে এখন তারা অস্ত্রে শান দিচ্ছে। পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আরও সৈন্য এসে গেলেই আবার হয়ত শুরু হবে নরমেধ যজ্ঞ। জেনারেল টিক্কা খান এই চার দিনের জন্য অপেক্ষা করছেন। ইয়াহিয়া খানের সামনে দুটি মাত্র পথ খােলা মুজিবরের কাছে আত্মসমর্পন কিম্বা গণহত্যার পুনরারম্ভ। শেষের পথ নিতে হলে পূর্ব বাংলায় তাড়াতাড়ি আরও সৈন্য পাঠান দরকার। ভারতের আকাশপথ খােলা না পেলে পদে পদে অসুবিধা। তাই অকালে তাঁর নিদ্রাভঙ্গ হয়েছে। ঘটনাটি ঘটে যাবার প্রায় আড়াই মাস পরে তিনি তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন। বিমান ধ্বংসের বিষয়টি নিয়ে ভারতের সঙ্গে আলােচনা চালাতেও হয়ত তিনি রাজী হয়ে যাবেন। কিন্তু দিল্লীর সমস্যা জটিল। কেন্দ্রীয় সরকার বারবর বলছেন যে, বােম্বেটেদের শাস্তি ধ্বংসপ্রাপ্ত বিমানের ক্ষতিপূরণ এবং ভারতীয় বিমানের ভবিষ্যৎ নিরাপত্তার গ্যারান্টি ছাড়া পাক-সরকারের সঙ্গে কোন আপােষ আলােচনায় তারা অসম্মত। ক’দিন আগে পাকিস্তানের কাছে প্রেরিত একটি পত্রে দিল্লী একটু নমনীয় মনােভাব দেখিয়েছিলেন। এ মনােভাব সম্পূর্ণ অযৌক্তিক। কারণ ভারতের আকাশপথ খােলা পেলেই দ্রুতগতিতে পাঞ্জাবী সৈন্যরা যাবে পূর্ব বাংলায়। তারা চড়াও হবে বাঙালী মুক্তিযােদ্ধাদের উপর। ইয়াহিয়া খানের গণহত্যার সহযােগী কোনদিনই হতে পারে না ভারত। সৈরাচারী দুষ্মনের বিরুদ্ধে জান কবুল করে লড়ছেন ওপারের গণতন্ত্রী বাঙালী। আর তাদের নিধনের পথ ইয়াহিয়া খানের জন্য খুলে দেবে গণতন্ত্রী প্রতিবেশী রাষ্ট্র—এ কথা কল্পনা করা যায় না। প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী এবং প্রতিরক্ষামন্ত্রী জগজীবন রাম দ্ব্যর্থহীন ভাষায় ভারতীয় জনগণকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন কেন্দ্রের শক্ত নরম হবে না। যেসব উচ্চপদস্থ অফিসার মন্ত্রীদের প্রতিশ্রুতির উপর নজর না রেখে পাকিস্তানে বিভ্রান্তকারী পত্র পাঠান, তাঁদের কৈফিয়ত তলব অবশ্য কর্তব্য। ভারতের আকাশপথে পাক-সামরিক বিমান চলাচলের উপর নিষেধাজ্ঞা আন্তরিকভাবে সমর্থন করেছেন গণতন্ত্রী এবং সংগ্রামী পাক-জনতা। তারা সিংহলের আচরণে বিক্ষুব্ধ। ইয়াহিয়া খানের সামরিক বিমান যাতে সিংহল ঘাটি ব্যবহারের সুযােগ না পায়, তার জন্য সিংহলী সরকারের কাছে তারা অনুরােধও জানিয়েছেন। পাইকারী হারে বাঙালী হত্যার বীভৎস কাহিনী পাঠান হয়েছে রাষ্ট্রসংঘের সেক্রেটারী জেনারেল উ থান্টের কাছে। গণহত্যার জন্য যারা দায়ী তারা মানবতার শত্রু। ইয়াহিয়া খান এই জঘন্য অপরাধে অপরাধী। তাঁর সঙ্গে এক টেবিলে বসে আলাপ-আলােচনা চালানও আত্মমর্যাদা হানিকর। পূর্ব বাংলায় যা ঘটছে তা অবশ্যই পাকিস্তানের আভ্যন্তরীন সমস্যা। কিন্তু গণহত্যায় আন্তর্জাতিক প্রশ্ন দুনিয়ার প্রত্যেকটি সভ্য রাষ্ট্র থেকে এর প্রতিবাদ ওঠা উচিত। পাকিস্তানের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপনে ভারত উৎসুক। কিন্তু ইয়াহিয়া খান পাক-জনসাধারণের প্রতিনিধি নন। তিনি ভূইফোড় ডিকটেটর। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় পূর্ব বাংলায় যারা জীবনপণ করেছেন এবং পশ্চিম পাকিস্তানের যাঁরা তাঁদের মদৎ দিচ্ছেন তারাই সত্যিকারের সুস্থ নাগরিক। এসব মুক্তিযােদ্ধাদের হাতেই পাকিস্তানের ভবিষ্যৎ। এদের দমন করতে চান ইয়াহিয়া খান। তার জন্যই তার প্রয়ােজন ভারতের আকাশপথ। নর-হন্তাকে সে-সুযােগ অবশ্যই দেওয়া হবে না। উত্তাল পূর্ব বাংলা স্বাধীকার প্রতিষ্ঠিত হােক। গােটা পাকিস্তানে লােকায়ত্ত সরকার কায়েম হবার পরই চলবে পাক-ভারত আলােচনা। তার আগে নয়।

সূত্র: দৈনিক যুগান্তর, ১৩ মার্চ ১৯৭১