মুক্তিযােদ্ধারা ভবিষ্যৎ রাষ্ট্রকাঠামাে নিয়ে ভাবছেন
(মুজিবনগর থেকে নিজস্ব প্রতিনিধি)
মুক্তিবাহিনীর ক্রমবর্ধমান চাপে পাকফৌজ পিছু হঠছে, পাকিস্তানি হানাদার সেনামুক্ত স্বাধীন বাঙলাদেশের স্বপ্ন অনেক রক্তের বিনিময়ে বাস্তবে রূপ নিতে শুরু করেছে।
হানাদারমুক্ত স্বাধীন বাঙলাদেশের ভবিষ্যৎ রাষ্ট্রকাঠামাে, সংবিধান, সরকারি গঠন-প্রকৃতি প্রভৃতি সবকিছু প্রশ্নই এখন তাই বাঙলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের শরিকদের কাছে আশু প্রশ্ন হয়ে উঠছে। এইসব প্রশ্নের দ্রুত মীমাংসার জন্য বাঙলাদেশের অস্থায়ী সরকার ও তার সহযােগী রাজনৈতিক দলগুলােকে এখন থেকেই এ বিষয়ে ভাবতে হচ্ছে যাতে ভবিষ্যতে সুশৃঙ্খলভাবে সমগ্র রাষ্ট্রকাঠামােতে নতুন রূপ দেওয়া যায় নতুন কোনও আভ্যন্তরীন বিরােধ সৃষ্টি হবার আগেই।
বাঙলাদেশের নেতাদের সামনে যে প্রশ্নগুলাে স্বাভাবিকভাবে আসছে, তা হলাে :
নতুন রাষ্টের সংবিধান।—এই সংবিধান রচনা করবে কে? পাকিস্তানের অঙ্গরাজ্য হিসাবে
বাঙলাদেশে নির্বাচন হয়েছিল জাতীয় পরিষদ আর প্রাদেশিক আইন সভায় বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন আওয়ামী লীগের করায়ত্ত হয় ; দুটি আসনে অধ্যাপক মােজাফফর আহমদের নেতৃত্বাধীন ন্যাপ’ ও জয়ী হয়েছিল। মাওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে চালিত ন্যাপ’ কোনও আসন পায়নি। আর, কমিউনিস্ট পার্টি নিষিদ্ধ থাকার দরুন নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারেনি।
২৫ মার্চ থেকে নিরস্ত্র বাঙালির ওপর ইয়াহিয়া ফৌজের বেপরােয়া আক্রমণ, ব্যাপক হত্যা, লুঠতরাজ, অগ্নি সংযোেগ—নিরীহ বাঙালির আর্তনাদ আর শবের স্তুপের তলায় পাকিস্তানের সমাধি ঘটে গিয়েছে। তার জায়গায় আসছে এক নতুন রাষ্ট্র বাঙলাদেশ। এই বাঙলাদেশের জন্য সংগ্রামে উপরােক্ত সবকটি দলই সহযােগি-সংগ্রামী। দেশের ভবিষ্যৎ রাষ্ট্রকাঠামাের ব্যাপারে তাই তাদের সকলেরই মতামতের ক্ষেত্রে এই সকলেরই মতামত থাকা প্রয়ােজন। এই মতামত প্রতিফলিত করার যে কটি উপায়, সেগুলাে হলাে : প্রথমত সমস্ত সংগ্রামী শক্তির সমন্বয়ে একটি জাতীয় মুক্তি ফ্রন্ট ও তার সরকার গঠন করা ; দ্বিতীয়ত : সংবিধান রচনার জন্য একটি সর্বদলীয় সংবিধান পরিষদ বা ‘কনস্টিটুয়েন্ট অ্যাসেমব্লি’ করা এবং সেই নতুন সংবিধান অনুযায়ী দেশের জনপ্রতিনিধি নির্বাচন।
পাকিস্তান রাষ্ট্রের ভিত্তিতে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে জাতীয় পরিষদের জন্য আর প্রাদেশিক আইনসভার জন্য নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মধ্যে যারা ইসলামাবাদের জন্য নির্বাচিত হয়েছিলেন, নতুন বাঙলাদেশের আইনসভায় তাঁদের কী স্থান হবে? তাদের যদি আইনসভার অঙ্গীকার করা হয় তা হলে প্রাদেশিক আইনসভার সদস্যদের অবস্থা কী দাঁড়াবে? এবং আজকের মুক্তি সংগ্রামে ঐ দুই আইনসভা বহির্ভূত যে সব শক্তি লড়াই করছে তাদের কোথায় স্থান হবে? এই প্রশ্নগুলাের পটভূমিকায়ই ভবিষ্যৎ সংবিধানসভা গঠনের প্রশ্নটি উঠছে। মুক্তি সংগ্রাম পরিচালনার সঙ্গে সঙ্গে বাঙলাদেশ সরকারের নেতৃবর্গ এইসব প্রশ্নেরও মােকাবিলা করার।
সূত্র: সপ্তাহ, ২৬ নভেম্বর ১৯৭১