You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.06.11 | কুষ্টিয়ার মুক্তিযুদ্ধ শিবির থেকে বলছি | সপ্তাহ - সংগ্রামের নোটবুক

কুষ্টিয়ার মুক্তিযুদ্ধ শিবির থেকে বলছি
[বিশেষ প্রতিনিধি]

মুক্তিযুদ্ধে, স্বাধীনতার যুদ্ধে কুষ্টিয়া কুমারখালি অঞ্চল যে দেশপ্রেম সাহসিকতার নজির রেখেছে। বাঙলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে তা অবিস্মরণীয় হয়ে থাকবে। স্বাধিকার আন্দোলনের কর্মসূচি অনুযায়ী অফিস আদালত স্কুল কলেজ বন্ধ তাে চলছিলই, স্বাধীন বাংলাদেশ ঘােষণা ও ২৫ তারিখে ঢাকায় জঙ্গি বাহিনীর ব্যাপক হত্যালীলার সংবাদ পৌছানাে মাত্রই, মুক্তিযােদ্ধারা কুষ্টিয়ার সামরিক বাহিনীর ঘাঁটি আক্রমণ করে ও সমস্ত খান-সেনা ও তাদের তাঁবেদারদের খতম করে । জগতি, কয়া, চড়াইকোল গ্রামে যে দু-চারজন পালিয়ে বাঁচার চেষ্টা করে গ্রামবাসীরা তাদেরও হত্যা করে। পুলিশ, ই পি আর তাদের হাতিয়ার নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে সামিল হয়। পােেরই এপ্রিল পর্যন্ত সমগ্র কুষ্টিয়া জেলা মুক্তিযােদ্ধাদের আয়ত্তে থাকে। মুক্তিযােদ্ধাদের সর্বপ্রকারে মদত দিয়েছেন গােলাম কিবিরিয়া সাহেব (এম পি এ)। এরপর শুরু হয় জেট, বিমান, স্থলবাহিনীর যুগপৎ আক্রমণ। বিমান থেকে বােমা বর্ষণ, মেশিনগান ব্যবহার করে স্থলবাহিনী, নদীর দুপারে গানবােট থেকে গােলাবর্ষণ চলতে থাকে। প্রতিরােধ, প্রতি-আক্রমণ চলতে থাকে মুক্তিযােদ্ধাদের । কুষ্টিয়া কুমারখালি অঞ্চলে বাঙলাদেশের অন্য এলাকার মতই নির্বিচারে গণহত্যা ও ধ্বংসলীলা চালানাে তাে হয়ই উপরন্তু সমস্ত বাঙালি বাড়ি, স্কুল-কলেজ ডিনামাইট দিয়ে উড়িয়ে দেওয়া হয়। হয়ত এই কারণেই যে কুষ্টিয়া দীর্ঘদিন খানসেনাদের কুষ্টিয়াতে ঢুকতে দেয়নি এবং বাঘাযতীন, লালন শাহ্-ফকীর, কাঙাল হরিনাথ প্রভৃতির জন্মস্থান-বাসস্থান, এবং কবিতীর্থ শিলাইদহ এই অঞ্চলে অবস্থিত হওয়াতে কুষ্টিয়া-কুমারখালি অঞ্চল মুক্তিকামী মানুষের কাছে তীর্থস্থানে পরিণত হয়েছিল।
মীরপুর থেকে কুষ্টিয়া শহরে প্রবেশ করার সময় পাকি-সেনারা মরমী সাধক-কবি লালন শাহ্-ফকিরের মাজার সম্পূর্ণ ধ্বংস করে। কুষ্টিয়ার লাহিনীপাড়ার ছেউড়িয়া) এই নবনির্মিত মাজারে শত শত আউল বাউল মুরশেদ ও হাজার হাজার রসিক, ভক্ত শ্রোতার উপস্থিতিতে যে অনুষ্ঠান উদযাপিত হতাে তাতেই প্রমাণিত হতাে “আমরা হিন্দু নই, আমরা মুসলমান নই, আমরা বাঙালি” এই উক্তির সার্থকতা। বাঘা যতীনের স্মৃতিবিজড়িত কয়াগ্রামে পাক-সেনারা আধুনিক চীনা অস্ত্রের সাহায্যে পুড়িয়ে দিয়েছে। কুমারখালি থানার অন্তর্গত শিলাইদহ কুঠিবাড়ি বােমার আঘাতে ক্ষতিগ্রস্থ তবে সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়নি, বাড়িটির একপাশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
বিশ্বাস করুন আর নাই করুন, পাকি সেনাবাহিনী একজন সরকারি কর্মচারী কিংবা উচ্চশিক্ষিত একজন বাঙালিকে পায়নি, যিনি বিশ্বাসঘাতকতা করে জেলা শাসকের পদ গ্রহণে ইচ্ছুক। তাই কুষ্টিয়ার রক্সি সিনেমা হলের আধুশিক্ষিত অবাঙালি আবুল হাসিম এখন কুষ্টিয়ার ডি. সি, – জেলা শাসক। | হিন্দু-মুসলমান-নির্বিশেষে গণহত্যার জন্য কুষ্টিয়া-কুমারখালির অধিকাংশ জনসাধারণ গ্রামে আশ্রয় নিয়েছেন। মুসলিম লীগ ও জামাতে ইসলাম সমর্থক অবাঙালি, দু-চারজন বাঙালি এবং পেশাদার গুণ্ডালুটেরার দল পাক সেনাবাহিনীর সাহায্যে হত্যা, বাড়ি দখল, দোকান লুট চালিয়ে যাচ্ছে। এদের নিয়ে তৈরি হয়েছে ‘পীস কমিটি। কুমারখালি অঞ্চলে এই পীস কমিটিতে আছেন কট্টর সাম্প্রদায়িক মনােভাবাপন্ন। ব্যক্তিরা ও গুণ্ডা-লুটেরার দল যেমন, সফীকুল আলম, মনতাজ পরামানিক, গােলাম মহম্মদ, আহমদ জালাল, সােনা জোয়াদ্দার এবং অবাক হবেন না, বিকলাঙ্গ হিন্দুগুন্ডা শিবু সিংহ রায়। এই সফিকুল আলম সম্প্রতি কুমারখালির ও.সি. নিযুক্ত হয়েছে।
হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা চলছে—একথা যারা বলছেন তারা আংশিক সত্য বলছেন বা অংশত ঘটনাটি অনুধাবন করছেন। আবার বাঙালিরা একেবারেই লুট দাঙ্গা করছে না— এও প্রকৃত তথ্য নয়। আসলে সাম্প্রদায়িক দলগুলাের অবাঙালি-বাঙালি সমর্থকরা খান-সেনাদের সাহায্যে লুট দাঙ্গা চালাচ্ছে। বেসামরিক শাসন একেবারে ভেঙে পড়েছে, থানা পুলিশ বলতেও আসলে কিছু নেই।
খুলনার সাতক্ষীরা সাবডিভিশনের পাটিলঘাটা হাটে ৩০ জন গ্রামবাসীকে হত্যা করা হয়। তাঁরা হিন্দুর দোকান লুট করতে অস্বীকার করেন। মৃত্যুভয় পর্যন্ত এই ৩০ জন মুসলমানকে আদর্শচ্যুত করতে পারেনি।

সূত্র: সপ্তাহ, ১১ জুন ১৯৭১