কলকাতার বিদেশি শকুনেরা এখন ঢাকায় ভাড়ার খুঁজছে
(বিশেষ প্রতিদিন)
সাংবাদিকের তকমা আঁটা যেসব বিদেশি গুপ্তচরেরা এতদিন কলকাতার লিটল রাসেল স্ট্রীটের গুঁড়িখানা থেকে শুরু করে গ্র্যাণ্ড আর গ্রেট ইস্টার্নে আর পার্ক স্ট্রীটের পানশালাগুলাে গুলজার করে তুলেছিল ঢাকা মুক্ত হবার পর তারা সব হুমড়ি খেয়ে পড়েছে বাঙলাদেশে। আমাদের উচ্চপদস্থ কিছু কর্তাব্যক্তি ঢাকা মুক্ত হবার সঙ্গে সঙ্গে ভারতীয় অথবা সােভিয়েত সাংবাদিকদের বাদ দিয়ে এইসব বিদেশি সাংবাদিকদেরই জামাই আদরে ঢাকায় নিয়ে গেছেন। সে কেচ্ছা ইতিমধ্যেই বড় বড় সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছে। যে খবর নিয়ে তাই এখানে আলােচনার কিছু নেই।
কিন্তু এসব বিদেশি সাংবাদিকেরা ঢাকা মুক্ত হবার পর বাংলাদেশে গিয়ে কী করেছে এবং কী করছে। দেশবাসীর সেটা জানা দরকার।
ইতিমধ্যেই ‘সপ্তাহ’র পাঠকদের আমরা জানিয়েছি যে এইসব সাংবাদিকেরা ঢাকা পদার্পণ করার সঙ্গে সঙ্গে অনেকেই এদের নিজেদের দেশের দূতাবাসের সঙ্গে যােগাযােগ করেছে, খবর দেওয়া নেওয়া করেছে, এমনকি সে কাজে দূতাবাসগুলােরও সাহায্য নিয়েছে বলে শােনা যাচ্ছে। ঢাকায় এরা কী মতলবে গিয়েছে। তার জবাব এদের এইসব কাজকর্ম থেকেই পাওয়া যায়। যে সাংবাদিকেরা প্লেনে ওঠা পর্যন্ত সাংবাদিকের ভেক রেখেছিল ঢাকার মাটিতে নেমেই এরা স্বমূর্তি ধারণ করেছে। এবং সবচেয়ে দুঃখের কথা হলাে তার সুযােগ করে দিয়েছে আমাদেরই উপর মহলের কিছু খয়েরখা কর্তাব্যক্তি।
সে কথা যাক। কিন্তু ঢাকা গিয়ে এরা বাঙলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে যেসব হীন মিথ্যা ও কুৎসার বেসাতি বিশ্বে সংবাদের বাজারে প্রচার করছে তার দুয়েকটা নমুনা এখানে আমরা ‘সপ্তাহ’র পাঠকদের কাছে তুলে ধরতে চাই।
মার্কিন সাপ্তাহিক ‘নিউজ উইক’ বিশ্বের সব কমিউনিস্ট দেশে ও গণতন্ত্রের দেশে সর্বদা নিপীড়নের নজির খুঁজে বেড়ায়। চেকোশ্লোভাকিয়ার প্রতিক্রিয়ার অভ্যুত্থানের চেষ্টায় ‘নিউজ উইক’ আহলাদে আটখানা হয়েছিল।
তারপর সেই অভ্যুত্থানের পরাজয়ে এবং ডুবচেকের জন্য এই মার্কিন পত্রিকাটির মরাকান্না ভােলার নয়। বাঙলাদেশের উপর ইয়াহিয়ার সৈন্যবাহিনী যেদিন বর্বরতম আক্রমণ শুরু করে সেদিন ‘নিউজ উইক’ হঠাৎ ‘নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার’ ভেক ধরে প্রায় প্রত্যক্ষভাবেই সেই বর্বরতার সাফাই গেয়ে যায়। গত নমাসে বাঙলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে মুক্তিফৌজের বীরত্ব ও পাক সৈন্যের বর্বরতা এই মার্কিন পত্রিকাটির সাংবাদিকদের বিন্দুমাত্র আন্দোলিত করতে পারেনি। বাঙলাদেশের তরুণীদের ধর্ষিত মৃতদেহ যখন পাক ক্যানটনমেন্টের বাঙ্কার থেকে আবিষ্কৃত হয় নিউজ উইকের চোখে তার বিরুদ্ধে ঘৃণার লেশমাত্র দেখা যায় । বাঙলাদেশে নিরপরাধ বাঙালির গলিত মৃতদেহ ঠাসা গুদাম ঘরের ছবি নিউজ উইকের পাতায় প্রকাশের যােগ্য বলে বিবেচিত হয় না।
সেই ‘নিউজ উইক’ ৩ জানুয়ারি সংখ্যায় ‘বাঙলাদেশের জন্মযন্ত্রণা’ এই শিরােনামায় যে খবর ছেপেছে। তার গােড়াতেই আছে দুটি ছবি। ছবির শিরােনামা : প্রতিহিংসার উন্মত্ততা। বিষয়বস্তু : মুক্তিবাহিনীর হাতে পাক সৈন্যের সহযােগি বিশ্বাসঘাতকেরা কিভাবে নির্যাতিত হচ্ছে। নিউজ উইক’ উপরােক্ত শিরােনামায় যে সংবাদ ভাষ্য ছেপেছে তাতে বলা হয়েছে “বাঙলার স্বাধীনতার প্রবক্তারাই পূর্ব পাকিস্তানে প্রথম রক্তপাতের সূত্রপাত করেছে। জাতিতে জাতিতে বিরােধকে যে সহজ সরল নৈতিক মানদণ্ডে বিচার করা যায়—এহেন। মােহকে গত সপ্তাহে বাঙলীরা চূর্ণ করে দিয়েছে। বাঙলাদেশের নতুন রাষ্ট্র জন্ম গ্রহণ করতে না করতেই বিজয়ী মুক্তিবাহিনী সেখানে উন্মত্ত প্রতিহিংসার তাণ্ডবে মেতেছে।”
যে সামান্য ঘটনাকে কেন্দ্র করে ‘নিউজ উইক’ বাঙলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, তার স্বাধীনরাষ্ট্র ও বীর মুক্তিবাহিনীকে সারা বিশ্বে হেয় প্রতিপন্ন করার কুৎসিত চেষ্টা করেছে, সে ঘটনার কথা আমরা সকলেই জানি। ঢাকা মুক্ত হওয়ার কয়েক দিন পরে ঢাকার রেসময়দানে চারজন বিশ্বাসঘাতক ধরা পড়ে। যে ঢাকাবাসীর স্মৃতিতে আজও পাকিস্তানি সৈন্যের অত্যাচার ও বদর বাহিনীর হত্যাকাণ্ড দগদগে রয়েছে তাদেরই কিছু লােক এবং মুক্তিবাহিনীর কয়েকজনের হাতে সেই চার বিশ্বাসঘাতক লাঞ্ছিত ও শেষে নিহত হয়। এই একটিমাত্র অবাঞ্ছিত ঘটনা ঢাকা শহরে ঘটেছে। সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশ সরকার ও মুক্তিবাহিনী সেই ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের গ্রেফতার করে।
‘নিউজ উইকে’র সাংবাদিক ও ফটোগ্রাফার বাঙলাদেশের মুক্তিসংগ্রাম, ঢাকার মুক্তি ও তারপর বাঙলাদেশের জনতার বিজয়ােৎসবের তাৎপর্যকে দেখতে পায়নি। এই সাম্রাজ্যবাদী শকুনেরা খুঁজে খুঁজে সেই সংবাদকেই ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে প্রকাশ করেছে যা সংবাদ নয় দুর্ঘটনা মাত্র, এবং যে দুর্ঘটনার পুনরাবৃত্তিকে বন্ধ করার ব্যাপারে বাংলাদেশ সরকারের তৎপরতা তুলনাহীন।
প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী সম্প্রতি এক প্রেস কনফারেন্সে বিদেশি সাংবাদিকদের এই ধরনের কার্যকলাপকে সমালােচনা করে এই কথাই বলেছেন।
‘নিউজ উইকে’র সাংবাদিকদের মতে বাংলাদেশে নাকি আজ প্রতিহিংসার উন্মক্ত তাণ্ডব শুরু হয়েছে। তাই যদি হতাে তাহলে জেনারেল নিয়াজি থেকে শুরু করে একটি পাকিস্তানি যুদ্ধবন্দিরও চিহ্ন খুঁজে পাওয়া যেত না বাঙলাদেশে। কিন্তু আমরা জানি প্রচণ্ড ক্রোধ ও বেদনাকে বুকের মধ্যে পুষে রেখেও বাঙলাদেশের মানুষ তার নারীহন্তা ও ধর্ষণকারী শত্রু ও তার পদহেলী দালালদের প্রতি কী অসীম ধৈর্য, সংযম ও মানবিকতার পরিচয় দিচ্ছে। ধরা পড়ার পর অক্ষত শত্রুকে, বদরবাহিনীর বিশ্বাসঘাতককে বিচারের জন্য পুলিশের হাতে তুলে দিচ্ছে। পৃথিবীর ইতিহাসে এমন নির্মমভাবে অত্যাচারীত এবং তারপর বিজয়ী কোন জাতি শত্রুকে নখের ডগায় পেয়েও এমন ধৈর্য ও সংযমের পরিচয় ইতিপূর্বে দেয়নি। মুসােলিনী ও তার রক্ষিতা পেতাক্সিকে কবর থেকে তুলে এনে ইতালির জনসাধারণ তাদের গায়ে থুথু দিয়েছিল। বাঙলাদেশ। সেই স্বাভাবিক ঘৃণাকেও বুকের মধ্যে চেপে রেখেছে। শুধু তাই নয়, যুদ্ধ সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক আইনের সমস্ত কটি কানুন অক্ষরে অক্ষরে পালন করে এমন শত্রশাসন ও যুদ্ধজয় পৃথিবীর ইতিহাসে কম দেখা গেছে। ভারতীয় জোয়ানেরা সেই অসাধ্য সাধন করেছে বাংলাদেশে।
সর্বশেসে ‘নিউজ উইকে’র সংবাদ দাতার অন্তত এই কথাটা মালুম হওয়া উচিত ছিল যে বাঙলাদেশের মানুষ যদি সত্যই প্রতিহিংসায় উন্মত্ত হয়ে উঠত তাহলে কোন মার্কিন সাংবাদিক সে দেশের মাটিতে নেমে এমন কুৎসা প্রচারের সুযােগ পেত না।
কলকাতায় আমরা এতদিন যে সব বিদেশি সাংবাদিক নামধারী শকুনদের পানশালায় মাতলামি করতে দেখেছি তারা এখন বাঙলাদেশে ভাগাড় খুঁজে বেড়াচ্ছে। বাঙলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের গৌরবােজ্জ্বল ইতিহাস এদের চোখে পড়েনি। এরা অর্ধসত্য ও মিথ্যাকে সত্য বলে প্রচার করে বাঙলাদেশ ও বাঙালি জাতির নাম কলঙ্কিত করার চেষ্টা করছে। আমরা কতদিন এদের সহ্য করব? সে ঢাকার মাটিতেই হােক অথবা কলকাতাতেই হােক?
সূত্র: সপ্তাহ, ৭ জানুয়ারি ১৯৭২