১৪ নভেম্বর, ১৯৭১ কামালপুর ৩য় যুদ্ধ
১৩ নভেম্বর গোপন সংবাদে জানা যায় কামালপুর বিওপির উত্তর দিকে ভারতীয় বেড়িবাঁধ সংলগ্ন কিছু বাঙ্কার থেকে পাকিস্তানী সৈন্যরা (৩১ বালুচ অংশ ও ৮৩ মর্টার ব্যাটারি অংশ) সরে গেছে। এ সংবাদের ভিত্তিতে সেক্টর কমান্ডার আবু তাহের ঐ বাঙ্কারগুলোতে অবস্থান নিয়ে কামালপুর দখল করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী হেলাল কোম্পানির মুক্তিযোদ্ধারা একটি গ্রুপ নিয়ে মাঝ রাতে বেড়িবাঁধ অতিক্রম করে কামালপুর পোস্টের উত্তর-পূর্ব কোণে পাকিস্তানীদের পরিত্যক্ত বাঙ্কারগুলোতে অবস্থান নেয়।
উত্তর-পূর্ব দিকে প্রথম বাঙ্কারে মেজর তাহের তাঁর দেহরক্ষি বেঙ্গল রেজিমেন্টের একজন সিপাহী এবং তাঁর দুই ভাই বেলাল-বাহার। হেলাল কোম্পানির কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধাও একই সাথে অবস্থান নেয়। কয়েকশত গজ দূরে পশ্চিম দিকের বাঙ্কারগুলোতে হেলাল, লতা, মিঠু, সুজাসহ আরও কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা অবস্থান গ্রহণ করে। কামালপুর বিওপির মুখোমুখি ধানুয়াতে আবেদীন কোম্পানীর জয়নাল আবেদীন, লে. মিজান, সাঈদ কোম্পানির সাঈদ (তাহেরের ছোট ভাই), ক্যাপ্টেন মান্নান ও হারুন হাবীবসহ আরও অনেকে তাদের গ্রুপ নিয়ে বিভিন্ন ‘হাইড আউটে’ আগে থেকেই অবস্থান করছিল।
প্রত্যেক গ্রুপের সাথে যোগাযোগ ও সমন্বয় করার জন্য ছিল কয়েকটি ‘ওয়াকিটকি’। মহেন্দ্রগঞ্জ ক্যাম্পে ছিল আরেকটি সেট। প্রত্যেকটি গ্রুপের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করে ঠিক ঠাক চলছিল। বেড়িবাঁধের উত্তর পাশে মহেন্দ্রগঞ্জ থেকে মিত্রবাহিনীর ১৩ গার্ড রেজিমেন্ট আর্টিলারি ফায়ারিং দিয়ে ঐতিহাসিক অপারেশনটিকে ‘কভারেজ’ দিচ্ছিল।
ভোররাত ৩টা ৪৫ মিনিটে অপারেশন শুরু হলো। সকাল সোয়া সাতটা পর্যন্ত দু পরে মধ্যে প্রচন্ড গুলিবিনিময় হলো। কিন্তু এত প্রচন্ড গোলাগুলির পরও হানাদার বাহিনী তাদের বাঙ্কার থেকে উঠে আসেনি। ১৪ নভেম্বর সকাল সাড়ে আটটার দিকে মেজর তাহের তাঁর বাঙ্কার থেকে উঠে লে. মিজান ও হেলালের পজিশনে আসেন। তাঁদের কোন অবস্থাতেই নিজ নিজ অবস্থান থেকে উঠে না যাওয়ার নির্দেশ দেন। এ সময় ধানুয়া ‘হাইড আউটের’ কোম্পানি কমান্ডার আবেদীন এগিয়ে এসে মেজর তাহেরের সাথে কথা বলতে থাকেন। সকলের সঙ্গে কথা বলতে বলতে তাহের বাঁধের কাছে ঘাসের ওপর বসে পড়েন। মুহূর্তেই প্রচন্ড একটি শব্দ হয় এবং সকলের সামনেই মেজর তাহের মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। উপস্থিত অনেকেই মনে করেন, কোন একটি মর্টার সেলের আঘাত-আবার কেউ কেউ মনে করেন যেখানে তাহের লুটিয়ে পড়েন সেখানে একটি ‘এ্যান্টি পারসনাল মাইন’ ছিল। সে যাই হোক, তাঁর বাম পায়ের হাঁটুর উপরের অংশ প্রায় দ্বিখন্ডিত হয়ে সামান্য কিছু শুধু চামড়ার সাথে ঝুলে থাকে।
খবর পেয়ে বিএসএফের অধিনায়ক ক্যাপ্টেন নিয়োগী এ্যাম্বুলেন্স পাঠানোর ব্যবস্থা করেন। মিত্র বাহিনীর মেজর মুখার্জী (ডাক্তার) নিজেই এ্যাম্বুলেন্স নিয়ে এসেছিলেন। মেডিক্যাল কোরের মুক্তিযোদ্ধা নাসিরকে এ্যাম্বুলেন্সের সাথে দেয়া হয়েছে। সেক্টরের ডাক্তার প্রেমাংকুর রায়ও এসেছেন। ডা. মেজর মুখার্জী মেজর তাহেরকে শিলিগুড়ি হাসপাতালে নিয়ে যান।
সূত্র: ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ।। দলিলপত্র: দশম খ-। সশস্ত্র সংগ্রাম (২)’ থেকে সংগৃহীত। দৈনিক জনকণ্ঠ (পৃ. ১৪), সংক্ষেপিত