You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.11.07 | ২০ কার্তিক, ১৩৭৮ রবিবার, ৭ নভেম্বর ১৯৭১ | একাত্তরের দশ মাস – রবীন্দ্রনাথ ত্রিবেদী - সংগ্রামের নোটবুক

২০ কার্তিক, ১৩৭৮ রবিবার, ৭ নভেম্বর ১৯৭১

পাক জঙ্গীবিমান থেকে বেলুনিয়ায় মুক্তিবাহিনীর অবস্থানের উপর স্ট্র্যাপিং করে। ১ নং সেক্টর থেকে প্রেরিত মুক্তিযোদ্ধারা অসীম সাহসে যুদ্ধ করে যাচ্ছিলেন। ২৯ জন পাকসেনা নিহত হয়। বিমান স্ট্র্যাপিংয়ে ক’জন বেসামরিক লোক নিহত হয়। ইপিআর হাবিলদার শহীদসহ কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা পাকসেনাদের হাতে বন্দী হয় এবং অত্যাচারে শহীদ হয়।

ওয়াশিংটনে শ্ৰীমতী ইন্দিরা গান্ধী ও প্রেসিডেন্ট নিক্সনের মধ্যে দ্বিতীয় দফা বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের শ্ৰীমতী ইন্দিরা গান্ধী বলেন, যুদ্ধ এড়াতে ভারত সম্ভাব্য সবকিছু করবে। পূর্ববাংলার সমস্যার কোন সমাধানে উপনীত হতে হলে তা পূর্ব বাংলার জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য হতে হবে। বাংলাদেশ সরকারের প্রতিনিধিদের উপস্থিতি ছাড়া ভারত-পাকিস্তান আলোচনা অর্থবহ হতে পারে না। এদিন শ্রীমতী গান্ধী যুক্তরাষ্ট্রের National Broadcasting Corporation (USA)-এর সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে পূর্ববঙ্গে ডিসেম্বর ‘৭১ মাসে পাক সরকার কর্তৃক আয়োজিত উপ-নির্বাচনের উপর বক্তব্য রাখেন। তিনি বলেন, “Sheikh Mujib’s Majority was even greater than mine, and his elections were held in far more adverse conditions, that is, under the present military regime.’ Now you suddenly say that, well, he is a traitor, and they (Pak-regime) are trying to hold re-elections for the seats where the members still exist. And what has shocked as is that I think about 55 people have been declared elected, unopposed, to these very seats where a fair and free election was held; it seems a strange thing to have on election and then send out, force people who have been elected against you out of the country…we have said it is an internal problem, but it is over flowing into India.” (BD-2, P.49).

শ্ৰীমতী ইন্দিরা গান্ধী চারদিনের সরকারী সফরে (৭-১৩ নভেম্বর) প্যারিস পৌছেন।

কবি সুফিয়া কামালের বাসায় সোভিয়েত কামাল মিঃ নভিকভ সাংবাদিক-ঔপন্যাসিক শহীদুল্লাহ কায়সারকে ঢাকা থাকা নিরাপদ নয় বলে জানান। তাঁকে সীমান্ত পেরিয়ে যেতে বলেছিলেন। শহীদুল্লাহ সাহেব বললেন, খালাম্মা থেকে গেলেন, আমিও যাব না। (একাত্তরের ডাইরী পৃঃ ৮)

ছাত্রলীগ সভাপতি জনাব নূরে আলম সিদ্দিকী, সাধারণ সম্পাদক শাজাহান সিরাজ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের সহ-সভাপতি আ স ম আব্দুর রব, সাধারণ সম্পাদক আব্দুল কুদ্দুস মাখন এবং ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি নূরুল ইসলাম ও সাধারণ সম্পাদক মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম এক যুক্ত বিবৃতিতে মাতৃভূমির মুক্তি ও বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তি ত্বরান্বিত করার জন্য জনগণের রায় মোতাবেক প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশ সরকারের পশ্চাতে কাতারবন্দী হওয়ার উদ্দেশ্যে দেশের ছাত্র ও তরুণ সমাজের প্রতি আকুল আবেদন জানিয়েছেন।

তাঁরা এক বিবৃতিতে বলেনঃ ‘বাঙ্গালী জাতির মহান নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আদর্শে অনুপ্রাণিত ও নির্দেশে পরিচালিত গৌরবোজ্জ্বল মুক্তি সংগ্রামের এখন সপ্তম মাস। মাতৃভূমিকে মুক্ত করার জন্য পাকিস্তানের চরম প্রতিক্রিয়াশীলদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামের ব্যাপারে বাংলাদেশের বীর ছাত্রসমাজের একটা মহান ঐতিহ্য রয়েছে। আমাদের স্মরণ রাখতে হবে যে, বর্বর ইয়াহিয়া চক্রকে চীন সরকার ও মার্কিন সাম্রাজ্যবাদীরা মদদ দিয়ে যাচ্ছে। সুতরাং আমাদের প্রবল প্রতিকূলতার বিরুদ্ধেই সংগ্রাম করতে হবে। ভারত সোভিয়েত ইউনিয়নের মত যে সব দেশ আমাদের নানাভাবে সাহায্য ও সমর্থন দিচ্ছে তার জন্য জানাই আমাদের কৃতজ্ঞতা। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকার করার জন্য বিশ্বের রাষ্ট্রবর্গের প্রতি আমরা আবেদন জানাই।’ (জয় বাংলা ২৮ শ সংখ্যা)

মুক্তিযোদ্ধা গেরিলাদল ঢাকার পিআইএ দফতরে বোমা হামলা চালায়। আতঙ্কগ্ৰস্তরা ইতস্তত দৌড়াদৌড়ি করে। স্টেট ব্যাংকের (বর্তমান বাংলাদেশ ব্যাংক) মোড়ে রাজাকার মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে গুলী বিনিময় হয়। হতাহতের সংবাদ জানা যায়নি।

নারায়ণগঞ্জের (পি ই-১৯২, ঢাকা-২২) দখলদার বাহিনী কর্তৃক প্রহসন নির্বাচনে নির্বাচিত সুলতানউদ্দিন খান ও বন্দর থানার সোনাকান্দা শান্তি কমিটির আহ্বায়ক হাজী সাহেব আলীকে হত্যা করা হয়। বন্দর থানার নবীগঞ্জে শান্তি কমিটির সদস্য হাজী আব্দুল লতিফসহ দুইজন দালালকে হত্যা করা হয়। চট্টগ্রাম দেব পাহাড়ে ইপি ওয়াপদার একটি ভবন সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত হয়। (সংবাদপত্র)

করাচী ডন পত্রিকায় প্রকাশ পিডিপি নেতা নুরুল আমিন বলেছেন, প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান তাঁকে আশ্বাস দিয়েছেন যে, অনুপ্রবেশকারীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য রাজাকারের সংখ্যা বৃদ্ধি করা হবে তাদেরকে আরো অস্ত্রশস্ত্র দেয়া হবে। উল্লেখ্য, এ সময়ে খোদ ঢাকা শহরের শাহবাগ মোড়ে মুক্তিযোদ্ধা গেরিলা-রাজাকারদের মধ্যে গুলী বিনিময় হয়। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে রাজাকারদের অবিলম্বে আত্মসমর্পণ করতে বলা হয়। সাধারণ অরাজনৈতিক রাজাকাররা (যারা জামায়াত ইসলামীর শঠতার রাজনীতির শিকার) অনেকক্ষেত্রে আত্মসমর্পণ করে। অনেকে পাকবাহিনীর অবস্থান ও কৌশলগত ব্যবস্থাদির তথ্যাদি দিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য করে। অন্য ক্ষেত্রে রাজাকাররা মুক্তিযোদ্ধাদের আতঙ্কে ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে। গোপনে গোপনে মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে যোগাযোগ স্থাপনের প্রচেষ্টা করে। (লেখক)

পিপিপি নেতা মিঃ ভুট্টো পিকিং সফর শেষে পিন্ডি ফিরে এলেন। করাচী ফিরে সাংবাদিকদের বললেন, গণচীন পাকিস্তানকে দৃঢ় সমর্থন জানিয়েছে। মিশন একশ ভাগ সফল। উল্লেখ্য, এসব ছিল ফাঁকা বুলি এবং মূলতঃ কেউ যদি মোহগ্ৰস্ত থেকে থাকে তিনি হলেন মিঃ ভুট্টো এবং তাঁর চীনাপন্থী লবী। কেননা, বাস্তব অবস্থা ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরনের। চৈনিকরা চলমান আন্তজার্তিক কূটনীতির ব্যাপারে এতই বাস্তববাদী ছিল যে মিঃ ভুট্টোর সাথে বৈঠক শেষে কোন যুক্ত ইশতেহার পর্যন্ত তারা প্রকাশ করেনি। অতএব, ভারত-সোভিয়েত চুক্তির বিপরীতে চীনের সঙ্গে পাকিস্তানের অনুরূপ সামরিক চুক্তি সম্পাদনের উদ্দেশ্য ভেস্তে যায়।

ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্ৰীমতী ইন্দিরা গান্ধী ওয়াশিংটন থেকে ফ্রান্স যাত্রার পূর্বে সাংবাদিকদের বললেন, প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার সাথে তার আলোচনার কিছু নেই। শেখ মুজিবের সাথে আলোচনাই বর্তমান সমস্যার কার্যকর সমাধান হতে পারে। কারণ, তিনিই বাঙ্গালী জনগণের নির্বাচিত স্বীকৃত নেতা। তাছাড়া’, বাংলাদেশের জনগণের অনুমোদনক্রমে যে কোন সমাধান সম্ভব হতে পারে। চীন প্রসঙ্গে শ্ৰীমতী গান্ধী বলেন, আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি তারা (গণচীন) সম্ভবত কোন বিরোধে জড়াবেন না। ৭ নভেম্বর সন্ধ্যাবেলা মিসেস গান্ধী ওয়াশিংটন থেকে প্যারী পৌঁছান। দু’দিনব্যাপী প্যারী সফরকালে তিনি প্রেসিডেন্ট পম্পিদু, প্রধানমন্ত্রী সেবান-দেলমাস ও ফরাসী সাহিত্যিক আঁন্দ্রে মালরোর সংগে সাক্ষাৎ করেন। উল্লেখ্য, আঁদ্রে মালরোঁ ১৭ সেপ্টেম্বর এক বিবৃতি দিয়ে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহণের ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন। মিঃ মালরোঁ স্পেনের গৃহযুদ্ধে রিপাবলিকান এয়ার ফোর্সে অংশগ্রহণ করেন এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ফ্রান্সে প্রতিরোধ যুদ্ধে এ্যালাক লোরেনে সক্ৰিয় অংশ গ্রহণ করেন।

মার্কিন প্রেসিডেন্টের প্রেস সেক্রেটারী মিঃ জিগলার ওয়াশিংটনে বলেন, পূর্ব পাকিস্তান সংকট প্রশ্নে প্রেসিডেন্ট নিক্সন ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে একটি মীমাংসার অপেক্ষায় রয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্র ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ চায় না। চায় শান্তিপূর্ণ মীমাংসা। (সংবাদপত্র)

Reference:

একাত্তরের দশ মাস – রবীন্দ্রনাথ ত্রিবেদী