You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.11.09 | ২২ কার্তিক, ১৩৭৮ মঙ্গলবার, ৯ নভেম্বর ১৯৭১ | একাত্তরের দশ মাস – রবীন্দ্রনাথ ত্রিবেদী - সংগ্রামের নোটবুক

২২ কার্তিক, ১৩৭৮ মঙ্গলবার, ৯ নভেম্বর ১৯৭১

বিপ্লবী বাংলাদেশ সরকারের নির্দেশে কুষ্টিয়ার মুক্তাঞ্চল মেহেরপুর ও চুয়াডাঙ্গায় বেসামরিক প্রশাসন চালু করা হয়। উল্লেখ্য, মুক্তিবাহিনী কুষ্টিয়া জেলার প্রায় ৮০০ বৰ্গ কিলোমিটার পাকহানাদার বাহিনীর হাত থেকে প্রচন্ড লড়াইয়ের পর মুক্ত করে। এ সময়ে পাকসেনারা দর্শনায় শক্ত ঘাঁটি প্রতিষ্ঠা করে।

মুক্তিবাহিনীর নৌ গেরিলাদল চট্টগ্রামে একটি তৈল ট্যাংকার বিধ্বস্ত করে। এ দিন পাকবাহিনীর কাছ থেকে দখল করা ছোট আকারের ৬টি নৌযান নিয়ে বাংলাদেশ নৌবাহিনীর প্রথম ‘বঙ্গবন্ধু’ নৌবহরের উদ্বোধন করা হয়। উল্লেখ্য, মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী বাঙ্গালী নৌসেনা ও জুন মাস থেকে পলাশীর অদূরে ভাগীরথীতে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত নৌ-ক্যাডেটদের নিয়ে এই বাহিনী গড়ে ওঠে। আর ২৮ সেপ্টেম্বর নাগাল্যান্ডের ডিমাপুরে গ্রুপ ক্যাপ্টন এ কে খোন্দকারের নেতৃত্বে বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর জন্ম হয়।

পাক উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধিদলের সঙ্গে আলোচনার ফল সন্তোষজনকঃ শিরোনামে দৈনিক পাকিস্তানে প্রকাশিত সংবাদে বলা হয়, অস্থায়ী পররাষ্ট্র মন্ত্রী চী পেং ফেই তার ভাষণে চীনের ভূমিকা পরিষ্কার ভাষায় ব্যক্ত করেছেন। (দৈঃ পা) ৭ঃ ২২৬।

ভারত হামলা করলে চীন হস্তক্ষেপ করবে। ইয়াহিয়া লাহোরে কলম্বিয়া ব্ৰডকাষ্টিং কর্পোরেশনের প্রতিনিধি টমাস কেন্টনের সাথে সাক্ষাৎকারে একথা বলেছেন। (দৈঃ পাঃ)

ইয়াহিয়া বলেনঃ শেখ মুজিবের ভাগ্যে কি ঘটবে না ঘটবে সে সিদ্ধান্ত আদালতই নিবে। (দৈঃ পাঃ)

ঢাকার বাওয়ানী একাডেমীতে বিস্ফোরণ ঘটে। গেরিলাদের হামলায় বেশ ক’জন ছাত্র শিক্ষক আহত হয়।

প্যারিসে ইন্দিরা-দেলমাসের (Chaban Delmas) মধ্যে একান্ত বৈঠক। ভারত ও ফরাসী প্রধানমন্ত্রীদ্বয় বৈঠকের পরে প্রেসিডেন্ট জর্জ পম্পিদুর সাথে শ্ৰীমতী ইন্দিরা গান্ধী আলোচনা করেন।

নেপালে ৩ জন ও সিংগাপুরে ১ জন বাঙ্গালী পাকদূতাবাসের কর্মচারী বাংলাদেশের সংগ্রামে আনুগত্য ও ঐকমত্য প্রকাশ করে।

ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস দৈনিক পত্রিকার সাথে এক সাক্ষাৎকারে ভারতের সর্বোদয় নেতা জয় প্ৰকাশ নারায়ণ বলেন, শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ সরকারকে এখন ভারতের রাজনৈতিক স্বীকৃতি দানের সময় এসেছে।

পাক সরকার পূর্ব পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদের ৭৮টি শূন্য আসনের উপনির্বাচনে ৫৮ জন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছে মর্মে ঘোষণা দেয়। এঁদের মধ্যে জামায়েত ইসলামীর গোলাম আযম, মওলানা আব্দুর রহীম, আব্বাস আলী খান, মওলানা ইউসুফ (বাগেরহাট), সাদ আহমদ, আব্দুল মতিন, অধ্যাপক ইউসুফ আলী (ঢাকা), সুবানউদ্দিন আহমেদ, মওলানা আমিজুদ্দিন, আব্দুল্লাহ আল কাফি, এস এম ইউসুফ, সফিউল্লাহ (নোয়াখালী), আফাজ উদ্দীন (রাজশাহী), মওলানা আঃ সোবাহান (পাবনা, এবং অধ্যাপক আব্দুল খালেক (টাঙ্গাইল)। (দৈঃ পাঃ) উল্লেখ্য, ১৯৭০ সনের ডিসেম্বর ৭ ও ১৭ এবং সাইক্লোন পীড়িত এলাকায় ১৭ জানুয়ারী ৭১ তারিখে জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জাতীয় পরিষদে ১৬২ আসনের মধ্যে দুটি আসন বাদে ১৬০টি আসন এবং প্রাদেশিক পরিষদে ৩০০ আসনের মধ্যে ২৮৮ টি আসনে বিজয়ী হয়। জাতীয় পরিষদের ৭টি মহিলা আসনে আওয়ামী লীগ বিজয়ী হয় জামাতে ইসলামী প্রাদেশিক পরিষদে একটি মাত্র আসনে বিজয়ী হয়েছিল।

এ প্রসঙ্গে কিসিং কন্টেম্পরারী আরকাইভ লিখেছে যে, “Right wing religious parties such as the Janmaat-i-Islami recieved little support, suggesting that the influence of the mullahs, even in the rural areas, was much less than had been believed.” (KCA, P-24413) স্মরিতব্য ১৯ সেপ্টেম্বর পাকিস্তান সরকার ৭৮টি জাতীয় সংসদ ও ১০৫ টি প্রাদেশিক সংসদের জন্য ২৫ নভেম্বর থেকে ৯ ডিসেম্বরের মধ্যে উপনির্বাচন অনুষ্ঠানের কথা ঘোষণা করে। ৯ অক্টোবর পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ৯৪ নং সামরিক আইনের বিধি জারী করে রাজনৈতিক দলগুলোর কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণ-বিধি প্রবর্তন করলেন। এসবের উদ্দেশ্য ছিল পূর্ব পাকিস্তানের কোন কোন বিশেষ দলকে সুবিধা দিয়ে উপনির্বাচন সমাপ্ত করা। এজন্য প্রধান নির্বাচন কমিশনার পদে বিচারপতি আব্দুস সাত্তারকে নিয়োগ করা হয়।

জাতীয় সংসদে শেখ মুজিবের আসনটি সম্বন্ধে সিদ্ধান্ত নেয়া হয় যে, তার বিচার শেষ না হওয়া পর্যন্ত ঐ আসনে নির্বাচন মুলতবি থাকবে। এই নির্বাচনের প্রকৃত উদ্দেশ্য ছিল জাতীয় সংসদে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের নিয়োজিত বিশেষজ্ঞ কমিটি কর্তৃক প্রণীত শাসনতন্ত্র অনুমোদন করা। বাংলাদেশ সরকার মুজিবনগর থেকে তথাকথিত নির্বাচনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানয় জনগণকে ষড়যন্ত্রের নির্বাচন বর্জনের আহবান জানান। (উপনির্বাচনে অংগ্রহণকারী দল ও প্রার্থীদের নামের তালিকা পরিশিষ্টে দেখুন)

ওয়াশিংটনে মার্কিন সরকারের একজন মুখপাত্র ঘোষণা করেন, যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানে তিন লাখ ডলার মূল্যের সামরিক সরঞ্জাম রফতানির লাইসেন্স বাতিল করে দিয়েছে।

“দি ডেইলি টেলিগ্রাফ”—এর সম্পাদকীয় মন্তব্যে বলা হয়, শেখ মুজিবকে মুক্তি দিয়ে বাংলাদেশ সমস্যা সমাধানের জন্য নতুন প্রচেষ্টা গ্রহণ না করা পর্যন্ত ইয়াহিয়া খান বহির্বিশ্বে ক্ৰমেই অধিকতর সমর্থনহীন হয়ে পড়বে। এর ফলে মরিয়া হয়ে সে কাশ্মীর কিংবা পাঞ্জাবে ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করে অসহনীয় অবস্থা থেকে মুক্তি লাভের চেষ্টা করতে পারে। সৌভাগ্যক্রমে, ভুট্টোর চীন সফরের উদ্দেশ্য সফল হয়নি বলে মনে হয়।

পাকসেনারা সাড়া বিশ্বকে দেখাতে চাচ্ছে-‘সব ঠিক হ্যায়।’ বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ স্কুল চলছে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চান্সলর ডঃ বারী ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিস্থিতি স্বাভাবিক’ এই মর্মে স্থানীয় বেতারে প্রচার চালায়। উল্লেখ্য, ১৭ জুলাই ডঃ বারী রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ভাইস চ্যান্সেলর নিয়োগের আগে জেনারেল টিক্কা খান দু’বার হেলিকপ্টারে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সঙ্গে কথা বলেন।

“দি গার্ডিয়ান”—এর সম্পাদকীয় মন্তব্যে বলা হয়, ঘটনাস্রোত বিরুদ্ধে প্রবাহিত হচ্ছে। গতকাল (৮ নভেম্বর) আমেরিকা পাকিস্তানকে অস্ত্র সরবরাহ বন্ধের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেছে। পাকিস্তানের বিশ্বস্ত বন্ধু বলে প্রচারিত চীন থেকে ভুট্টো ‘আন্তরিক বন্ধুত্ব’ ও ‘সমর্থনের সংকল্প’ সম্পর্কিত মৌখিক আশ্বাস নিয়ে ফিরে এসেছে। এর ফলে ভারতের প্রধানমন্ত্রী অপার স্বস্তি বোধ করবেন। পশ্চিম পাকিস্তানের জেনারেলগণ নিজেদের দুবুর্দ্ধির ফলে সৃষ্ট নিপীড়নমূলক পথের শেষ প্রান্তে উপনীত হয়েছে। তারা যুদ্ধ শুরু করে পরাজয় স্বীকার করতে পারে, কিংবা আলোচনার মাধ্যমে বিদায় গ্রহণ করতে পারে। এরপর তাদের পক্ষে ক্ষমতায় টিকে থাকা সম্ভব। নয়; প্রতারণামূলক গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করাও সম্ভব নয়। (“দি গার্ডিয়ান” ৯ নভেম্বর)

Reference:

একাত্তরের দশ মাস – রবীন্দ্রনাথ ত্রিবেদী