You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.11.14 | ২৭ কার্তিক ১৩৭৮ রবিবার ১৪ নভেম্বর ১৯৭১ | একাত্তরের দশ মাস – রবীন্দ্রনাথ ত্রিবেদী - সংগ্রামের নোটবুক

২৭ কার্তিক ১৩৭৮ রবিবার ১৪ নভেম্বর ১৯৭১

মুন্সিগঞ্জ (ঢাকা) বীর মুক্তিযোদ্ধারা এদিন মুন্সিগঞ্জ থানায় অপারেশন করে। থানা ভবনটি সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত হয়। এছাড়া স্থানীয় সিনেমা হলসহ আরো কয়েকটি অপারেশন মুক্তিযোদ্ধারা করে। পাকসেনারা ব্যাপক প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে ওঠে। বেশ ক’জন স্থানীয় লোকদের ধরে এনে নদীর পাড়ে গুলী করে হত্যা করে।

নওগাঁ শহরের দূরে থলবড় বাড়ীয়া গ্রামে মুক্তিবাহিনীর অবস্থানের উপর এদিন পাকসেনা ও রাজাকার আক্রমণ চালায়। এ যুদ্ধে ৫ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। তাঁরা হলেন, শহীদ আব্দুল লতিফ, আজিজার, আক্কাস, ইব্রাহীম ও আমজাদ। দুজন রাজাকার খতম হয়। উল্লেখ্য, এই এলাকায় মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠন এপ্রিল মাস থেকে গড়ে তোলেন আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দ। পরে সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদের ন্যাপের নেতৃবৃন্দ অংশগ্রহণ করে। এদের মধ্যে ছিলেন, সর্বজনাব মোহাম্মদ বায়তুল্লাহ (গণপরিষদ সদস্য) আওয়ামী লীগ নেতা মোহাম্মদ আব্দুল জলিল, ন্যাপ নেতা মোজহারুল হক পোনা প্রমুখ।

দিল্লী থেকে “দি টাইমস”—এর সংবাদদাতা পিটার হ্যাজেলহাস্ট কর্তৃক প্রেরিত এক সংবাদে বলা হয়, ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হলে ভারতীয় নৌবাহিনী কর্তৃক সমুদ্রপথে পূর্ব বংগের সংগে পশ্চিম পাকিস্তানকে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করার পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে।

ঢাকা থেকে প্রেরিত এক সংবাদে বলা হয়, পূর্ব বংগের যেসব এলাকা পাকিস্তান সৈন্যবাহিনীর আয়ত্তাধীন নয় সেসব এলাকায় জাতিসংঘের সাহায্য সামগ্রী বিতরণ করা সম্ভব নয় বলে এ্যাসিস্টেন্ট সেক্রেটারী জেনারেল মার্ক হেনরী বিদ্যমান পরিস্থিতি সম্পর্কে সেক্রেটারী জেনারেল উ থান্টের নিকট রিপোর্ট পেশ করার উদ্দেশ্যে তাঁর সফরসূচী সংক্ষিপ্ত করে (১৩ নভেম্বর) নিউইয়র্কের পথে রওয়ানা হন।(“দি সানডে টেলিগ্রাফ” ১৪ নভেম্বর)

‘বাংলাদেশ বাস্তব সত্য। পৃথিবীর কোন শক্তি তার বাস্তবতার পরিবর্তন করতে পারবে না।’ কংগ্রেস দলের কার্যকরী কমিটির সভায় ইন্দিরা গান্ধীর উক্তি। (“দ্য ফাইনাইন্সিয়াল টাইমস”নভেঃ ১৬, ৭১) ভারতের মন্ত্রিসভার রাজনৈতিক কমিটির নিকট বিগত ১৯ দিন পশ্চিম ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্র সফরের অভিজ্ঞতা বর্ণনায় শ্রীমতী গান্ধী বলেন, বিশ্ব নেতৃবৃন্দকে পূর্ববঙ্গ সমস্যার সমাধানের জন্য শেষ সুযোগ দেয়া হয়েছে, যদি তাঁরা ব্যর্থ হন, তবে ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা রক্ষার জন্য এবং সংকট নিরসনের জন্য যথোচিত ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। (টাইমস, নভেঃ ১৫)

ঢাকা সদর উত্তর এলাকার কমান্ডার রেজাউল করিম মানিক সাভারের অদূরে ভরাডুবি ব্রিজের অপারেশনে পাকবাহিনীর সঙ্গে প্রত্যক্ষ সংঘর্ষে শহীদ হন।

মুক্তিবাহিনীর গেরিলা দল টঙ্গী ও ধীরাশ্রমের মধ্যবর্তী রেললাইন তুলে ফেলে।

১১ নং সেক্টরের কমান্ডার মেজর আবু তাহেরের নেতৃত্বে ৫টি কোম্পানি নিয়ে ভোর ৩ টায় কামালপুর আক্রমণ করে। মুক্তিবাহিনীর লেঃ মিজান, ক্যাপ্টেন মান্নান এবং মুক্তিযোদ্ধা সাঈদের তিনটি কোম্পানি এবং ভারতীয় বাহিনীর দু’টি কোম্পানি মিলে আক্রমণ পরিচালনা করে। বাংলাদেশের এই অকুতভয় বীর মুক্তিবাহিনীর আক্রমণে পাকবাহিনীর ২টি কোম্পানি সেনা সহ একজন মেজর নিশ্চিহ্ন হয়। গুরুতরভাবে আহত হন মেজর আবু তাহের। তার একটি পা নষ্ট হয়ে যায়। তিনি পুনা সামরিক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থাকেন। তাঁর অনুপস্থিতিতে স্কোয়াড্রন লীডার হামিদুল্লাহ সেক্টরের দায়িত্ব হাতে নেন। (১০ খৃঃ পৃঃ ৬৪৪) উল্লেখ্য, ১১ নং সেক্টরের এলাকায় সম্পূর্ণ নিজের প্রচেষ্টায় মেজর আফসার (ভালুকা), সুবেদার আলতাফ (রৌমারী), কাদের সিদ্দিকী (টাঙ্গাইল) শক্তিশালী নিজস্ব বাহিনী গড়ে তুলেন। তাঁদের প্রত্যেকের পাকসেনা মোকাবেলার স্বতন্ত্র ইতিহাস রয়েছে।

ঢাকায় পূর্ব পাকিস্তান জামাতে ইসলামীর এক বিবৃতিতে পাকিস্তানের অস্তিত্ব ধ্বংসে উদ্যত ভারতের বিরুদ্ধে একতাবদ্ধভাবে জেহাদের (পবিত্র যুদ্ধের) প্রস্তুতি গ্রহণের জন্য জনগণের প্রতি আহ্বান জানানো হয়। জামাতের মজলিশে সুরার বৈঠকে গৃহীত এক প্রস্তাবে বলা হয় দুষ্কৃতকারীরা (মুক্তিযোদ্ধা) জনগণের শত্ৰু। তাদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ গড়ে তুলতে জামাতকে সহযোগিতা করার জন্য নাগরিকদের প্রতি আহ্বান জানানো হয়। (সংবাদপত্র)

পিডিপি নেতা নূরুল আমিন পূর্বাঞ্চল থেকে প্রধানমন্ত্রী নিয়োগের দাবী জানান। তিনি বলেন, সংখ্যাগরিষ্ঠ পূর্বাঞ্চল থেকে প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ না করা হলে সেখানে অবিশ্বাস আরো বৃদ্ধি পাবে। তিনি রাজাকারদের স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র প্রদানের জন্য ইয়াহিয়ার কাছে আবেদন জানান।

চীনপন্থী বামদলে এ মাসে নতুন একটি উপসর্গ দেখা দেয়। ভারত কর্তৃক বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামকে সমর্থন দানের জন্য কিছুসংখ্যক চীনাপন্থী বাঙালী ভারতের বিরুদ্ধে নানা প্রকার কুৎসা প্রচারে আত্মনিয়োগ করে। চীনের বাংলাদেশ বিরােধী নীতির সমর্থকরা দাবী করে, মুজিবনগর সরকারের প্রতি ভারতের সমর্থন দুরভিসন্ধিমূলক। বাংলাদেশকে ভারতের উপনিবেশে পরিণত করাই তাদের আসল উদ্দেশ্য।

ভারত বিরোধী প্রচারে চীনপন্থীরা মৌলানা ভাসানীর নাম ব্যবহার করতে দ্বিধাবোধ করেনি। ভারতে ও বিদেশে প্রচারিত বিবৃতিতে বলা হয়, মুক্তিযুদ্ধের অগ্রগতি ব্যাহত করার জন্য ভারত সরকার মৌলানা ভাসানীকে কার্যতঃ গৃহবন্দী অবস্থায় দিন যাপন করতে বাধ্য করেছে। শেষ পর্যন্ত তিনি তাঁর ভক্তদের এই মিথ্যা প্রচারণার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাবার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেন। ১২ নভেম্বর বিচারপতি চৌধুরীর নিকট লিখিত এক পত্রে তিনি গৃহবন্দী থাকার সংবাদ দুরভিসন্ধিমূলক বলে উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, যে কোন জায়গায় যাওয়ার সম্পূর্ণ স্বাধীনতা তিনি ভোগ করছেন। বর্তমান বিপজ্জনক পরিস্থিতিতে তিনি প্রকাশ্যে চলাফেরা এবং প্রত্যেককে সাক্ষাৎ দান নিরাপদ ও বুদ্ধিমত্তার পরিচায়ক নয় বলে মনে করেন। পত্রের উপসংহারে তিনি ভারত সরকার কর্তৃক বাঙালী শরণার্থীদের নিঃস্বার্থভাবে সাহায্যদানের জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। (স্বাধীনতা সংগ্রামে প্রবাসী বাঙালী পৃঃ ১৮২-৮৩)

এদিন সাত নম্বর সেক্টরের হামজাপুর-সাব সেক্টর বাহিনীর ১০ জন মুক্তিযোদ্ধা দিনাজপুর জেলার খানপুর বি ও পি আক্রমণ করে। সংঘর্ষে ৩০ জন পাকসেনা নিহত হয়। মুক্তিবাহিনীর হাবিলদার ইমান আলীসহ বেশ কয়েকজন আহত হলেও খানপুর বি ও পি মুক্তিবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে চলে আসে।

Reference:

একাত্তরের দশ মাস – রবীন্দ্রনাথ ত্রিবেদী