৭ অগ্রহায়ণ, ১৩৭৮ বুধবার, ২৪ নভেম্বর ১৯৭১
মুক্তিযোদ্ধা গেরিলা দলের ব্যাপক বোমা নিক্ষেপের ঘটনা ঘটার পর পাকসামরিক সরকারের বেসামরিক গভর্ণরের নির্দেশে ঢাকায় কারফু জারী করা হয়। রেডিও পাকিস্তান থেকে ঘোষণা দেয়া হয়। দুষ্কৃতকারীদের সংবাদ বা সন্ধান দিতে পারলে পুরস্কৃত করা হবে। উল্লেখ্য, ঢাকায় প্রশাসন বলতে সামরিক যানবাহনে সাদা ও লাল পতাকাবাহী নর-নারীর আর্তনাদ ছাড়া কিছু নেই। ৩৫ জন জাতিসংঘ সাহায্য কর্মী ঢাকা থেকে ব্যাংককে গিয়ে পৌঁছেন। তাঁদের একজন সংবাদপত্রে ফাঁস করে দেন যে, ঢাকায় এখন অসহনীয় পরিস্থিতি বিরাজ করছে।
মুক্তিবাহিনীর বীর যোদ্ধারা সিলেট, যশোর, কিশোরগঞ্জ এবং রাধানগর শহর এলাকায় ব্যাপক তৎপরতা চালাচ্ছে। অনেকস্থানে পাকসেনাদের ঘিরে রেখেছে। (সংবাদপত্র)
যশোরের বয়রা সীমান্তে মেজর হুদার নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনী হানাদার পাকবাহিনীর উপর সঁড়াশি আক্রমণ চালিয়ে বহু এলাকা দখল করে নেয়। এই যুদ্ধে পাক-বাহিনী তাদের সর্বশক্তি নিয়োগ করে। বাহিনীর সাঁড়াশি আক্রমণের মুখে না টিকতে পেরে সাতক্ষীরা চলে যায়। সেখানেও না টিকতে পেরে শেষ পর্যন্ত সাতক্ষীরা-খুলনা রাস্তা ধরে খুলনার নিকটে ঘাঁটি গেড়েছিল। এমনিইভাবে পতন হলো যশোর সদর ও সাতক্ষীরার এলাকা। উল্লেখ্য, মুক্তিবাহিনী এদিন হেলিকপ্টার সগ্রহ করে।
এদিন সন্ধ্যায় পাক-সরকারের মুখপাত্র রাওয়ালপিণ্ডিতে বলেন যে, পাকিস্তান উপমহাদেশের পরিস্থিতি স্বাভাবিক ও ভারতের হামলাবন্ধ করার ক্ষেত্রে যে কোন বৃহৎ শক্তির উদ্যোগকে স্বাগত জানাবে। তিনি বলেন পূর্বপাকিস্তান পরিস্থিতির একমাত্র সমস্যা হলো উদ্বাস্তুদের প্রত্যাবর্তন। (দৈঃ পাঃ)। এ সময়ের শরণার্থীদের নিয়ে যে রাজনীতির স্রোত চলছিল সে সম্পর্কে টাইম ম্যাগাজিন পরবর্তীতে উল্লেখ করে যে, “Today India’s worst fear is that many of the refugees will refuse to go back to East Pakistan under any conditions. Nearly 8,00,00,00 of them are Hindus, who were singled out by the Moslem military for persecution. Pakistan, moreover, claims that only 2,000,000 Pakistani refugees are in India, a figure that corresponds to the number of Moslems who have fled. This coincidence may suggest that even if there were a settlement, the Pakistanis would refuge to permit the Hindus to return.”
টাইম ম্যাগাজিন ডিসেম্বর ৬ সংখ্যায় আরো মন্তব্য করে, “A confidential report recently submitted to Mrs. Gandhi’s cabinet concluded: “The most alarming prognosis is that not even 10% of the Hindu evacuees may choose to go back. If this becomes a reality, it might be disastrous for West Bengal’s economy, and this economic disaster is bound to bring in its train serious socio-political problems of perhaps unmanageable dimensions.”(Time magazine 6.12.71 PP. 12)। উল্লেখ্য, এসময়ে আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ সর্বজনাব মিজানুর রহমান চৌধুরী, মিসেস বদরুন্নেছা আহমেদ, কে, এম, ওবায়ুদুর রহমান, ফনী মজুমদার, গৌর চন্দ্র বালা ও আবদুর রব ছেরনিয়াবাৎ প্রমুখ নেতৃবৃন্দ শরণার্থী শিবিরগুলোতে স্বদেশবাসীদের ‘সম্মানের সঙ্গে দেশে ফিরে যাবে’ বলে আশ্বাস দেন। ছাত্র নেতৃবৃন্দ পশ্চিম বাংলার বিভিন্ন শিবিরে জনসভায় ভাষণ দেন। রাফিয়া আখতার ডলি এমএনএর সঙ্গে লেখককেও অনুরূপ কয়েকটি শরণার্থী সভায় বক্তব্য রাখতে হয়। ভারতের প্রাক্তন মন্ত্রী এ বি এ গণি খান চৌধুরী কলকাতায় শিয়ালদহ এ ধরনের সভায় বক্তব্য রাখেন।
পাকসেনাদের কুকর্মের দোশর রাজাকার বাহিনী গানবোট নিয়ে সুজানগর থানাধীন নাজিরগঞ্জ (পাবনা) এলাকায় অত্যাচার চালায়। মুক্তিবাহিনীর গেরিলাদের সাথে রাজাকার দলের
সংঘর্ষে রাজাকার দলের গানবোট আত্মসমর্পণ করে। পরে সবকজন রাজাকারকে গেরিলারা হত্যা করে। নাজিরগঞ্জ এলাকায় মুক্তিযোদ্ধাদের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে চলে আসে।
আই নম্বর সেক্টর কমান্ডার লেঃ কর্ণেল মঞ্জুরের নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনী চৌগাছা দখল করে। এই যুদ্ধে পাকসেনারা চৌগাছায় ৪টি শাফি ট্যাংক হারায়।
পাকিস্তান আক্রান্ত হওয়ার আশংকা প্রকাশ করে ২৩ নভেম্বর ইয়াহিয়া খান সমগ্র দেশে জরুরী পরিস্থিতি ঘোষণা করে।
রাওয়ালপিন্ডি থেকে ২৩ নভেম্বর “দি টাইমস”-এর সংবাদদাতা কর্তৃক প্রেরিত এক সংবাদে পাকিস্তানের জনৈক সামরিক মুখপাত্রের বিবৃতি উদ্ধৃত করে বলা হয়, যশোর ও সিলেট জেলার কয়েকটি ছোট ছোট এলাকা ভারতীয় সৈন্যরা দখল করেছে।
পূর্ব বঙ্গের দেবহাটা থেকে উপরোক্ত তারিখে এ্যাসোসিয়েটেড প্রেসের সংবাদদাতা সন্তোষ বসাক কর্তৃক প্রেরিত এক সংবাদে মুক্তিযোদ্ধাদের বিবৃতি উল্লেখ করে বলা হয়, পাকিস্তানী সৈন্যবাহিনীকে উচ্ছেদ করার সংগ্রাম গতকাল (২২ নভেম্বর) শুরু হয়েছে। এই যুদ্ধকে তাঁরা “জীবন-মরণ সংগ্রাম”বলে উল্লেখ করেন। (“দি টাইমস, ২৪ নভেম্বর, ১৯৭১)
ওয়াশিংটন মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের এক ঘোষণায় বলা হয় সিনেটররা পূর্ব পাকিস্তান সীমান্তে বাহিনী ও পাকিস্তান সেনাবাহিনীর যুদ্ধের কথা উল্লেখ করে ভারত-পাকিস্তান সংকটের প্রেক্ষিতে অবিলম্বে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠক ডাকার আহ্বান জানিয়েছেন।
ফ্রান্স, বৃটেন ও পশ্চিম জাৰ্মানী ভারত-পাকিস্তান সঙ্কটে উদ্বেগ প্রকাশ করে উভয় রাষ্ট্রকে সংযত আচরণ করার জন্যে আহ্বান জানায়।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী মিসেস ইন্দিরা গান্ধী পার্লামেন্টে বললেন, ভারত সরকার জাতীয় জরুরী অবস্থা ঘোষণা করবে না। তিনি পাকিস্তানের সাথে ভারতের অঘোষিত যুদ্ধ সম্পর্কিত পাকিস্তানের অভিযোগকে সম্পূর্ণ মিথ্যা বলে অভিহিত করেন। In a statement on Nov. 24 to both Houses of the Indian Parliament, Mrs. Gandhi described President Yahya Khan’s declaration of a state of emergency as “the climax of his efforts to divert the attention of the world from Bangladesh and to put the blame on us for the situation which he himself has created” and said that “we shall refrain from taking a similar step, unless further aggression by Pakistan compels us to do so.”
“Since the recession of the monsoons.”said Mrs. Gandhi “The success of the Mukti Bahini lhave apparently upset the plans of themilitary regime. The Liberation forces of Bangladesh, with the full support of their entire people, have taken a heavy toll of Pakistan’s armed forces and have freed large parts of their homeland…. Pakistan’s armed forces have been shelling our border area, Inflicting damage on life and property. (KCA, 24995)
২৩শে নভেম্বর “দি নিউ ইয়র্ক টাইমস”-এর সম্পাদকীয় মন্তব্যে বলা হয়, উপমহাদেশে শান্তি স্থাপনের ব্যাপারে জাতিসংঘ যদি কার্যকরী ভূমিকা গ্রহণ করতে চায়, তা’হলে ইয়াহিয়া খান কর্তৃক শেখ মুজিবসহ পূর্ববঙ্গের নির্বাচিত নেতৃবৃন্দের সঙ্গে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য ক্রমবর্ধমান আন্তর্জাতিক চাপ বিশ্বসংস্থা কর্তৃক সমর্থন করা উচিত। একমাত্র রাজনৈতিক মীমাংসার মাধ্যমে পাক-ভারত সীমান্ত থেকে সৈন্যবাহিনী সরিয়ে নিয়ে নিপীড়িত বাঙ্গালীদের উদ্ধার করা সম্ভব।
Reference:
একাত্তরের দশ মাস – রবীন্দ্রনাথ ত্রিবেদী