৮ অগ্রহায়ণ, ১৩৭৮ বৃহস্পতিবার, ২৫ নভেম্বর
২৫ নভেম্বর “দি ওয়াশিংটন পোষ্ট”-এর সম্পাদকীয় মন্তব্যে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধকে রীতিমত বিয়োগান্ত ঘটনা হিসাবে উল্লেখ করে বলা হয়, পাকিস্তানীরা তাদের নাগরিকদের এক অংশের উপর আক্রমণ চালিয়ে রীতিমত ভুল করে। তাছাড়া, আঁশী লক্ষ থেকে এক কোটি আক্রান্ত নাগরিকদের ভারতে আশ্রয় গ্রহণ করতে বাধ্য করে তার কৌশলগত ভুল করে। এর ফলে ভারত গুরুভার বহন করতে বাধ্য হয়। প্রথম ভারত বাঙালী বিদ্রোহীদের আশ্রয় ও সামরিক শিক্ষাদান করে। এরপর যুদ্ধ পরিচালনায় সহায়তা করে প্রত্যুত্তরে পাকিস্তান তার সংকীর্ণতা কিংবা দুর্বলতার জন্য বাঙালীদের সঙ্গে আপসের পরিবর্তে বাঙালীও তাদের ভারতীয় সমর্থকদের বিরুদ্ধে আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করে। পরিণামে যুদ্ধ শুরু হয়।
মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনীর প্রচন্ড আক্রমণে পাকবাহিনী কুড়িগ্রাম থেকে পালিয়ে যায়। এ যুদ্ধেও ভারতীয় বিমানবাহিনী শত্রুর অবস্থানের উপর বোমাবর্ষণ করে। ভুরুঙ্গামারী, রায়গঞ্জ ও কুড়িগ্রামে পাকবাহিনীর কাছ থেকে মুক্তিবাহিনী প্রচুর পরিমাণ অস্ত্র, গোলাবারুদ ছয়টি জীপ, দশটি মিলিটারী ট্রাকসহ অন্যান্য যানবাহন এবং চাইনিজ এস.এল.আর, এল এম জি, বৃটিশ এল এম জি, ২৬ ইঞ্চি কামান, বিভিন্ন ধরনের মটার, রাইফেল, ওয়্যারলেস সেট দখল করে। কুড়িগ্রামের কোর্ট ভবনে স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন করা হয়। মুক্ত এলাকার সদর দপ্তর স্থাপন করা হয়। বিপ্লবী বাংলাদেশ সরকার মুক্ত এলাকার বেসামরিক প্রশাসন প্রতিষ্ঠা করলেন (১০ খঃ পূঃ ৭৭৭)
চার নম্বর সেক্টর কমান্ডার কর্নেল দত্তের পরিকল্পনানুযায়ী মুক্তিবাহিনী কানাইঘাট দখলের সিদ্ধান্ত নেয়। উল্লেখ্য, ‘জেড ফোর্স’ কমান্ডার কর্নেল জিয়া ক্যাপ্টেন রবকে কানাইঘাট দুরবশত সড়কে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে নির্দেশ দিয়েছিলেন ২৩ নভেম্বর।
ভুরুঙ্গামারীর মুক্তাঞ্চল পরিদর্শন করেন বিপ্লবী বাংলাদেশ সরকারের ত্রাণ ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জনাব এ. এইচ. এম. কামরুজ্জামান। তিনি দিনহাটা সাহেবগঞ্জও পরিদর্শন করেন। ভারতের ফরওয়াদি ব্লক নেতা কমল গুহ ও কংগ্রেস নেতৃবৃন্দ এম পি এ শামছুল হক চৌধুরী, মতিউর রহমান এম এন এ, শাহ আবদুর রাজ্জাক এম পি এ আঞ্চলিক প্রশাসক ফয়েজ উদ্দিন আহমেদ বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জনাব কামরুজ্জামানের সঙ্গে ছিলেন।
নারায়ণগঞ্জের দুটো পাটের গুদাম ও ময়মনসিংহ জেলার নান্দিনায় জুট মার্কেটিং কর্পোরেশনের একটি গুদাম আগুন দিয়ে সম্পূর্ণরূপে পুড়িয়ে ফেলা হয়। (দৈঃ পাঃ)
স্বাধীনবাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে এদিন ইংরেজি সংবাদ পর্যালোচনায় প্রখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালক ও সাংবাদিক আলমগীর কবির জানালেন, “The war of Bangladesh National Liberation has now gone well into the decisive stage. Liberation of Jessore town is imminent… The frantic withdrawal of Pakistani troops are collaborators from Jessore over last few days indicates that the the killer invaders are already on the run”, উল্লেখ্য, জনাব কবির জুন-নভেম্বর ৭১ এ ছয় মাসে নিয়মিত সংবাদ পর্যালোচনা লিখেছেন। তিনি মুক্তিযুদ্ধের ৪টি ডকুমেন্টারী ফিল্ম পরিচালনা করেন। সবগুলোই বাংলাদেশের ইতিহাসের অমূল্য দলিল। এ সময়ে প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার জহীর রায়হানের ‘ষ্টপ জেনোসাইড’এর প্রেস শো করাহয়।
২৩ নভেম্বরে সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টির মুখপত্র “প্রাভদা”—এ প্রকাশিত এক নিবন্ধে বলা হয়, পাকিস্তান কর্তৃক বাস্তুত্যাগীদের দেশে ফিরে যাওয়ার উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি এবং জনগণকে নিপীড়নের নীতি পরিহার করে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধ এড়ানো সম্ভব। এই নিবন্ধে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে কঠোর ভাষা ব্যবহার করা হয়। (ফাইন্যান্সিয়াল টাইমস্)।
২৪ নভেম্বর ‘দি গার্ডিয়ান’-এর সম্পাদকীয় নিবন্ধে বলা হয়, জাতিসংঘের মতামতকে উপেক্ষা করে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে সংগ্রামরত মুক্তিযোদ্ধারা এগিয়ে যাবে। যুদ্ধের অবসান ঘটাতে হলে শেখ মুজিবের মুক্তি এবং বাঙালীদের স্বায়ত্বশাসন লাভের অধিকার সম্বলিত প্রস্তাব পেশ করতে হবে। এ ধরনের উদ্যোগ ছাড়া রক্তপাত বন্ধ করার কোন সম্ভাবনা নেই।
লাহোরে পূর্ব পাকিস্তান জামাতে ইসলামীর আমীর অধ্যাপক গোলাম আজম এক বক্তৃতায় ভারতের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক যুদ্ধ শুরু করার আহ্বান জানিয়ে বলেন, বর্তমান পরিস্থিতি পূর্ব পাকিস্তানের অস্তিত্বের প্রতি একটি ভয়ানক চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
দৈনিক পাকিস্তানে প্রকাশিত হয় দুষ্কৃতকারীদের ব্যাপারে নিম্নহারে পুরস্কারের ঘোষণাঃ
(ক) দুষ্কৃতকারীর সাথে মোকাবেলা খবর দেওয়ার জন্য ৫০০.০০ টাকা
(খ) ভারতে ট্রেনিংপ্রাপ্ত দুষ্কৃতকারী গ্রেফতারের জন্য ৭৫০.০০ টাকা।
(গ) আগ্নেয়শাস্ত্র গ্রেফতারের জন্য ১০০০.০০ টাকা।
(ঘ) দুষ্কৃত দলের নেতা গ্রেফতারের জন্য ২০০০.০০ টাকা। দুষ্কৃতদলের নেতা ও অস্ত্রশস্ত্র উদ্ধারসহ গ্রেফতারের জন্য ১০,০০০.০০ টাকা পর্যন্ত পুরস্কার দেবার বিষয় বিবেচিত হতে পারে।
জেলা পুলিশ সুপারিন্টেন্টে এক হাজার টাকা পর্যন্ত মঞ্জুর করতে পারবেন। দুষ্কৃতকারীদের শ্রেণীবিভাগ নিম্নরূপ।
(ক) তথাকথিত মুক্তিবাহিনীর নিয়মিত সদস্য, মুক্তিবাহিনীতে ভর্তিতে সাহায্যকারী।
(খ) স্বেচ্ছায় বিদ্রোহীদের আশ্রয়দানকারী।
(গ) বিদ্রোহীদের বার্তাবাহক, নাশকতামূলক লিফলেট লেখক বা প্রকাশক।
(ঘ) স্বেচ্ছায় বিদ্রোহীদের খাদ্য, যানবাহন ও অন্যান্য দ্রব্য সরবরাহকারী।
উল্লেখ্য, এই ধরণের বিজ্ঞাপন ও রেডিও ঘোষণা দ্বারা শহর এলাকায় মুক্তিযোদ্ধা গেরিলাদের আশ্রয় নেয়া খুবই বিপদ সংকূল হয়ে পড়ে। সে কারণে মুক্তিযোদ্ধাদের শহরতলী, নদীপাড়াপাড়া এলাকা এবং নিভৃত বিল এলাকায় আশ্রয়স্থল খুঁজে বের করতে হয়েছিল। মে মাস থেকেই অবরুদ্ধ বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে এধরনের পকেট সৃষ্টি করা হয়। অক্টোবর থেকে দেশজুড়ে গেরিলা তৎপরতায় পাকসেনারা ‘কাহা মুক্তি’ বলে আতংকগ্রস্ত হয়ে পড়েছিল। চরমপত্রের ভাষায় ‘বিচ্ছুগো গাবুরে মায়ে-ডুমাডুমা খান সেনাগো’ কুপকাৎ হয়ে পড়ে। (লেখক)
শরণার্থী হিসেবে বাঙালীদের ভারত আশ্রয় গ্রহণ সম্বন্ধে বিভিন্ন তারিখের এক পরিসংখ্যানে বলা হয় যে, ভারতে ২২ আগষ্ট পর্যন্ত শরণার্থীদের সংখ্যা ছিল ৭,৯০০,০০০ সেপ্টেম্বর ৬ তারিখে দাঁড়াল ৮,৩০০,০০০ সেপ্টেম্বর ২০ তারিখে দাঁড়াল ৮,৯০০,০০০, অক্টোবর ৬ তারিখে দাঁড়াল ৯,১৪৬,৫০০, অক্টোবর ১৫ তারিখে ৯,৩৫০, ৮৬৬ এবং নভেম্বর ১৯ দাঁড়াল শরণার্থীর সংখ্যা ৯,৭০০,০০০। দৈনিক গড় হিসাবে মার্চ থেকে মে মাসে ৬৮,০০০ হাজার থেকে জুন-জুলাই মাসে দৈনিক গড়ে ২৬,০০০ হতে ৪০,০০০ হাজার। এই পরিসংখ্যান জাতিসংঘ সমর্থিত।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের মনস্তত্ত্ব বিভাগের প্রধান ডঃ মতিয়ুর রহমানই ছিল রাজশাহীতে পাক-হানাদার বাহিনীর প্রধান দোসর। হত্যা, লুণ্ঠন, ধর্ষণ উৎপীড়ন সর্বপ্রকার অমানবিক এবং পাশবিক কার্যে তিনিই প্রত্যক্ষ সংগঠক। এদিন রাতে তৈয়ব আলী রেজিষ্ট্রারের ষ্টেনো ডেকে নিয়ে যায় অধ্যাপক মীর আবদুল কাইয়ুমকে। রাতের অন্ধকারে তাকে বধ করে পুঁতে ফেলা হল পদ্মার বালুচরে একগর্তে আরোও ১৩ জনের সঙ্গে। প্রথমে মনস্তত্বের অধ্যাপক কাইয়ুমের লাশ তার উপরে স্তূপীকৃত আরও তেরটি হতভাগা বাঙালী, যার একজন ছিলেন মহিলা। (পূর্ব দেশ ১/১২/৭২)।
“দি টাইমস”—এর সম্পাদকীয় মন্তব্যে বলা হয়, পাকিস্তানের দু’অংশকে একত্রিত করে পূর্বাবস্থায় ফিরে যাওয়ার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। বর্তমান উত্তেজনাকর পরিস্থিতিতে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান মন্থরগতিতে স্বাভাবিক রাজনৈতিক অবস্থা ফিরিয়ে আনবে কিংবা শেষ পর্যন্ত শুভেচ্ছার প্রতীক হিসাবে শেখ মুজিবকে মুক্তিদান করবে এই আশায় ভারত ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করবে বলে আশা করা যায় না। অপরপক্ষে, ভারত বিভাগের নীতির প্রতি আস্থাশীল প্রবীণ পাকিস্তানী নেতৃবৃন্দের নিকট পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতা অচিন্তনীয়। এ ব্যাপারে নবীনদের সহানুভূতি থাকা অসম্ভব নয়। ভারতের সঙ্গে অন্তহীন ঝগড়ার অবসান হলে পশ্চিম পাকিস্তান অতি সহজেই তার ভৌগলিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক সত্ত্বা খুঁজে পাবে। (“দি টাইমস, ২৪ নভেম্বর”)
Reference:
একাত্তরের দশ মাস – রবীন্দ্রনাথ ত্রিবেদী