You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.11.28 | ১১ অগ্রহায়ণ, ১৩৭৮ রবিবার, ২৮ নভেম্বর ১৯৭১ | একাত্তরের দশ মাস – রবীন্দ্রনাথ ত্রিবেদী - সংগ্রামের নোটবুক

১১ অগ্রহায়ণ, ১৩৭৮ রবিবার, ২৮ নভেম্বর ১৯৭১

এ সময়ের মুক্তিযুদ্ধের পরিস্থিতি বর্ণনা করতে গিয়ে প্রধান সেনাপতি কর্নেল (পরে জেনারেল) মুহম্মদ আতাউল গনি ওসমানী বলেন, অক্টোবর-নভেম্বর থেকেই পাকিস্তান বাহিনী বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে আন্তর্জাতিককরণের প্রচেষ্টা চালাচ্ছিল। যাতে তাদের জান বাঁচে, জাতিসংঘের হস্তক্ষেপের পরে একটা যুদ্ধবিরতি হয়, অবজারভার এসে যায় এবং জাতিসংঘের কাছে সমস্যাটি দিয়ে তাদের জান রক্ষা করে। শত্রুপক্ষের এই ছিল প্রচেষ্টা। কারণ, তখন তারা নিশ্চিন্ত হয়ে গিয়েছিল যে, তাদের পরাজয় একেবারে অনিবার্য। (দৈঃ বাঃ ৩/১২/৭২)

পাক সরকারের মুখপাত্র রাওয়ালপিণ্ডিতে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে চীনা পররাষ্ট্র মন্ত্রীর বক্তব্য সম্পর্কে বলেন, গণচীন পরিস্থিতি সম্পৰ্কে নিজস্ব সিদ্ধান্তে পৌঁছেছে। যখন সোভিয়েট অস্ত্র সমানে ভারতে আসছে তখন মস্কো দিল্লী চুক্তি পাকিস্তানের বিরুদ্ধে নয়-সোভিয়েটের এই অভিমত পাকিস্তান কি করে বিশ্বাস করবে। মুখপাত্র বলেন, আমাদের আগের ধারণা পরিস্থিতি আমাদের বিশ্লেষণভিত্তিক ছিল। কিন্তু আমাদের অভিজ্ঞতায় দেখছি মস্কো-দিল্লী চুক্তিটি ভারতকে উৎসাহ যোগাচ্ছে। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে শত্ৰুতা বাড়িয়েছে, এবং ভারতের মনোভাব কঠোরতর করছে।

মুক্তিবাহিনীর অকুতোভয় বীর মুক্তিযোদ্ধাগণ কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামাধীন জগন্নাথ দীঘি সীমান্ত ফাঁড়ি থেকে পাকহানাদার বাহিনীকে হটিয়ে দিয়ে স্বাধীন বাংলা পতাকা উত্তোলন করে জসিমউদ্দিন আহমেদ চৌধুরী। ১৬ জন মুক্তিযোদ্ধা এ কৃতিত্বের দাবীদার।

এদিন কর্নেল এম. এ. জি. ওসমানী যুক্তিবাহিনীর ৯ নং সেক্টর পরিদর্শন করেন। হিঙ্গলগঞ্জ যুদ্ধে মুক্তিবাহিনী ৪০ জন পাকসেনাকে বন্দী করে। কালিগঞ্জ শত্রুমুক্ত হয়। উল্লেখ্য ৯ নং সেক্টর কমান্ডার মেজর জলীল গত ১৫ নভেম্বর সাব সেক্টর কমান্ডারদের নিয়ে কনফারেন্স করেন।

লেঃ জেনারেল এ. এ. কে. নিয়াজী গতকাল সাভারে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত রাজাকার কোম্পানি কমান্ডারদের প্রথম দলের বিদায়ী কুচকাওয়াজ পরিদর্শন করেন এবং অভিবাদন গ্রহণ করেন। (দৈঃ পাঃ ৭খঃ পূঃ ৬৩৪)

লেঃ জেনারেল এ. এ. কে. নিয়াজী গতকাল হিলি এলাকা পরিদর্শন করেন। তিনদিন যাবত এখানে তীব্র সংঘর্ষ হচ্ছে। জেঃ নিয়াজী যখন সৈন্যদের দেখার জন্য অগ্রবর্তী এলাকায় যাচ্ছিলেন তখন ভারতীয় কামানের ছয়টি গোলা এসে পড়ে। তবে কোন ক্ষতি হয়নি। (দৈঃ পাঃ ৭ খৃঃ পূঃ ৬৩৫)

‘পাকিস্তান টাইমস’ এ প্রকাশিত এক বিবৃতিতে জামাতে ইসলামের আমীর অধ্যাপক গোলাম আযম দেশের বর্তমান পরিস্থিতি মোকাবিলা করার জন্য তিনটি প্রস্তাব দেন—ভারতকে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আক্রমণ করা; পূর্ব পাকিস্তানে দেশপ্রেমিকদের যথাযথভাবে অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত করা এবং সে প্রদেশের দেশ প্রেমিকদের ওপর আস্থা রাখা। (বিডি-২ পৃঃ ১৪১)

ন্যাপ সেক্রেটারী সৈয়দ আলতাফ হোসেন বলেন, ইয়াহিয়া খান সিন্ধু, বেলুচিস্তান ও উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের মুক্তি সংগ্রামের আশঙ্কায় ন্যাপ সংগঠন নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে। তিনি বলেন, ন্যাপই একমাত্র দল যা শুরু থেকে পাকিস্তানের সকল মানুষের আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকারের কথা বলে আসছে। বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রাম পাকিস্তানের সব অঞ্চলে আলোড়ন সৃষ্টি করবে। (সংবাদপত্র)

২৬ নভেম্বর চারগ্রাম শত্রুমুক্ত হয় এবং ২৮ নভেম্বর চরখাই এলাকায় শত্রুর মুখোমুখি হতে হয়। চরখাই এলাকায় পাকবাহিনীর একটি ব্যাটালিয়ন সুদৃঢ় প্রতিরক্ষা অবস্থান নিয়েছিল। ১ম ইস্ট বেঙ্গলকে কানাইঘাট দখল করে সিলেট অভিমুখে যেতে নির্দেশ দেয়া হয়। ‘এ’ কোম্পানীকে গৌরীপুরে ডিফেন্স নিতে বলা হয়। অন্যদিকে ‘বি’ ও ‘সি’ কোম্পানি যথাক্রমে চরখাই ও আটগ্রামে নিয়োজিত রাখা হয়। ২৯ নভেম্বর কানাইর ঘাটে শত্রুর অবস্থান রেকী করা হয়।

‘বি’কোম্পানী এলাকায় মেশিনগানের গুলীবৰ্ষণের শব্দ শোনা যায়। লেঃ ওয়াকার হাসান (বর্তমানে অবসরপ্রাপ্ত মেজর ও স্বাধীনতাযুদ্ধে বীরপ্রতীক খেতাবপ্রাপ্ত) প্রতিরক্ষা অবস্থানে প্রস্তুত হয়েই ছিলেন। ভোর পাঁচটায় পাকসেনাদের কামানের গোলা নিক্ষেপ শুরু হলো। প্ৰায় আধঘন্টা ধরে এই গোলা নিক্ষেপ চলে। তারপর পাকসেনারা আক্রমণ করে। অগ্রবর্তী দুই প্লাটুনের ফাঁক দিয়ে শক্ৰ ঢুকে পড়ে। লেঃ ওয়াকার মেশিনগান দলকে গুলীবর্ষণ অব্যাহত রাখতে নির্দেশ দিয়ে ২০০ গজ সামনে ডানদিকে প্লাটুনের দিকে দৌঁড়ে যান। প্রচন্ড গুলীবর্ষণের মধ্যে ওয়াকার হাসান ও তার সহযোগী যোদ্ধাদের সংগে পাকসেনাদের হাতাহাতি যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। প্রায় ৪৫ মিনিট প্রচণ্ড যুদ্ধের পরে কানাইরঘাট পুনর্দখল হয়। ৩১ পাঞ্জাব রেজিমেন্টের মেজর সরোয়ার ও ২৫ জন পাকসেনা আত্মসমর্পণ করে। ৮৭ জন পাকসেনার মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়। পাকসেনাদের অনেকেই নদীতে ঝাঁপ দিয়ে মৃত্যুবরণ করে। এই যুদ্ধে লেঃ গিয়াসের নেতৃত্বে এক কোম্পানি সৈন্য দরবশ- কানাইরঘাট সড়কে এবং লেঃ জহিরের নেতৃত্বে এক কোম্পানি সৈন্য কানাইঘাট চরখাই সড়কে কাট অফ পার্টি হিসেবে নিয়োজিত রাখা হয়। (সংগ্রহ)

মুক্তিবাহিনী দিনাজপুর, যশোর ও সিলেট জেলায় ব্যাপক আক্রমণ পরিচালনা করে। পক্ষান্তরে পাকিস্তান বেতার থেকে বলা হয়, ভারতীয় বাহিনী সিলেটের জকিগঞ্জ, আটগ্রাম ও তামাবিলে, দিনাজপুরের পচাগড় ও হিলি এবং যশোরের জীবননগরে সাঁজোয়া ও গোলন্দাজ ইউনিটের মাধ্যমে আক্রমণ চালায়।

ইয়াহিয়া-ভুট্টো সর্বশেষ পরিস্থিতি নিয়ে দু’ঘন্টা একান্ত আলোচনা হয়। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া সংযুক্ত কোয়ালিশন পার্টির সভাপতি নূরুল আমিনকে এদিন পিণ্ডি তলব করেন।

সোভিয়েত প্রেসিডেন্ট নিকোলাই পোদগর্নি প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার কাছে পাঠানো এক পত্রে বাংলাদেশের নেতা শেখ মুজিবুর রহমানকে নিঃশর্ত মুক্তিদানের পরামর্শ দেন।

মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন পাক-ভারত পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধ এড়ানোর জন্য ক্ষমতানুযায়ী সবকিছু করার অনুরোধ জানিয়ে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী মিসেস ইন্দিরা গান্ধী, পাকিস্তানী প্রেসিডেন্ট জেনারেল এ. এম. ইয়াহিয়া খান ও সোভিয়েত প্রধানমন্ত্রী আলেক্সি কোসিগিনের কাছে পত্ৰ পাঠান।

ভারতের প্রধানমন্ত্রী মিসেস ইন্দিরা গান্ধী রাজস্থানের জয়পুরে এক জনসভায় বলেন, ভারত পূর্ব বাংলার জনগণের মানবিক অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের প্রশ্নে জাতিসংঘ অথবা বৃহৎ শক্তিবর্গের চাপের মুখে নতি স্বীকার করবে না। তিনি বলেন, ভারত শান্তি চায়। পাকিস্তানের জনগণের সাথে ভারতের কোন বিবাদ নেই। কিন্তু তার নিরাপত্তা বিপদাপন্ন হলে সে চুপ করে বসে থাকবে না।

করাচীতে নূরুল আমিনের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত কোয়ালিশন পার্টির সভায় গৃহীত এক প্রস্তাবে পাকিস্তানের অখণ্ডতা রক্ষার স্বার্থে ভারতের বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণার জন্য সরকারের প্রতি আবেদন জানানো হয়।

প্রকাশ্য দিবালোকে বেইলী রোডের ইষ্টাৰ্ণ ব্যাংক শাখা লুট।

মুক্তিবাহিনী আড়িখোলা ও পূর্বইলের মধ্যবর্তী দুটি রেলসেতু উড়িয়ে দিলে ঢাকা নরসিংদী ট্রেন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়।

Reference:

একাত্তরের দশ মাস – রবীন্দ্রনাথ ত্রিবেদী