১২ অগ্রহায়ণ, ১৩৭৮ সোমবার, ২৯ নভেম্বর ১৯৭১
অবরুদ্ধ ঢাকার দৈনিক পাকিস্তান’ এ পাকি সরকারের মুখপাত্রের উদ্ধৃতি দিয়ে মুক্তিবাহিনী প্রচন্ড আক্রণের সংবাদ এভাবে প্রকাশ পায়, কুমিল্লা-নোয়াখালী সেক্টরে পাকিস্তানী সৈন্যদের সঙ্গে বিভিন্ন সংঘর্ষে আরো ৩০ জন ভারতীয় সৈন্য নিহত হয়েছে। কুমিল্লা সেক্টরের গুলবানিয়ায় ভারতীয়রা নতুন করে ক্ষয়-ক্ষতির সম্মুখীন হয়। সেখানে তাদের ১০ জন সৈন্য নিহত এবং তাদের দুটি হালকা মেশিনগান ও ৭টি রাইফেল আটক করা হয়েছে। ময়মনসিংহ সেক্টরের আরো বিশজন ভারতীয় সৈন্য নিহত হয়ছে। ভারতের নিয়মিত সৈন্য ও তাঁদের চরেরা এই সেক্টরে অনুপ্রবেশের চেষ্টা করে। কিন্তু পাকিস্তানী সেনাবাহিনী ও রাজাকারদের হাতে তারা প্রচুর ক্ষতি স্বীকার করতে বাধ্য হয়। সংবাদে আরো বলা হয়, ভারতীয়রা দিনাজপুর জেলার পচাগড়ে প্রচন্ড গোলাবর্ষণ করে। ভারতীয়রা সারা সীমান্তে উত্তেজনা বজায় রাখে এবং ময়মনসিংহ জেলার বরমারী, আকিপাড়া, কমলপুর, দক্ষিণ সিলেট এলাকার কেরামত নগর ও ফুলতলা, কুমিল্লা জেলার ব্রাহ্মণবাড়িয়া এলাকায় কায়েমপুর ও যশোরের হিরণ, জীবননগর, বাকশায় গোলাবর্ষণ করে। ভারতীয়দের আক্রমণের প্রধান লক্ষ্য ছিল, পূর্ব পাকিস্তানের পশ্চিম সীমান্ত যশোর। সেখানে দুই কোম্পানি ভারতীয় সৈন্য ট্যাংকের সাহায্যে চৌগাছা এলাকায় বুইন্দার দিকে আরো এগিয়ে যাবার চেষ্টা করে। পাকিস্তানী সৈন্যরা তাদের প্রচেষ্টা ব্যর্থ করে দেয়। দু’টি ভারতীয় কোম্পানী কুমিল্লা এলাকায় চাঁদ গাজীপুরে অগ্রসর হওয়ার চেষ্টা করলে পাকিস্তানি সৈন্যরা তাদেরকে প্রতিহত করে। গত ২২ নভেম্বর যশোরে প্রথম আক্রমণ শুরু হওয়ার পর ভারতীয় প্রচেষ্টা প্রতিহত করা হচ্ছে। যশোর সেক্টরের চৌগাছা এখনো ভারতীয়দের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। (দৈঃ পাঃ ৭খঃ পৃঃ ২৪১)
রাওয়ালপিণ্ডি থেকে এ্যাসোসিয়েটেড প্রেস কর্তৃক প্রেরিত এক সংবাদে বলা হয়, বাঙালী মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তানের সৈন্যবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে বলে সামরিক কর্তৃপক্ষের সংগে সংশ্লিষ্ট মহল ২৮ নভেম্বর সর্বপ্রথম স্বীকার করে।
পূর্ব বংগের জনসাধারণ মুক্তিবাহিনীর সংগে সহায়তা করছে বলে রাওয়ালপিণ্ডিতে নিয়োজিত জনৈক সামরিক মুখপাত্র প্রকাশ করে। তবে পূর্ব বংগের পরিস্থিতিকে ভিয়েতনামের গণযুদ্ধের সংগে তুলনা করা ভুল হবে বলে উপরোক্ত মুখপাত্ৰ মন্তব্য করে। (‘দি ডেইলি টেলিগ্রাফ ২৯ নভেম্বর, ১৯৭১)
২৯ নভেম্বর কেন্দ্ৰীয় শান্তি কমিটি ঢাকা শহরে একটি গণ মিছিল বের করে। বেলা ১৪০ মিনিটের দিকে গুলিস্তানের কামানের কাছ থেকে মিছিলের যাত্রা শুরু হয়। খাজা খয়েরুদ্দিন, ব্যারিস্টার আখতার উদ্দিন, অধ্যাপক গোলাম সারওয়ার, মওলানা আশরাফ আলী, মেজর আফসার উদ্দিন, নূরুজ্জামান প্রমুখ কেন্দ্ৰীয় শান্তি কমিটি গঠনকারী সমস্ত নেতাই এই মিছিলের পুরোভাগে ছিলেন। এই মিছিলে শ্লোগান দেওয়া হয়, পাকিস্তানের উৎস কি“লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ”,“হাতে লও মেশিনগান”‘দখল কর হিন্দুস্থান’, ‘বীর মুজাহিদ অস্ত্র ধর’ ‘আসাম বাংলা দখল কর’; ‘পাক ফৌজ অস্ত্র ধর’ ‘হিন্দুস্থান দখল কর’। ভারতের দালালদের ক্ষতম কর, ক্ষতম কর, আমাদের রক্তে -পাকিস্তান টিকবে, কুটনি বুড়ি ইন্দিরা-হুঁশিয়ার হুঁশিয়ার, অফিস-আদালতের মীরজাফররা হুঁশিয়ার হুঁশিয়ার। ঢাকা বেতারের মীরজাফররা হুঁশিয়ার, ভারতের দালালী চলবে না চলবে না। (একাত্তুরের দালালরা কে কোথায়? পৃঃ ১৩৭) (সংগ্রাম)
পাকিস্তানের প্রাক্তন কূটনীতিক ও মুক্তি সংগ্রামের নিবেদিতপ্রাণ বাঙ্গালী কূটনীতিক সৈয়দ এ. করিম নিউইয়র্ক টাইমস- এ এক পত্রে পাক সরকারের জাতীয় পরিষদের বৈঠক আহ্বানকে ভাওতাবাজী বলে আখ্যায়িত করেন। জেনারেল ইয়াহিয়া খানের জাতীয় পরিষদের এখন রবারস্ট্যাম্প পরিষদ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তিনি সামরিক প্রশাসনের তীব্র সমালোচনা করেন ঐ পত্রে।
ঢাকা থেকে বিবিসির সংবাদদাতা জানায়, মুক্তিবাহিনীর ব্যাপক তৎপরতায় ঢাকাযশোর পি আই এ সার্ভিস পুরোপুরি বাতিল সহ ঢাকা-বরিশাল নৌ-চলাচল স্থগিত করা হয়েছে। ঢাকা নগরীর ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। খাদ্য-সামগ্ৰী দাম বৃদ্ধি পেতে শুরু করেছে।
জাতিসংঘের ত্রাণসামগ্ৰীসহ ৭৮৪ ট্রাক নিয়ে ৭১০০০ টনের কার্গো চট্টগ্রামে মাল খালাস করতে না পেরে সিঙ্গাপুর ফিরে যায়।
পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জাতিসংঘের মহাসচিবের কাছে পাঠানো এক পত্রে পূর্বাঞ্চলের সীমান্ত এলাকায় জাতিসংঘের পর্যবেক্ষক মোতায়েনের আবেদন জানায়।
Indian Rejection of Pakistani Proposal for U.N. Observers.
President Yahya Khan proposed in a letter to U. Thant on Nov. 29 that U.N. obscrvers should be stationed within East Pakistan to report on any violations of the border, as “a mark of our desire to prevent the situation being escalated to a full-scale conflict.” The proposal was rejected on Dec. I by both the Indian Government and the Provisional Government of Bangladesh.
An Indian Government spokesman pointed out that only the Security Council could sanctions an observer team and that there was as yet no Indication that it would do so. “In May or June.”he added. “there was talk of some communications experts being sent from a particular country as part of the U.N. team inside Bangladesh. But these people never came because the elected leaders of Bangladesh Indicated that the lives of these experts-might be in danger. I have no reason to believe that has changed.” (KCA, P. 24995)
সারাদিন যশোরের কমলাপুর সীমান্ত ফাঁড়িতে মুক্তিবাহিনী ও পাকবাহিনীর মধ্যে তীব্র সংঘর্ষের পর রাতে পাকবাহিনী জানমালের ক্ষয়-ক্ষতি স্বীকার করে কমলাপুর ফাড়ি ত্যাগ করে। চৌগাছা এলাকায় অবস্থানরত মুক্তিবাহিনী যশোরের দিকে অভিযান চালায়।
কেন্দ্ৰীয় শান্তিকমিটি ঢাকায় ভারতের পূর্ব পাকিস্তান আক্রমণের প্রতিবাদে সাধারণ হরতাল আহ্বান করে।
চীনা প্রধানমন্ত্রী ভারত-পাকিস্তান সংঘর্ষের শান্তিপূর্ণ মীমাংসার আবেদন জানায়।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট নিক্সন ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর কাছে বার্তা পাঠান। ভারতের সরকারী মহল থেকে বলা হয়, গত ২ দিন ধরে বালুরঘাট ও হিলি (দিনাজপুর) এলাকায় ভারতীয় সামরিক বাহিনীর ট্যাংক ও পদাতিক বাহিনীর সাহায্যে পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে। ভারতীয় মুখপাত্র বলেন বর্তমান সংঘর্ষে মোট চারটি পাকিস্তানী ট্যাংক ধ্বংস করা হয়েছে। গত একসপ্তাহে মোট ১৮টি পাকিস্তানী ট্যাংক ধ্বংস করা হয়েছে। (সংবাদপত্র)
জাতিসংঘে বাংলাদেশ প্রতিনিধিদলের সদস্যগণ সিনেটর এডওয়ার্ড কেনেডি, সিনেটর স্যাক্সবীসহ কয়েকজন সিনেট ও কংগ্রেস সদস্য গ্যালাঘরের সঙ্গে বাংলাদেশ পরিস্থিতি সম্পর্কে আলোচনা করেন। ওয়াশিংটনে নিয়োজিত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত এম. আর. সিদ্দিকী এম. এন. এ. প্রতিনিধিদলের সদস্যদের সম্মানার্থে সান্ধ্য অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন। বিভিন্ন দেশের রাষ্টদূত ও দূতাবাসের প্রতিনিধিরা এই অনুষ্ঠানে যোগদান করেন।
উল্লেখ্য, Senator Edward Kennedy, Chairman of the Senate- Judiciary sub-Committee on Refugees এ মাসের ১ তারিখে কংগ্রেসের বিবেচনার জন্য পূর্ববঙ্গের সমস্যার ৭-দফা সুপারিশ পেশ করেছিলেন। (বিডি-২, পৃঃ ২০০)
বেলজিয়াম কর্তৃক পাক-ভারত সীমান্তের উভয়দিকে অবিলম্বে যুদ্ধবিরতি ঘোষণার জন্য বেলজিয়াম কর্তৃক সিকিউরিটি কাউন্সিল উত্থাপিত প্রস্তাব সম্পর্কে মন্তব্য প্রসংগে ভারতের মুখপাত্র বলেন, সিকিউরিটি কাউন্সিলের অধিবেশনে মূল সমস্যার সমাধান হওয়া সম্ভব নয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক রাষ্ট্রদূত পর্যায়ে উত্থাপিত অনুরূপ একটি প্রস্তাব সম্পর্কেও ভারতীয় কর্তৃপক্ষ অত্যন্ত বিরক্তি প্রকাশ করেন বলে দি গার্ডিয়ান-এর বিশেষ সংবাদাতা হ্যার জ্যাকসন কর্তৃক নয়াদিল্লী থেকে প্রেরিত এক সংবাদ বিশ্লেষণে উল্লেখ করা হয়। উল্লেখ্য, যুক্তরাষ্ট্র ও পাশ্চাত্যের বিভিন্ন দেশ সফরকালে শ্রীমতী গান্ধী বলেন, উপমহাদেশের বর্তমান সমস্যা সিকিউরিটি কাউন্সিলে উত্থাপন করে কোন লাভ হবে না। পাকিস্তান এ যাবৎ তিনবার ভারত আক্রমণ করে। তা সত্ত্বেও সিকিউরিটি কাউন্সিল কখনও ভারত আক্রমণের শিকার হয়েছে বলে পরিষ্কার ভাষায় ঘোষণা করেনি। (দি গার্ডিয়ান, ২৯ নভেম্বর)
জাতিসংঘে বাংলাদেশ প্রতিনিধি দল মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্টের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা মিঃ কন্সটেবলের সঙ্গেও বাংলাদেশ সম্বন্ধে আলোচনা করেন। আলোচনাকালে মিঃ কন্সটেবল বলেন, পাকিস্তান সরকার ও মুজিবনগর সরকারের প্রতিনিধিদের সমবায়ে একটি গোলটেবিল বৈঠক অনুষ্ঠিত হওয়া উচিত। বাংলাদেশ প্রতিনিধি দলনেতা বিচারপতি আবু সাইদ চৌধুরী ঐ বৈঠকে শেখ মুজিবের যোগদান সম্পর্কে প্রশ্নোত্তরে মিঃ কন্সটেবল বলেন, এই পর্যায় শেখ মুজিব অনুপস্থিত থাকবেন। প্রাথমিক আলোচনার পর মতৈক্য প্রতিষ্ঠিত হলে শেখ মুজিব পরবর্তী আলোচনায় যোগদান করতে পারেন। বিচারপতি চৌধুরী তৎক্ষণাৎ আসন থেকে উঠে তার ফেল্ট হ্যাট ওভারকোট হাতে তুলে নিয়ে বলেন, শেখ মুজিব ছাড়া অন্য কারও পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশ সম্পর্কে আলোচনা করার অধিকার নেই। (স্বাধীনতা সংগ্রাম প্রবাসী বাঙালী।)
নভেম্বর মাসে মুক্তিবাহিনীর আঘাতে আঘাতে ক্ষিপ্ত পাক-হানাদার বাহিনীর প্রধান জেনারেল নিয়াজী ভারতের সীমান্তবর্তী কয়েকটি স্থানে যেমন কুষ্টিয়া, বয়রা, বালুঘাট, গেদে ও আগরতলায় কামানের গোলা ছুঁড়তে থাকে। ফলে, লড়াই বাঁধে ঐ সীমান্তবর্তী অঞ্চলগুলোতে। বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় বাহিনী (নেপথ্য থেকে) প্ৰচণ্ড পাল্টা আক্রমণ চালায়। বয়রায় যে লড়াই হল তাতে উভয় পক্ষই ট্যাংক ব্যবহার করে। উভয় দেশের বিমান বাহিনী ও এই লড়াই-এ অংশ নেয়। প্রথম দিনের যুদ্ধে পাকিস্তানের ৬টি দ্বিতীয় দিনে ৭টি ট্যাংক ঘায়েল হয়। পাকিস্তানের তিনটে স্যাবর বিমান বিধ্বস্ত হয়। ২৫,২৬,২৭, নভেম্বর ট্যাংক লড়াই হয় বালুরঘাট চিলি সীমান্তে। তাতে ধ্বংস হয় পাঁচটা পাকিস্তানী ট্যাংক প্রচণ্ড মার খেয়ে পাকবাহিনী পালিয়ে যায়। (দৈঃ বাঃ ৩/৭/৭২)
Reference:
একাত্তরের দশ মাস – রবীন্দ্রনাথ ত্রিবেদী