২২ অগ্রহায়ণ ১৩৭৮ বৃহস্পতিবার ৯ ডিসেম্বর ১৯৭১
[মিত্রবাহিনী ঢাকা অভিমুখে অগ্রসর হচ্ছে। চাঁদপুর পাকসৈন্য মুক্ত হয়। হেলিকাপ্টারে মিত্রবাহিনী যমুনা পাড়ি দেয় রাতের অন্ধকারে। যুদ্ধের ইতিহাসে এক অপূর্ব ঘটনা। ঢাকা থেকে বা বাইরে থেকে পাকবাহিনী প্রবশ বা নিস্ক্রমণ রুদ্ধ হয়ে গেছে। মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনীর সামনে শুধু একমাত্র ঢাকা দখল। লড়াই চলছে ভৈরবে। সহ প্রধামন্ত্রীর নতুন পদবী পেয়ে জেড এ ভুট্টো নিউইয়র্ক ছুটেছিলেন জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে। তিনি প্রকৃত অবস্থা বোঝাবেন। এদিকে প্রকৃত অবস্থা হল জেনারেল মনেকশ’র আত্মসমর্পণের নির্দেশ বিমান থেকে পাক ঘাঁটিতে ফেলা হচ্ছে। নৌবাহিনী আলফা ফোর্স খুলনা নদী পথে আক্রমণ শুরু করে। -লেখক
-ডিসেম্বর ৯ চতুর্দিক থেকে মিত্রবাহিনী ঢাকার দিক অগ্রসর হল। তখন তাদের চোখের সামনে শুধু ঢাকা। মিত্রবাহিনী ও মুক্তিবাহিনী বাংলাদেশের নানা প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা পাকিস্তানীদের বেশ ভালোমত বিচ্ছিন্ন করে ফেলেছেঃ তাদের ঢাকা ফেরার বা পালাবার প্রায় সব পথ বন্ধ। ওদিকে জাতিসংঘ চলছিল ব্যাপক ততৎপরতা যুদ্ধ বিরতির। অতএব মিত্রবাহিনী ও মুক্তিবাহিনীর দ্রুত ঢাকায় পৌঁছানো হল প্রধান লক্ষ্য। সবদিক দিয়ে মিত্রবাহিনী ঢাকার দিকে অগ্রসর হল। পূর্বে আশুগঞ্জ দাউদকান্দি এবং চাঁদপুর পৌঁছে গেল। পশ্চিমে মধুমতী নদীর তীরে পৌঁছে গেল। ময়মনসিংহ পৌছল অন্যদল। নৌবাহিনীর গানবোটগুলো এগুচ্ছে। বিমান বাহিনীর আক্রমণও পুরোদমে চলছে। (১০ খণ্ড পৃ ৭৮৮)
সম্মিলিত বাহিনী গুরুত্বপূর্ণ নদীবন্দর চাঁদপুর দখল করে নেয়। চাঁদপুর থেকে নদীবক্ষে শত্রুর সৈন্য বোঝাই একটি বড় ষ্টীমারের উপর মিত্রবাহিনীর সাঁজোয়া ট্যাঙ্ক থেকে গোলা বর্ষণ ও বিমান থেকে রকেট নিক্ষেপ করা হয়। ফলে ষ্টিমারটিতে আগুন ধরে ডুবে যায়, মোট পাঁচশত পাক সৈন্য সাঁতার না জানায় পদ্মা নদীতে ডুবে মরে।
-পশ্চাদপসরণকারী খান সেনারা প্রতিরোধের শেষ আশায়। মেঘনা নদীর উপর বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম ভৈরব রেল সেতুটি ডিনামাইট দিয়ে ভেঙ্গে দেয়। ঐদিনই সম্মিলিত বাহিনী আশুগঞ্জে গিয়ে পৌঁছে।
-লোকসভার অধিবেশনে ভারতের প্রতিরক্ষা মন্ত্রী জানান যে, যুদ্ধ শুরু হওয়ার দিনই পাকিস্তানের আমেরিকা প্রদত্ত বিখ্যাত সাবমেরিন গাজী নিমজ্জিত হয়েছে। তিনি এই দিন আরো জানান যে, পাকিস্তান এ পর্যন্ত সর্বমোট ৩ টি রণতরী ৯ টি গানবোট ও ২ টি জাহাজ খোয়া যায়নি, কিন্তু উভয় অংশে মোট ৩১ টি বিমান ভারত হারিয়েছে। শ্রীজগজীবন রাম আরো বলেন, রংপুর আর দিনাজপুরের পতন আসন্ন।
-বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রীসভা ও আওয়ামী লীগ, ন্যাপ, কমিউনিষ্ট পার্টি জাতীয় কংগ্রেস সমন্বয়ে গঠিত উপদেষ্টা পরিষদের এক যৌথ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। ভারত কর্তৃক বাংলাদেশ সরকারের স্বীকৃতি দানের পর এটিই ছিল উপদেষ্টা পরিষদের প্রথম বৈঠক। সম্মিলিত বাহিনী কর্তৃক মুক্ত এলাকায় অসামরিক প্রশাসন শুরু করা খাদ্য চিকিৎসা এবং পুনর্গঠন প্রভৃতি ছাড়াও জাতিসংঘের সম্রাজ্যবাদী দেশসমূহের চক্রান্তের ফলে উদ্ভুত পরিস্থিতি ইত্যাদি বিস্তারিত আলোচনা হয়।
-পাক ভারত যুদ্ধের জাতিসংঘে সাধারণ পরিষদে পাকিস্তানের বক্তব্য পেশ করার উদ্দেশ্যে ৭ সদস্যর একটি প্রতিনিধি দলের নেতা হিসাবে পাকিস্তানের ভাবী সহকারী প্রধান মন্ত্রী ও পররাষ্ট্র মন্ত্রী জনাব জেড ও ভুট্টো আজ সকালে নিউইয়র্ক যাত্রা করিয়াছেন। (দৈঃ ইঃ)
-চিনের অস্থায়ী পররাষ্ট্র মন্ত্রী চি পেং ফি এক ভাষণে বলেন, যে,ভারত পাকিস্তানের বিরুদ্ধে পূর্ণাঙ্গ আক্রমণ শুরু করেছে। এবং তথাকথিত বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়েছে। এই কাজে ভারত সমাজতান্ত্রিক সাম্রজ্যবাদের রাজনৈতিক অর্থনৈতিক এবং সামরিক সাহায্য লাভ করেছে। চীনের সরকার ও জনগণ ভারতের এই সম্প্রসারণবাদী নীতির এবং ভারতকে অবশ্যই পাকিস্তানের বিরুদ্ধে আক্রমণ বন্ধ করে দিতে হবে এবং শর্তহীন ভাবেই পাকিস্তানের ভূমি থেকে সৈন্য প্রত্যাহার করে নিতে হবে। প্রতি আক্রমণের জন্য যে সমস্ত সৈন্য ভারতে প্রবেশ করেছে পাকিস্তান সে সমস সৈন্য প্রত্যাহার করবে বলে চীণ বিশ্বাস করে। (বিডি-২ পৃঃ ২১৮)
-পূর্বঞ্চলের জি ও সি লেঃ জেনারেল জগজিৎ সিং আরোরা বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় জানান বাংলাদেশের ভিতরে এবং যশোর ও খুলনার মধ্যে আটকে পড়া পাকিস্তানীরা মেঘনা ও পদ্মা দিয়ে পালাবার চেষ্টা করেছিল। তাদের উপর ভারতীয় বিমান বাহিনী ক্রমাগত বিমান থেকে বোমা ফেলেছে।\
-যশোর, সিলেট ও ফেনীর বিস্তীর্ণ এলাকা সম্মিলিত বাহিনীর দখল প্রতিষ্ঠা। বিভিন্ন রণাঙ্গনে ভারতের যুদ্ধ বিরতির প্রশ্নটি অবশ্যই একটি সার্বভৌম স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের অস্তিত্বের বাস্তবতার সাথে সম্পর্কযুক্ত হয়ে হবে। কেননা সেখানে বাংলাদেশ সরকারকেই আমরা একমাত্র আইনসঙ্গত সরকার বলে স্বীকার করি। মুখপাত্র বলে পূর্বাঞ্চলের বাস্তবতাকে স্বীকার করার মাধ্যমেই পূর্ব ও পশ্চিম উভয় অঞ্চলে যুদ্ধ বিরতির পথ সুগম করা যেতে পারে। বাংলাদেশের নেতা শেখ মুজিবুর রহমানকে বিনা শর্তে মুক্তিদানই হলো শান্তিপূর্ণ মীমাংসার একমাত্র পথ। (সংবাদপত্র)
প্যারিসের দৈনিক লু’মনিতে পরিতাপের সঙ্গে বলেছে যে, জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ বাঙালীদের ভাগ্যকে অস্বীকার করেছে এমন সুপারিশ সমূহ গ্রহণ করেছে এবং বিবেচয়ার মধ্যে নিতে পারেনি সেই সমস্যাটিকে যেটি এই যুদ্ধের কারণঃ বাঙালী জনসমষ্টির বিরুদ্ধেঃ পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর আচারিত প্রতিহিংসা। উল্লেখ্য প্রাভাদার রাজনৈতিক ভাষ্যকার বলেছেন, এই উপায়েই শুধু দাবানল নেভানো যায়। অন্যথায় যুদ্ধ বিরতি ঘটলে পূর্ব পাকিস্তানকে যুদ্ধ বিরতি ঘটলে পূর্ব পাকিস্তানকে পুনরায় পিটানো ফৌজের হাতে তুলে দেওয়া হবে। যারা একে ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে ফেলত।
-বাংলাদেশ ভারত যৌথ কমাণ্ডের প্রধান পূর্বাঞ্চল জি ও সি লেঃ জেঃ জগজিৎ সিং আরোরা বলেন, এখন পাকবাহিনী দু দিকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। এক অংশ রয়েছে হিলির উত্তরে আর অন্যটি বাংলাদেশের দক্ষিন দিকে। উত্তর যে বাহিনী আছে তার সংখ্যা এক ব্রিগেড। তিনি বলেন ভারতীয় বাহিনী পাক বাহিনীকে যশোরের থেকে দক্ষিণ দিকে তাড়িয়ে নিয়ে গিয়েছিল। জেনারেল আরোড়া আরও বলেন, বক্ষ্মপুত্রের তীর ঘেঁসে উত্তর দিক থেকে যে দূরে ভারতীয় বাহিনী অগ্রসর হচ্ছে তারা ময়মনসিংহ সদ্র শহর থেকে প্রায় ৫০ কিঃ মিঃ দূরে জামালপুর ঘিরে রেখেছিল। মেঘালয় সীমান্তের হালুয়াঘটের দিক থেকে আর একটি সৈন্যদল ময়মনসিংহ দিকে এগোচ্ছিল। সিলেট এলাকায় লড়াই চলছিল। তিনি আরো বলেন ময়নামতী দুর্গে পাকবাহিনীকে ভারতীয় বাহিনী ঘিরে রেখেছে। সৈয়দপুর মিলিয়ে লড়াই করছে। এছাড়া যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করার আগ থেকে খবর সংগ্রহ করা ইত্যাদি ব্যাপারে মুক্তিবাহিনীর গেরিলাদের কার্যকলাপ যুদ্ধরত ভারতীয় সেনাবাহিনীকে যথেষ্ট সাহায্য করেছিল। জেনারেল আরোরা বলেন, মুক্তিবাহিনীর লোকজন্রা কয়েকটি থানার ভার হাতে নিয়েছেন এবং স্থানীয় লোকদের দেখাশুনা করছেন। (সুখরঞ্জন দাশগুপ্ত। আঃ বাঃ পঃ)
-তুরার উত্তর দিক থেকে যে মিত্রবাহিনী ঢাকার দিকে অগ্রসর হচ্ছিল তাঁকে জোরদার করবার জন্যে মিত্র বাহিনী টাঙ্গাইল নিকটবর্তী কোন এলাকায় ৭০০ জন ছাত্রী সেনা এবং ৮০ টন সাজ সরঞ্জাম সরবরাহ করে। ঢাকার গভর্ণর হাউস এবং বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের ওপর বিমান আক্রমণের সাথে সাথে স্পষ্ট হলো বাংলাদেশের পাকিস্তানি সামরিক জান্তার অত্যাচারের শেষ মুহূর্ত।
-৯ ডিসেম্বর সকাল পাক ইষ্টার্ন কমাণ্ডের সদর দফতর ঢাকা থেকে প্রথমবারের মোট জেনারেল নিয়াজী স্বীকার করেন যে, পরিস্থিতি দারুণ সংকটপূর্ণ। পিণ্ডিতে একটি সংকেতবাণী পাঠানো হয়। (এক) আকাশে শত্রুর প্রভুত্বের কারণে পুনর্বিন্যাসকরণ সম্ভব নয়। বাঙালীরা আরো শত্রুভাবাপন্ন হয়ে উঠেছে। শত্রুকে তারা সবরকমের সাহায্য করছে। বিদ্রোহিদের তীব্রতর এ্যম্বুশের কারণে রাতে সৈন্য পরিচালনা সম্ভব নয়। বিদ্রোহীরা শত্রুকে ফাঁকের মধ্য দিয়ে এবং পশ্চাতে পথ দেখিয়ে পরিচালনা করছে। বিমান ঘাঁটি ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। গত তিনদিনে কোন মিশন পরিচালিত হয়নি, ভবিষ্যতেও সম্ভব হবে না।
(দুই) শত্রুর হামলায় ভারী যন্ত্রপাতি এবং উপকরণ ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ছে। সৈন্যরা চমৎকার যুদ্ধ করছে। বিমান ও ট্যাংকের গোলার মুখে রয়েছে সর্বক্ষণ। (তিন) পরিস্থিতি নাজুক ও সংকটপূর্ণ-ঢাকা রক্ষার জন্যে যদি সম্ভব হয় বিমানবাহী সৈনিকের পুনঃসমাবেশ ঘটানো হোক। উইটনেস টু সারেণ্ডার গ্রন্থে আরো বলা হয়, একই রাতে গভর্ণর মালিক ও জেনারেল নিয়াজির কাছে প্রেরিত প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান এক বার্তায় জানান, আন্তর্জাতিকভাবে যাবতীয় ব্যবস্থা আমি নিয়েছি কিন্তু আমাদের বিচ্ছিন্ন অবস্থার প্রেক্ষাপট পূর্বপাকিস্তান সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নেয়ার ব্যাপারটি আপনার সিদ্ধান্তের উপর ছেড়ে দিচ্ছি। আপনার সিদ্ধান্তই আমি অনুমোদন করবো, আপনার সিদ্ধান্ত মেনে নেয়ার নির্দেশ দিচ্ছি। (পৃঃ ১৯৫)
-৯ ডিসেম্বর পিকিং এ অনুষ্ঠিত এক সান্ধ্য অনুষ্ঠানে চীনের অস্থায়ী পররাষ্ট্র মন্ত্রী চী পেং ফি কর্তৃক ভারত বিরোধী বক্তৃতার প্রতিবাদে ভারতীয় চার্জ দ্যা এফেয়ার্স অনুষ্ঠান বর্জণ করেন। এই অনুষ্ঠানে চীনের প্রধানমন্ত্রী চৌ এন লাই পাকিস্তানের প্রতি বন্ধুত্বপূর্ণ মনোভাব প্রকাশ করেন।
-পাকিস্তানী রাষ্ট্রদূত কে এম কায়সার সাংবাদিকদের নিকট বলেন, ভারতীয় আক্রমণকারীরা শীঘ্রই পরাজয় বরণ করবে বলে চীনের প্রধানমন্ত্রী উল্লেখ করেন। (দি ডেইলী টেলিগ্রাফ, ১০ ই ডিসেম্বর)
Reference:
একাত্তরের দশ মাস – রবীন্দ্রনাথ ত্রিবেদী