You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.12.08 | ২১ অগ্রহায়ণ ১৩৭৮ বুধবার ৮ ডিসেম্বর ১৯৭১ | একাত্তরের দশ মাস - রবীন্দ্রনাথ ত্রিবেদী - সংগ্রামের নোটবুক

২১ অগ্রহায়ণ ১৩৭৮ বুধবার ৮ ডিসেম্বর ১৯৭১

-সকালেই আকাশবাণী প্রচার করে জেনারেল মানেকশ আত্মসমর্পণ বাণী। বিভিন্ন ভাষায় আত্মসমর্পণে বাণী লিফলেট করে আকাশে ছড়িয়ে দেয়া হ’ল। বাণীতে বলা হ’লঃ পাকসেনাদের পালাবার কোন সুবিধা আপনারা করতে পারবেন না। চারিদিক থেকে সম্মিলিত বাহিনী আপনাদের ঘিরে রয়েছে। হাতিয়ার ডাল দো, অর্থাৎ আত্মসমর্পণ করুন

-সামগ্রিক যুদ্ধ পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে মিত্র বাহিনী তিনটি ব্যবস্থা নিলেন। প্রথম ব্যবস্থায় গোটা সেনাবাহিনীকে আত্মসমর্পণ করতে বলা হয়। দ্বিতীয় ব্যবস্থায় জেনারেল জগ ৎ সিংকে বলা হল দ্রু ঢাকার দিকে এগিয়ে যেতে। তৃতীয় ব্যবস্থায়, একটি ব্রিগেডকে হালুয়াঘাট থেকে ময়মনসিংহের দিক নিয়ে আসা হ’ল।

-যুদ্ধের শুরুতেই ভারতীয় সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল মানেকশ বললেনঃ আমি জানি ‘আপনারা বরিশাল এবং নারায়াণগঞ্জের কয়েক জায়গায় জড় হচ্ছে।  কিন্তু আমি সমুদ্র পথে পালাবার সব পথ আপনাদের বন্ধ করে দিয়েছি। এজন্য নৌ বাহিনীকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। ভারতীয় বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ না করেন তাহলে নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে কেউ আপনাদের রক্ষা করতে পারবে না। (১০:৭৮৬)

-সব দিকেই পাকবাহিনী অবরুদ্ধ। সম্মিলিত বাহিনী চারদিক থেকে এগিয়ে চলছেম-চল চল ঢাকা চল। আউট ফ্ল্যাংক ও ক্রস ক্যান্টি রণপদ্ধতিকে ব্যাপক সুফল পেতে থাকে মিত্র বাহিনী।

-পূর্ব সীমান্ত থেকে সব কটি ডিভিশন প্রচণ্ড গতিতে ঢাকার দিকে এগুচ্ছে। ব্রাক্ষনণবাড়ীয়া দখল করে একদল এগুলো আশুগঞ্জের দিকে। অন্যদিকে পাক হানাদার বাহিনী ব্যাংক লুট করে পিরোজপুর ছেড়ে পালিয়ে যায়। পিরোজপুর শত্রুমুক্ত হয়। এদিন চাঁদপুরও শত্রুমুক্ত হয়।

-মুক্ত হলো কুমিল্লা। পাকবাহিনী আশ্রয় নীল ক্যান্টনমেন্টে। জেনারেল জগজিৎ সিং আরোরা কুমিল্লা ঘুরে গেলেন হেলিকাপ্টারে করে। মানচিত্রে খচিত বাংলাদেশের পতাকা উড়তে শুরু করলো কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টে মিত্রবাহিনী বিমান হামলা চালালো। আর বেতার তরঙ্গে শুরু ঐ বাণী “হাতিয়ার ঢাল দো”। কুমিল্লায় আনুষ্ঠানিকভাবে জাতীয় পতাকা উড়ালেন শুরু করলো কুমিল্লায়। কুমিল্লা আনুষ্ঠানিকভাবে জাতীয় পতাকা উড়ালেন দক্ষিণ পূর্বাঞ্চলীয় কাউন্সিলে চেয়ারম্যান জহুর আহমেদ চৌধুরী ও এডভোকেট আহাম্মদ আলী।

-পিণ্ডি রেডিও জানান, ইয়াহিয়া আজ নুরুল আমিনকে প্রধানমন্ত্রী ও জেড এ ভুট্টোকে উপ-প্রধানমন্ত্রী হবার ঘোষণা দিয়েছে।

-প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহম্মদ বিকেল ৪ টায় এক বেতার ভাষণে ঘোষণা দিলেনঃ নবজাত স্বাধীন বাংলাদেশের আদর্শ শান্তিপূর্ণ সহ-অবস্থান, জোট নিরপেক্ষতা এবং সকল প্রকার ঔপনিবেশিকতা ও সাম্রাজ্যবাদের বিরোধিতা। আমরা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা এবং ধর্ম-নিরপেক্ষ ও সমাজতন্ত্রী জীবন গঠন অভিলাষী। ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক পারস্পরিক বন্ধুত্ব ও মৈত্রীর দৃঢ় ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত হবে।

-ভারতীয় নৌবাহিনীর বিমান বহর রাতে বরিশাল, বাখেরগঞ্জ ও পটুয়াখালী এলাকায় নদী পথে কোন নৌবহর দেখতে পান নি। তবে পাক বাহিনীর সৈন্য, অস্ত্র ও সরঞ্জামাদি সহ তিনটি বর্জের সলিল সমাধি ঘটায়। অবরুদ্ধ বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের পাকবাহিনী সমুদ্র পথে পাড়ি জমানোর রুদ্ধ হয়ে যায়।

-ভারতীয় নৌবাহিনীর ৪৮ ঘন্টার মধ্যে সকল বিদেশী জাহাজগুলো পোতশ্রায় থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সুযোগ দেয়। চালনা, খুলনা এলাকায় নৌবাহিনীর কমাণ্ডো হামলা চালানোর জন্য ভারতীয় নৌবাহিনী ও বাংলাদেশে মুক্তিবাহিনী ‘পদ্মা’ ও ‘পলাশ’ গান বোট নিয়ে ফোর্স ‘আলফা’ অপারেশনে গড়ানিখালে দিবালোকেই অগ্রসর হয়।

-জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে অবিলম্বে যুদ্ধ বিরতি পালন ও সৈন্য প্রত্যাহারের জন্য ভারত ও পাকিস্তানের প্রতি আহবান জানিয়ে প্রস্তাব পাশ করে। সাধারণ পরিষদে ভারতীয় প্রতিনিধি মিঃ সমর সেন বলেন, পাকিস্তানের অবশ্যই বাংলাদেশ কে স্বীকার করে নিতে হবে। উপমহাদেশে শান্তি পুনঃ স্থাপনের জন্য আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবুর রহমানকে মুক্তি দিতে হবে। বাংলাদেশের সরকারের কাছে গ্রহণযোগ্য না হলে জাতিসংঘের কোন প্রস্তাবই বাস্তবায়িত করা যাবে না।

-যুদ্ধ বিরতি ও সৈন্য প্রত্যাহার সম্পর্কিত প্রস্তাবটি জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে ১০৪-১১ ভোটে গৃহীত হয়েছে। বৃটেন, ফ্রান্স ভোট দেয়নি।

-বাংলাদেশের বিভিন্ন রণাঙ্গনে সম্মিলিত বাহিনীর অগ্রাভিযান অব্যাহত থাকে। ব্রাক্ষণবাড়ীয়া, হিলি, সুনামগঞ্জ, ছাতক, জয়ন্তিয়াপুর, লালমনির হাট, দুর্গাপুর, হালুয়াঘাট ও আখাউড়ার তীব্র সংঘর্ষ চলে।

-পাক সরকার মনোনীত প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টো পাকিস্তানী প্রতিনিধি দলের নেতা হিসেবে নিউইয়র্কে উদ্দেশ্যে পিণ্ডি ত্যাগ করেন।

-ঢাকায় মিত্রবাহিনীর দশবার বিমান হামলা চালায়। হামলার লক্ষ্যস্থল ছিল সামরিক স্থাপনাগুলো।

ঢাকায় অনির্দিষ্টকালের জন্য সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠা বন্ধ ঘোষণা।  (বাঃ বাঃ)

-পোল্যাণ্ড কম্যুনিষ্ট পার্টির কংগ্রেসে ভারত বাংলাদেশ পাকিস্তানের উদ্ভুত পরিস্থিতি সম্পর্কে এক ভাষণে মিঃ লিউনাদ ব্রেজনেভ আশা প্রকাশ করে বলেন যে, বাইরের কোন হস্তক্ষেপ ছাড়াই ভারত পাকিস্তান সংঘর্ষের একটা শান্তিপূর্ণ সমাধান হবে বলে সোভিয়েত ইউনিয়ন বিশ্বাস করে। তিনি বলেন যে, পূর্ব পাকিস্তানের জনগণকে মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করার চেষ্টাতেই যুদ্ধের সূত্রপাত হয়েছে। (দি টাইমস অব ইণ্ডিয়া)

-মালশিয়ার প্রধানমন্ত্রী তুন আবদুল রাজ্জাক ভারত ও পাকিস্তানের কাছে মানবিক কারণে অবিলম্বে যুদ্ধ বন্ধ করার আবেদন জানান।

-অসলোতে সোভিয়েত প্রধানমন্ত্রী এলেকসি কোশিগিন আজ বলেন ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধে মধ্যস্থতা করার সম্ভাবনা আপাতত আছে বলে তিনি মনে করেন না। নির্দিষ্ট তারিখের দুদিন আগেই নরওয়ে সফর শেষ করে তিনি দেশে চলে যাচ্ছিলেন। বাংলাদেশ সরকারের স্বীকৃতি দেওয়া সম্পর্কে তিনি বলেন, আমরা এখনও বিষয়টি বিচার বিবেচনা করে দেখিনি। (আঃ বাঃ পঃ)

-নয়াদিল্লীস্থ মার্কিন দূতাবাসের সামনে সংসদ সদস্য শ্রী চন্দ্র শেখর, জ্যোর্তিময় বসু, ইন্দ্রিজিৎ গুপ্ত, শ্রীমতী  সুভদ্রা যোশী সহ বিরোধী ও কংগ্রেস সদস্য ত্রিশজন মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ এশীয়া ছাড় ‘ শেখ মুজিব জিন্দাবাদ’ ধ্বনি দিয়ে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। (আঃ বাঃ পঃ)

-সেই বিরাট যশোর দুর্গের পতন ঘটেছে। সেই গুরুত্বপূর্ণ শ্রীহট্ট শহরও এখন মুক্ত। ঝিনাইদহ মুক্তি বাহিনীর দখলে। ব্রাক্ষণবাড়ীয়া থেকেও পাক-বাহিনী পালিয়েছে। মঙ্গলবার বাংলাদেশে মিত্রবাহিনী ও মুক্তিবাহিনী একের পর এক সাফল্য অর্জন করেছেন। আর তারপর চর্তুদিক থেকে এগিয়ে চলেছিলেন রাজধানী ঢাকার দিকে।

-যেভাবে যশোরের পতন ঘটেছিল তাতে পরিষ্কার, বাংলাদেশে পাক সেনাবাহিনীর মাত্র দু’টি লক্ষ্য। প্রথম লক্ষ্য ভারতীয় বাহিনীকে ধাপ্পা দিয়ে তার অগ্রগতি যথাসম্ভব মন্থর করে দেওয়া। এবং দ্বিতীয় লক্ষ্য, যতদিন পারা যায় ঢাকায় দখল বজায় রাখা। (আঃ বাঃ পঃ)

-আনন্দবাজার পত্রিকা লিখেছে, আমাদের জওয়ানদের জয় জয়কার। যশোর মুক্ত, শ্রীহট্ট মুক্ত। বাংলাদেশের নানা রণাঙ্গনে দ্রতু যুগপৎ আক্রমণ চালিয়ে ভারতীয় বাহিনী পশ্চিমা পাকসেনার ঘাঁটির দখল করে নিয়েছেন। হানাদারদের বড় বড় আর মাত্র দু’টি ঘাঁটি বাকি ঢাকা আর কুমিল্লা। রণে ভঙ্গে দিয়ে তারা পালাচ্ছে আর পালাচ্ছে’।

-আনন্দবাজার পত্রিকা আজ প্রথম পাতায় ৮ কলাম ব্যাপী শিরোনাম ‘এ দিকে যশোর ওদিকে শ্রীহট্ট আমাদের’ – শিরোনাম মেহেরপুর, ঝিনাইদহ, লালমনিরহাট-সব পর পর- উপশিরোনাম ৪ কলাম দুর্গ খালি করে পাক ফৌজ পালালো কেন? কোথায়? উপ শিরোনাম ৩ কলাম ছাড়াও পত্রিকা প্রথম পাতায় সম্পাদকীয় ‘শেষের এই শুরুতে মন্তব্য করেছে… সব সুক্ষ্ম তার্কিকদের সংশয়  পরাস্ত করিয়া, সব শেখানো বুলি মিথ্যা প্রমাণ করিয়া একটি জাতিক্রমে ক্রমে প্রতিষ্ঠিতও জয়ী হইতেছে। তাঁহার সূচনা যশোহর, তাহার নমুনা শ্রীহট্ট শহর- সেই বিগিনিং অব দি এণ্ড

-ভারতীয় প্রতিরক্ষা মন্ত্রী শ্রী জগজীবন রাম সংসদে বলেন যে, বাংলাদেশ পাকিস্তানী বিমান বহরকে কার্যত নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া হয়েছে এবং ওই অঞ্চলে আমাদের বিমান বাহিনীর প্রাধান্য সুপ্রতিষ্ঠিত হয়েছে’। লোকসভায় প্রবল হর্ষধ্বনির মধ্যে এই ঘোষণা দেয়া হয়। (আঃ বাঃ পঃ)। ‘সংকটজনক অবস্থা মোকাবিলার জন্য’ পাকিস্তান তুরস্কের কাছে সম্ভাব্য সব ধরনের সাহায্য চেয়েছে। পাকিস্তা ও ভারত থেকে কুটনেতিক স্বদেশে ফিরিয়ে নেওয়ার ব্যাপারে সুইজারল্যাণ্ড মধ্যস্থতা করবে। (আঃ বাঃ পঃ)

-গণ প্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের স্বীকৃতি পর বাংলাদেশ মন্ত্রীসভার এক জরুরী বৈঠকে স্থির হয়েছিল জানুয়ারী মাসে বাংলাদেশ জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের সদস্যদের মিলিত গণপরিষদের বৈঠক ঢাকায় আহ্বান করা হবে। মন্ত্রীসভায় এই ডিসেম্বর মাসেই সদর দপ্তর মুজিবনগর থেকে সেখানে স্থানান্তর করা হবে। জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের সদস্যগন মিলিতভাবে গণপরিষদে সংবিধান রচনা করবেন। সংবিধান রচনার জন্য বাংলাদেশ সরকার একটি প্রচুর ক্ষমতাসম্পন্ন বিশেষজ্ঞ কমিটি শীঘ্রই নিয়োগ করবেন। তবে তাঁদের সরকার গণ প্রজাতান্ত্রিক সরকার। বাংলাদেশ সরকার প্রতিটি জেলায় প্রশাসনিক ব্যবস্থা কঠোরভাবে চালুর বন্দোবস্ত করবেন। আনন্দবাজার পত্রিকা লিখেছে, এক প্রশণোত্তরে একজন সরকারী মুখপাত্র জানান। বাংলাদেশ সরকারের সদর দফত্র মুজিবনগর থেকে ঢাকায় স্থানান্তরের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। ডিসেম্বর তৃতীয় সপ্তাহ নাগাদ স্থানান্তর সম্ভব হবে। (আঃ বাঃ পঃ) (উল্লেহক্য, বিপ্লবী বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রীসভার‍ সদস্যগণ ২২ ডিসেম্বর ঢাকায় পদার্পণ করেন আর গণ

পরিষদের বৈঠক বসেছিল ১০ এপ্রিল ১৯৭২ বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ। সভাপতিত্ব করেছিল মওলানা আবদুর রশিদ তর্কবাগিশ।)

-অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম মঙ্গলবার পশ্চিমবঙ্গের সাহিত্যিক শিল্পী বুদ্ধিজীব্দের এক সম্বর্ধনার জবাবে বলেন, ‘বাঙ্গালীর ভাষা, সংস্কৃতি, শিল্প, সাহিত্য ও কৃষ্টির জন্য আমরা দীর্ঘ লড়াই করে জয়ী হতে চলেছি, এবং এর ফলে দু’বাংলার মধ্যে যে বন্ধুত্ব প্রতিষ্ঠিত হল সবরকম রাজনীতির উপর তার স্থান, তা হবে চিরস্থায়ী। পৃথিবীর কোন শক্তিই আর তা ভাঙতে পারবে না। অনুষ্ঠানে স্বরাষ্ট্র ও ত্রাণ মন্ত্রী জনাব এ এইচ এম কামরুজ্জামান, অধ্যাপক ইউসুফ আলী, এম কোরবান আলী সহ জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের বহু সদস্য উপস্থিত ছিলেন। পশ্চিম বাংলার সাহিত্যিক ও শিল্পীদের মধ্যে বক্তব্য রাখেন সর্বশ্রী অন্নদা শংকর রায়, মনোজ বসু, ডঃ নীহাররঞ্জন রায়, উপস্থিত ছিলেন সর্বশ্রী সভাষ মুখোপাধ্যায়, দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়, শম্ভু মিত্র, সুচিত্রা মিত্র, তৃপ্তি মিত্র, হরিসাধন দাশগুপ্ত, সবিতাব্রত দত্ত, সন্তোষকুমার ঘোষ প্রমুখ। (আঃ বাঃ পঃ)

-মুক্তিবাহিনী-মিত্রবাহিনীর যে দলটি আখাউড়া মুক্ত করেছিল তাঁরা গতরাতে কুমিল্লার ৩২  কিঃমিঃ পশ্চিমে এলিয়টগঞ্জ মুক্ত করেছে। অন্য যে দল ফেনী দখল করেছিল তাঁরা রাতে চাঁদপুর নদী বন্দরের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করেছি। দাউদকান্দির উপকণ্ঠে পৌঁছে যায় মুক্তিবাহিনী।

-মুক্তিবাহিনী- মিত্রবাহিনী দিনাজপুর জেলা শহরের ওপর দিন দিক থেকে আক্রমণ চালাচ্ছে। বীরগঞ্জ-দিনাজপুরখণ্ডে কাস্তনগরে একটি সেতু উড়িয়ে পাকবাহিনী মিত্র-মুক্তিবাহিনীর অগ্রগতি রোধ করার চেষ্টা করেছিল। প্রচণ্ড লড়াই অব্যাহত ছিল। জামালপুর দখলের জোর লড়াই চলেছিল। ময়মনসিংহ সদর শহর দখলের জন্য মিত্রবাহিনী এগিয়ে গিয়েছি।

-কুষ্টিয়া শহরে মিত্রবাহিনী ও মুক্তিবাহিনী একযোগে ঘিরে ফেলেছিল। তাঁরা পদ্মার উত্তরে রাজশাহী-পাবনার সঙ্গে দক্ষিণ তীরে গোয়ালন্দ ঘাটের সঙ্গে সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছিল।

-মিত্রবাহিনী ও মুক্তিবাহিনী একযোগে খুলনার ওপর গোলাবর্ষণ করেছিল। চুয়াডাঙ্গা শহরের ওপরও প্রচণ্ড গোলাবর্ষণ করা হয়েছিল।

-ভারতীয় সেনাবাহিনী (মিত্রবাহিনী) ও মুক্তিবাহিনী সম্মিলিতভাবে অভিযান চালিয়ে খুলনা জেলার সাতক্ষীরা শত্রু কবলমুক্ত করেছিলেন।

-ফরিদপুরের দিকে অগ্রসরমান যৌথবাহিনী কামারখালী ঘাটে পাকবাহিনীর সাথে সংঘর্ষে আসে। মধুমতি নদীর সকল সম্ভাব্য অতিক্রম স্থানে পাকসেনারা প্রহরারত ছিল। লেঃ মোস্তফা স্থানীয় জনগণের কাছ থেকে নৌকা সংগ্রহ করে। মধুমতি নদী অতিক্রম করে মুক্তিবাহিনী পাক সেনাদের পিছু হটিয়ে দেয়। মিত্রবাহিনী এয়ারব্রিজ অপারেশন করে মধুমতি অতিক্রম করে। ( ১০ খ। পৃ ৭৬১)

-চার নম্বর সেক্টর এলাকায় পাকসেনারা মুক্তিবাহিনীর আক্রমণের ফলে দরবশত ছেড়ে হরিপুরে পলায়ন করে। তিনদিন পর পাকবাহিনী নদীপার হয়ে মুক্তিবাহিনীর ওপর আক্রমণ করে। এই আক্রমণের ফলে মুক্তিবাহিনী বিশেষভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়।

-পাঁচ নম্বর সেক্টরে ৩ ডিসেম্বর গোয়াইঘাটে পাকবাহিনীর সাথে মুক্তিবাহিনীর যুদ্ধ হয় এবং গোয়াইনঘাট মুক্ত হয়। মিত্রবাহিনী করিমগঞ্জ থেকে মৌলভীবাজার হয়ে (ডিসেম্বর ৪) সিলেটের পথে যাত্রা শুরু করে। সুনামগঞ্জ মুক্ত হয় (ডিসেম্বর ৬) সেক্টর কমাণ্ডার লেঃ কর্নেল

ছাতক আক্রমণ করেন (ডিসেম্বর ৭) এবং ঐদিনই ছাতক শত্রুমুক্ত হয় আটটায়। মেজর শাফায়েত জামিল সালুটীকর বিমান বন্দরের দিক অগ্রসর হতে থাকেন। গোবিন্দগঞ্জ আক্রমণ করে (ডিসেম্বর ৯) মুক্তিবাহিনী। (১০ খঃ পৃ ৭৬১)

-এস ফোর্স কমাণ্ডার লেঃ কর্নেল শফিউল্লাহ পরিকল্পনা অনযায়ী তাঁর এস ফোর্স নিয়ে মাধবপুর হয়ে ব্রাক্ষণবাড়িয়ার সরাইল পৌঁছান। আখাউরার যুদ্ধে লেঃ বদিউজ্জামান শহীদ হন। মেজর সুবেদ আলী ভূঁইয়া চান্দু রায় উত্তরে রোড ব্লক করে চান্দুরা থেকে সরাইল পর্যন্ত—এলাকা শত্রুমুক্ত করেন। ১১ বেঙ্গল পাইকপাড়ায় এলে মেজর নাসিম শাহাবাজপুর, সরাইল এবং ব্রাক্ষণবাড়িয়ার দিকে অগ্রসর হতে আদেশ দেন। এই সময় একটি দুর্ঘটনা ঘটে। পাকিস্তানীদের একটি গাড়ী তেলিয়াপাড়া থেকে মেজর ভূঁইয়া অতিক্রম করে চলে আসে। ‘এস’ ফোর্স কমাণ্ডার নিজেদের গাড়ী মনে করে গাড়ী থামান। গাড়ী থামলে দেখা গেল গাড়ীতে পাকসেনা। পাকিস্তানী সুবেদারের সাথে কর্নেল শফিউল্লাহর হাতাহাতি শুরু হয়। পাক সেনার গুলীবর্ষণে কর্নেল শফিউল্লাহর কোমরের পিস্তলটি বিধ্বস্ত হল কিন্তু তিনি অলৌকিকভাবে বেঁচে যান। মেজর নাসিম সহ ১১ জন গুরুতর ভাবে আহত হন। মেজর মতিন ১১ বেঙ্গলের অধিনায়ক নিযুক্ত হয়। ডিসেম্বর ৭ পাইকপাড়া এসে পৌঁছায় ‘এস’ ফোর্স। মেজর সুবেদ আলী ভূঁইয়া ৭/৮ ডিসেম্বর শাহবাজপুর আক্রমণ করে শত্রুমুক্ত করেন। ৮ ডিসেম্বর মেজর ভূঁইয়া ও এস ফোর্সের দলটি সরাইল হয়ে আশুগঞ্জের দিকে অগ্রসর হয়। (খ ১০: পৃ ৭৬৩)

-পূর্বাঞ্চলে পাকিস্তানের অবস্থা ক্রমেই সঙ্গীন; যশোরের মোট ব্রাক্ষণবাড়িয়া থেকে পাক-সেনা পালিয়ে আসে। কুমিল্লার এক অংশের পতন আসন্ন; এবং অন্য অংশের পাশ কাটিয়ে ভারত বাংলাদেশ মিলিত বাহিনী এগুতে থাকে। পুর্বাঞ্চলে ইষ্টার্ন কমাণ্ডের সম্যক বিপর্যয় দৃষ্টে রাওয়ালপিণ্ডির সামরিক কর্তারা তখন এতই উদ্বিগ্ন যে, নিয়াজী মনোবল ফিরিয়ে আনার জন্য চীনের তৎপরতা শুরু হয়েছে বলে তাঁকে জানায়। এ হেন শোচনীয় সামরিক পরিস্থিতির মাঝে ইয়াহিয়া খান বেসামরিক প্রতিনিধিদের হাতে তাঁর শাসন ক্ষমতা হস্তান্তরের দীর্ঘদিনের ওয়াদা বাস্তবায়িত করতে শুরু করেন এবং পূর্ব পাকিস্তানে থেকে নূরুল আমিন ও পশ্চিম পাকিস্তান থেকে জুলফিকার আলী ভুট্টোকে যথাক্রমে প্রধামন্ত্রী ও উপপ্রধানমন্ত্রী মন্ত্রী নিয়োগ করেন। (মূলধারা ৭১ পৃঃ ২০৬)

-ভারত ডিসেম্বর ৮ সন্ধ্যায় সর্বশেষ সামরিক ও আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি আলোকে ভারতের সরকারী মুখপাত্র ঘোষণা করেন, পাকিস্তান যদি পূর্ব বাংলায় তাদের পরাজয় স্বীকার করে নেয়, তবে অন্যান্য সকল অঞ্চলেই ভারত যুদ্ধ বন্ধ করবে। বাংলাদেশ বা পশ্চিম পাকিস্তানের কোন অঞ্চলের কোন ভূখণ্ড দখল করার অভিপ্রায় ভারতের নেই। [গার্ডিয়ান লন্ডন (৯,১২,৭১০]

-৮ই ডিসেম্বর ইয়াহিয়া খান কর্তৃক নুরুল আমীনকে প্রধানমন্ত্রী এবং জুলফিকার আলী ভুট্টোকে উপ প্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্র মন্ত্রী পদে নিয়োগ করে একটি ‘কোয়ালিশন’ সরকার গঠন করা হয়েছে বলে ঘোষণা করা হয়। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে পাকিস্তানের পক্ষ সমর্থন করার জন্য অবিলম্বে রাওয়ালপিণ্ডি থেকে নিউইয়র্ক রওয়ানা হন। (ফিইানন্সিয়াল টাইমস ৯ ই ডিসেম্বর)

-৭ই ডিসেম্বর রাত্রিবেলা জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ কর্তৃক গৃহীত এক প্রস্তাবে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করে পরস্পরের সৈন্যবাহিনী প্রত্যাহার করার আহবান জানান হয়।

প্রস্তাবের পক্ষে ১০৪টি ভোট এবং বিপক্ষে ১১টি ভোট দেওয়া হয়। ব্রিটেন ও ফ্রান্সসহ ১০টি দেশ ভোটদানে বিরত থাকে। ভারত, ভুটান, মংগেলিয়া, কিউবা, সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং অন্যান্য কমিউনিষ্ট দেশগুলি (রুমানিয়া ছাড়া) প্রস্তাবের বিপক্ষে ভোটদান করে

-চীন ও পাকিস্তান মোটামুটিভাবে সমর্থন করে প্রস্তাবের মুখবন্ধে রাজনৈতিক সমাধানের কথা উল্লেখ করা হয় বলে পাকিস্তান অস্বস্তি বোধ করে।

-ভারত সরকার প্রস্তাবটি উপেক্ষা করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। এ সম্বন্ধে মন্তব্য প্রসঙ্গে জনৈক সরকারী মুখপাত্র ৮ই ডিসেম্বর নয়া দিল্লীতে বলেন, পাকিস্তান পূর্ব বঙ্গে আত্মসমর্পণ করলে ভারত অন্যান্য ‘ সেক্টরে’ যুদ্ধবিরতি সম্পর্কে সহানুভূতি সহকারে বিবেচনা করবে। ফ্রান্স ও ব্রিটেন ভোটদানে বিরত থাকার জন্য তিনি সন্তোষ প্রকাশ করেন (দি “ গার্ডিয়ান’ ৯ই ডিসেম্বর ১৯৭১)

-ওয়াশিংটন থেকে প্রাপ্ত এক সংবাদে প্রকাশ, ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ শুরু হওয়ার জন্য ভারতকে দায়ী করে প্রেসিডেন্ট নিক্সন সম্প্রতি যে বক্তব্য করেন তার বিরুদ্ধে ৭ই ডিসেম্বর ডেমোক্রেটিক দলভুক্ত সিনেটার এডওয়ার্ড কেনেডী তীব্র প্রতিবাদ জানান।

-গত মার্চ মাস থেকে পূর্ববঙ্গে পাকিস্তানী সৈন্যবাহিনী রীতিবদ্ধভাবে যে বর্বরোচিত অত্যাচার চালায় তাঁর বিরুদ্ধে নিন্দা প্রকাশে বিরত থাকার জন্য তিনি মার্কিন সরকারের সমালোচনা করেন। তিনি বলেন, গত সপ্তাহে কিংবা অত মাসে এই যুদ্ধে শুরু হয়নি। অবোধ নির্বাচনের ফলাফল নাকচ করার উদ্দেশ্য ২৫ শে মার্চ সংঘটিত হত্যাযজ্ঞের মাধ্যমে এই যুদ্ধ শুরু হয়।

সিনেটের কেনেডী আরও বলেন, ভারতের পূর্বঞ্চলে বেপরোয়াভাবে সৃষ্ট পরিস্থিতির জন্য এবং পরিস্থিতির বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে ভারত বাধ্য হয়। এই পরিস্থিতির জন্য পাকিস্তান দায়ী বলে তিনি মন্তব্য করেন।(দি ডেইলি টেলিগ্রাফ ও দি টাইমস, ৮ ডিসেম্বর)

-পাক-ভারত যুদ্ধের ব্যাপারে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে পাকিস্তানের বক্তব্য পেশ করার উদ্দেশ্যে ৭ সদস্যের একটি প্রতিনিধিদলের নেতা হিসাবে পাকিস্তানের ভাবী সহকারী প্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্র মন্ত্রী জনাব জেড ও ভুট্টো আজ সকালে নিউইয়র্ক যাত্রা করিয়াছেন। (এ পি পি)। প্রতিনিধিদলের সহকারী সদস্যগণ হইতেছেনঃ রাতে পাকিস্তানী রাষ্ট্রদূত জনাব এ এইচ বি তাইয়েবজী। বেলগ্রেড নিযুক্ত পাকিস্তানী রাষ্ট্রদূত জনাব আই এ আকন্দ জেনেভায় নিযুক্ত পাকিস্তানী রাষ্ট্রদূত এবং তথায় জাতিসংঘের পাকিস্তানের স্থায়ী প্রতিনিধি জনাব নিয়াজ আহমদ নায়েক এবং ওয়াশিংটনে পাকিস্তানী দূতাবাসের মিনিষ্টার জনাব আকরাম জাকি। বেসরকারী সদস্যগণ হইতেছেনঃ- পূর্ব পাকিস্তানের নবনির্বাচিত এম এন এ জনাব মুজিবুর রহমান (কাইয়ুম গ্রপ) নবনির্বাচিত এম এন এ জনাব মুজাফফর উদ্দীন আহমদ (পিপিপি) এবং রফি রাজা (পিপিপ), (দৈ,পা)।

Reference:

একাত্তরের দশ মাসরবীন্দ্রনাথ ত্রিবেদী