You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.12.11 | ২৪ অগ্রাহয়ণ ১৩৭৮ শনিবার ১১ ডিসেম্বর ১৯৭১ | একাত্তরের দশ মাস - রবীন্দ্রনাথ ত্রিবেদী - সংগ্রামের নোটবুক

২৪ অগ্রাহয়ণ ১৩৭৮ শনিবার ১১ ডিসেম্বর ১৯৭১

দেশের অধিকাংশ থানায় স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা। হিলি সীমান্তে যৌথ বাহিনী প্রচণ্ড প্রতিরোধের মুখোমুখি হয়। সন্ধ্যায় গোবিন্দগঞ্জে পাক বাহিনীর শক্তিশালী ঘাঁটিতে আক্রমণ ও সারারাত যুদ্ধ শেষে ভোরে গোবিন্দগঞ্জের পতন। খুলনার দৌলতপুরে তুমুল সংঘর্ষ। ময়মনসিংহ অঞ্চলের পাক সেনাদের টাঙ্গাইল গিয়ে আশ্রয় লাভ। ফেঞ্জুগঞ্জ মুক্ত। মৌলবী বাজারের পতন। নরসিংদীতে যৌথ বাহিনীর দখল প্রতিষ্ঠা। জাতিসংঘের অনুরোধে বিদেশী নাগরিকদের স্থানান্তরের জন্য ঢাকা বিমান বন্দরে সাময়িক কালের জন্য বিমান হামলা স্থগিত। যুদ্ধু বিরতির জন্য মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলীর জাতিসংঘ সদর দপ্তরে জরুরী বার্তা প্রেরণ। বঙ্গোপসাগর অভিমুখে মার্কিন সপ্তম নৌবহরে টাস্ক ফোর্স। মিত্র বাহিনী এগিয়ে চলেছে। পাকবাহিনীর হাত থেকে একে একে নিবেছে দেউটি। পতনের তালিকায় যুক্ত হ’ল জামালপুর, ময়মনসিংহ, গাইবান্ধা, চণ্ডীপুর,  টাঙ্গাইল, কুষ্টিয়া, ফুলছড়িহাট বাহাদুরাবাদ ঘাট, মুক্ত হল অবরুদ্ধ বাংলাদেশের ১২ টি গুরুত্বপূর্ণ এলাকা মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনীর হাতে। পাক-সেনার একদল টাঙ্গাইলের দিকে পিছু হটে যায়। বিমান হামলা করেছে মিত্রবাহিনী ভৈরবে। পলায়নরত পাকবাহিনীকে বিমান হামলা দিয়ে বিচ্ছন্ন করে দেয়া হয়, যাতে একত্রিত হয়ে ঢাকামুখী না যেতে পারে। ঢাকায় বিমান হামলা হয়নি। বিদেশী দূতাবাস আবেদন জানিয়েছে তাঁদের সরিয়ে নেবার। ঢাকায় আন্তর্জাতিক বিমান নামতে দেয়া হবে। মেরামত হবে ঢাকা বিমান বন্দরের রানওয়ে।–লেখক।

-মুক্ত যশোরের জনসভায় অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেন। এগুলো হলোঃ যুদ্ধাপরাধীদের বিচার, ২৫ মার্চের পূর্বের মালিককে সম্পতি ফেরত দান, সকল নাগরিকদের সমঅধিকার এবং চারটি রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধকরণ। মুক্ত হ’ল জামালপুর, ময়মনসিংহ, হিলি, গাইবান্ধা, ফুলছড়ি, বাহাদুরাবাদ, পিসপাড়া, দূর্গাদিঘি বিলগ্রাম এবং চণ্ডীপুর। বিভিন্ন এলাকায় শতশত পাকসেনা আত্মসমর্পণ করল। (১০ খ. পৃ ৭৯০)

-মুক্তিবাহিনীর বীর ক্র্যাক প্লাটুন সকাল ১০টায় তোপখানা রোডস্থ মার্কিন তথ্য কেন্দ্র (ইউসিস) অভ্যন্তরে প্রচণ্ড বিস্ফোরণ ঘটায়। গেরিলারা সারা ঢাকার প্রত্যেক এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে। রূপগঞ্জ থানা তখন গেরিলাদের দখলে। পাকবাহিনী হেলিকপ্টার করেও কমাণ্ডো নামাতে চেষ্টা করেও সফল হয়নি।

-সম্মিলিত বাহিনী ভৈরব বাজারের দক্ষিণের সড়কপথে ঢাকার দিকে অগ্রসর হতে থাকেন। এই দিনে কুমিল্লা সেক্টরে মেঘনার পূর্ব দিকে শত্রু বাহিনী সম্পূর্ণ পর্যুদস্ত হয় এবং সম্মিলিত বাহিনী খুলনায় দশ মাইলের মধ্যে উপস্থিত হয়।

-অবরুদ্ধ বাংলাদেশের পাকসামরিক উপদেষ্টা মেঃ জেঃ রাও ফরমান আলী পাকিস্তানী সৈন্য ও অসামরিক ব্যক্তিদের পাকিস্তানে সরিয়ে নিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে জাতিসংঘের  সাহায্য কামনা করেন। জাতিসংঘে পাকিস্তানের স্থায়ী প্রতিনিধি আগাশাহী জাতিসংঘকে ফরমান আলীর এ বার্তা অগ্রাহ্য করার জন্য আবেদন করেন।

-ঢাকার চারপাশে মিত্রবাহিনী নির্দিষ্ট এলাকায় রাতে ছত্রী সৈন্য অবতরণ করতে থাকে।

-বীর মুক্তিযোদ্ধা কাদের সিদ্দিকীর নেতৃত্ব মুক্তিযোদ্ধারা সমগ্র টাঙ্গাইল হানাদার মুক্ত করে। নিরালা ব্রিজের কাছে রাজাকারদের গুলিতে শহীদ হন হাবিবুর রহমান (আওয়ামী লীগ কর্মী)। উল্লেখ্য ২৬ মার্চ বদিউজ্জামান খা এমপিএ, আবদুল লতিফ সিদ্দিকী সেদিন থেকেই তরুণদের নিয়ে তাঁর কাদেরিয় বাহিনী গড়ে তোলেন। তারপর ১৯ এপ্রিল কালিহাতি যুদ্ধ থেকে ১১ ডিসেম্বর টাঙ্গাইল মুক্ত করার যুদ্ধ পর্যন্ত কাদেরিয়া বাহিনী শতাধিকবার পাকসেনাদের সঙ্গে মুখোমুখি লড়াই করেছে। তাঁর মধ্যে আগষ্ট মাসে ভুয়াপুরের জাহাজ হামলা ছিল সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য। এই হামলা কাদেরিয়া বাহিনী ১ লাখ ২০ হাজার বাক্স অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদ উদ্ধার করে। যার মূল্য ছিল ২১ কোটি টাকা

-কুষ্টিয়া এদিন হানাদার মুক্ত হয়। মুক্তিবাহিনী ও মিত্র বাহিনির৬ দিন ব্যাপী অবরোধ ও প্রচণ্ড যুদ্ধের পর এদিন ভোরে জামালপুর হানাদার মুক্ত হয়। জামালপুর গ্যারিসনে অবস্তানকারী পাকসেনার ২১ বেলুচ রেজিমেন্টের ৬ জন অফিসার ও ৫২২ জন সেনা যৌথ বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করে। পাক সেনাদের মধ্যে নিহ হয় ২১২ আর আহত হয় ২০০ জন।

-এদিন মিত্র-মুক্তিবাহিনীর হাতে জামালপুর পতনের পর ময়মনসিংহ ও টাঙ্গাইল থেকে পাকসেনারা ঢাকার দিকে পালাতে থাকে। যৌথ বাহিনী জামালপুর-ঢাকা মহসড়ক পাকসেনাদের আক্রমণ করে এবং ৩০০ জন পাকসেনাকে হত্যা করে। এই যৌথ বাহিনী টঙ্গীর লকাছে তুরাগ নদীর তীরে পৌছা পর্যন্ত কোন প্রতিরোধের সম্মুখীন হয়নি। জামালপুর-টাঙ্গাইল-ঢাকা মহাসড়ক পথেই রচিত হয় যৌথ বাহিনীর অবিস্মরণীয় বিজয় গাথা।

-পাকবাহিনী অপ্রতিরোধ্য সম্মিলিত বাহিনীর গতিরোধ করার জন্য পদ্মা নদীর উপর বৃহত্তর রেলসেতু হার্ডিঞ্জ ব্রীজের কয়েকটি স্প্যান উড়িয়ে দেয়।

-ব্রিটিশ বিমান বাহিনীর বিশেষ বিমান ঢাকা থেকে ব্রিটিস ও অন্যান্য বিদেশী নাগরিক অপসারিত।

-ঢাকায় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একজন মুখপাত্র সাংবাদিকদের জানান, যদিও পূর্বাঞ্চলের যুদ্ধাবস্থা খুব ভালো নয় তথাপি আমাদের আত্মসমর্পণের কোন প্রশ্নই ওঠে না।

-ঢাকায় বিকাল ৩ টা থেকে অনির্দিষ্ট কালের জন্য সান্ধ্য আইন জারি।

-পাকিস্তানের নব নিযুক্ত প্রধানমন্ত্রী জনাব নুরুল আমিন গত বৃহস্পতিবার রাতে বেতার ভাষণে বলেন, আসুন আমরা সম্মুখ পানে অগ্রসর হই এবং সেনাবাহিনীর সহিত কাঁধে কাঁধ মিলাইয়া কাজ করি। উল্লেখ্য আবদুল গাফফার চৌধুরী লিখেছেন একুশে ফেব্রুয়ারী হত্যা কাণ্ডের নায়ক নূরুল আমিন ২৬ ফেব্রুয়ারি ‘ ৫২ ঢাকা রেডিও থেকে এক ভাষণে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনকারীদের ভারতীয় চর আখ্যা দিয়েছিলেন। নারায়ণগঞ্জে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের শোভাযাত্রায়, ‘জয় হিন্দ’ শ্লোগান শোণা গেছে বলেও প্রচার করেছিলেন। ’৫৪ সালের নির্বাচনের পর সাত বছর রাজনৈতিক অঙ্গন থেকে নির্বাসিত থাকার পর ষাটের দশকের গোড়ায় যখন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর আমন্ত্রণে গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে ফিরে এলেন, তখন অনেকেই মনে করেছিলেন ভদ্রলোকের খোলস বদলেছে। কিন্তু প্রমাণ করলেন, খাসলাৎ যায় না মরলেও। (নিরুদ্দিষ্ট নয় মাস/ দৈঃ বাঃ ডিসেম্বর ‘ ৭২)

-পাকিস্তান সাধারণ পরিষদের আশু যুদ্ধ বিরতি ও সৈন্য প্রত্যাহারের প্রস্তাব গ্রহণ করিয়াছে বলিয়া গতকাল এখানে আনুষ্ঠানিকভাবে উল্লেখ করা হয়। (দৈঃ ইঃ)

-ভারতীয় প্রধামন্ত্রীর বিশেষ দূত মিঃ ডিপি ধর মস্কো পৌঁছানোর পরে সোভিয়েত সরকার ভারত সরকারের সঙ্গে আলোচনার জন্য ব্যাপক ক্ষমতা প্রদান করা হয়েছিল।

-ইসলামাবাদ থেকে যুদ্ধ অব্যাহত আখার জন্য রাও ফরমান আলীর আবেদনের উত্তরে বলা হয়- বন্ধুরাষ্ট্ররা সাহায্যে এগিয়ে আসছে’ উল্লেখ্য মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনী আক্রমণের তীব্রতার মুখে আবদ্ধ বহু পাক সেনা স্বেচ্ছায় আত্মসমর্পণ করে। পাকবাহিনী মুক্তিযোদ্ধাদের অগ্রগতি প্রতিহত করার জন্য ভৈরব রেলসেতু ও হার্ডিঞ্জ ব্রীজের কয়েকটি স্প্যান উড়িয়ে দেয়।

-আনন্দবাজার পত্রিকা লিখেছে, শনিবার বিকাল পর্যন্ত চব্বিশ ঘন্টায় প্রায় দু’হাজার পাক সৈন্য আত্মসমর্পনের খবর এসেছে। আর এ দিন রাতে তুমুল যুদ্ধের পর দক্ষিণ পশ্চিম বাংলাদেশের ১২টি গুরুত্বপূর্ণ শহর কুষ্টিয়া মুক্ত হয়েছে। ময়মনসিংহ, জামালপুর, নোয়াখালি, হিলিও মুক্ত। রংপুর জেলার গাইবান্ধা, ফুলছড়ি, বাহাদুরাবাদ, পিসগাড়া, দূর্গাদিঘি, বিরগ্রাম ও চণ্ডীপুর স্বাধীন।

-শুক্রবার চট্টগ্রাম জেলার কক্সবাজার বিমান ঘাঁটিটি মিত্রবাহিনী নৌ বাহিনীর প্রচণ্ড বোমাবর্ষণ ব্যবহারের অযোগ্য হয়ে যায়।

-বিপ্লবী বাংলাদেশ সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদ যশোহর মুক্ত হবার পর আজ বিশাল জনসভায় কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেন। এই সিদ্ধান্তগুলি হলোঃ

(এক) বাংলাদেশ সরকার ওয়ার ট্রাইবুন্যাল গঠন করছেন। এই ট্রাইবুন্যালে নরহত্যা, লুণ্ঠন, গৃহদাহ ও নারী নির্যাতনের অভিযোগ যুদ্ধ বন্দীদের বিচার করা হবে।

(দুই) ২৫ মার্চের আগে যিনি জমি দোকানের মালিক ছিলেন তাঁকে সব ফিরিয়ে দিতে হবে।

(তিন) সক নাগরিকের ধর্মীয় স্বাধীনতা থাকবে।

(চার) চারটি রাজনৈতিক দল (মুসলিম লীগ, পিডিপি, জামাতে ইসলামী ও নেজামী রয়েছে) নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়।

-প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদ বিপুল হর্ষধ্বনি মধ্যে যশোর জনসভায় বলেন, ইয়াহিয়া চক্র বাঙালী জাতিকে ধ্বংস করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু তা তারা পারল না। লাখ লাখ শহীদের আত্মত্যাগের বিনিময়ে যে স্বাধীনতা এল তাঁকে বাস্তবে রূপ দেওয়ার জন্য দেশবাসীকে কৃচ্ছতাসাধান করার জন্য আহ্বান জানিয়ে বলেন, নবজাত এই শিশু রাষ্ট্রকে গড়ে তোলার দায়িত্ব প্রতিটি বাঙালীর। অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি বলেন, নবজাত এই শিশু রাষ্ট্রকে গড়ে তোলার দায়িত্ব প্রতিটি বাঙালীর। অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি বলেন, ভারতের সঙ্গে আমাদের বন্ধুত্ব হয়েছে পরস্পরের সার্বভৌম, স্বাধীনতা অক্ষুন্ন রেখে। কোন কিছুর বিনিময়ে নয়। ভারত মানবতার যে উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত দেখ্যেছে পৃথিবীর ইতিহাসে এর নজির পাওয়া যাবে না। সভাপতিত্ব করেন জনাব সোহরাব হোসেন এম, এন, এ বক্তৃতা করেন শ্রী সুবোধ মিত্র এম, এন, এ, শ্রী ফনী মজুমদার এম, পি, এ রওশন আলি এম, এন, এ, ব্যারিষ্টার আমিরুল ইসলাম এম, এন, এ, আবদুর রশিদ, নূরুল ইসলাম এম, এন, এ, ব্যারিষ্টার আমিরুল ইসলাম এম, এন, এ, আবদুর রশিদ, নূরুল ইসলাম এম, এন, এ, ও ছাত্র নেতা আলী তারেক। মুক্ত যশোরে জাতীয় নেতাদ্বয়ের বীরোচিত সম্বর্ধনা দেয়া হয়। (আঃ বাঃ পঃ)

-জাতিসংঘ ভারতীয় প্রতিনিধিদলের সদস্য শ্রী, পি, কে, ব্যানার্জ্জী চীনের অভিযোগ ভিত্তিহীন ও অসত্য বলেছেন। উল্লেখ্য, সাধারণ পরিষদে চীনের প্রতিনিধি মিঃ চেন চু অভিযোগ করেন,  ‘ভারত মহাসাগর এবং উপমহাদেশে নিজের কর্তৃত্ব আরো বাড়ানোর উদ্দেশ্যে ভারত একটি বৃহৎ রাষ্ট্রশক্তির সহায়তায় পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বড় রকমের আক্রমণ চালিয়েছে। পরে ভারত মহাসাগরকে শান্তির এলাকা বলে ঘোষণা করা হোক সিংহলের প্রস্তাবটি গৃহীত হয়। ভারত ও চীন প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দেয়। পক্ষে ৫০ টি ভোট পড়ে। আর ৪৯টি ভোটদানে বিরত ছিলেন। সোভিয়েত প্রতিনিধি মিঃ রমাচিনি চীনকে আক্রমণ করে বলেন, আপনার বিগত ৭ ডিসেম্বর প্রদত্ত ব্রেজনেভের বক্তব্য স্মরণ করা উচিত। ভারতীয় প্রতিনিধি শ্রী ব্যানার্জি বলেন, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের আমন্ত্রণেই ভারতীয় সৈন্য সেখানে পাঠানো হয়েছে।

-লন্ডনে ভারতীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রী সর্দার শরণ সিং বলেছেন, যুদ্ধ বিরতির কথা অবস্তাব। জাতিসংঘকে তিনি জানাবেন, বর্তমানে এটা গ্রহণের অযোগ্য। বাংলাদেশ পরিস্থিতির মূল সমস্যা যতক্ষণ না মিটছে এবং বাংলাদেশের যুদ্ধ বিরতির আলোচনায় যতক্ষণ না বাংলাদেশকে ডাকা হচ্ছে ততক্ষণ যুদ্ধ বিরতি অবাস্তব বলে মনে হয়। তিনি হীথরো বিমানবন্দরে সাংবাদিকদের একথা বলেন। তিনি আরো বলেন যতদিন প্রয়োজন তার বেশি একদিনও আমরা বাংলাদেশে থাকবো না। (আঃ বাঃ পঃ)

-বাংলাদেশের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদ এক সাংবাদিক সম্মেলনে যশোর সার্কিট হাউজে বলেন, তারা তাড়াতাড়ি সংবিধান রচনা করবেন যা ২৪ বছরে পাকিস্তান করতে পারেনি। জনৈক সাংবাদিক প্রশ্ন করেন, এই মুহূর্তে ভারতের পর বাংলাদেশের বন্ধু কে? রাশিয়া না আমেরিকা। অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম হেসে বলেন, ‘ভুটান’। কারণ ভারতের পর ভুটান আমাদের স্বীকৃতি দিয়েছে। অন্য এক প্রশ্নোত্তরে বলেন, অল্প দিনের মধ্যেই ঢাকা যাচ্ছি। তার যশোরে অস্থায়ী রাজধানী করব না।

-গভর্নর ডাঃ মালিকের সামরিক উপদেষ্টা মোঃ জেঃ ফরমান আলী পাকবাহিনীকে সরিয়ে নেবার জন্য জাতিসংঘের সাহায্য চেয়েছিলেন। ঢাকা জাতিসংঘের ত্রাণ অভিযানের ফারসী প্রধান পল মার্ক হেনরী সেক্রেটারী জেনারেল উথান্ট সমীপে বার্তা পৌঁছে দেন। কিন্তু জাতিসংঘে পাকিস্তানী রাষ্ট্রদূত আগাশাহী সঙ্গে সঙ্গে ওই বার্তা গ্রাহ্য না করতে অনুরোধ জানান।

-গত ২৪ ঘন্টার জামালপুরে ৬০০, লাকসাএ ৪০০ এবং মেঘনার পূর্ব পাড়ে বিভিন্ন স্থানে  ৮০০ পাক সৈন্য ইতিমধ্যে মিত্র ও মুক্তি যৌথ বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করেছে। মিত্রবাহিনীর মুখপাত্র এ সংবাদ জানান।

-পাক সহকারী প্রধানমন্ত্রী জেড এ ভুট্টো নিউইয়র্কে এসে কূটনৈতিক অসুস্থতায় ভুগেছিলেন। উথান্ট মার্কিন রাষ্ট্রদূত জর্জ বুশের সঙ্গে তাঁর পূর্ব নির্ধারিত সাক্ষাৎকারে তিনি বাতিল করে দিয়েছেন।

-ভারতের রাষ্ট্রদূত শ্রী সমর সেন গত সন্ধ্যায় জাতিসংঘের মহাসচিবের সঙ্গে এক ঘন্টা কথাবার্তা বলেন। শ্রী সেনকে জিজ্ঞাসা করা হয় পূর্ব বাংলাকে স্বাধীনতার বদলে স্বায়ত্বশাসন দেওয়ার কোন প্রস্তাব প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া করলে ভারত তা মেনে নেবে কি না। প্রত্যুত্তরে বলেন, আমরা বাংলাদেশকে স্বাধীনরাষ্ট্র হিসেবে স্বীকার করে নিয়েছি। এটা হবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আমাদের স্বীকৃতি দান তুলে নিতে বলার মোট। তিনি বলেন, বাংলাদেশ সরকার যখন চাবে এবং তাঁরা যখন নিজেদের প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তার ভার নিজেরাই নিতে পারবেন ঠিক তখনই ভারতীয় সৈন্য পূর্ব বাংলা থেক সরিয়ে আনা হবে। শনিবার নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠক যদি বসে তবে তিনি বাংলাদেশের বিশেষ প্রতিনিধি বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী বক্তব্য পেশ করতে দেওয়ার জন্য আবার দাবি জানাবেন।

-জেনারেল নিয়াজীর কাছে পাঠানো এক বার্তায় প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া বলেনঃ কেবল আপনার জানার জন্য বলছি মার্কিন সপ্তম নৌবহর খুব শিগগিরই সাহায্য এগিয়ে আসবে। অপর দিকে চীনা সৈন্যরা নেফা সীমান্ত যুদ্ধের প্রস্তুতি নিয়েছে। যদিও ভারত এই খবর চেপে রাখার চেষ্টা চালাচ্ছে। এছাড়া যুক্তরাষ্ট্র আন্তর্জাতিক ভাবে ভারত ও রাশিয়ার ওপর চাপ সৃষ্টি করেছে।

-পশ্চিমবঙ্গ লেখক সমিতি, বাংলাদেশ বুদ্ধিজীবী সংগ্রাম পরিষদ এবং বাংলাদেশ সহায়ক শিল্পী সাহিত্যিক বুদ্ধিজীবী সমিতি মুক্ত ভাবে কলকাতা শহীদ মিনারের পাদদেশে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সরকারের ভারত সরকারের স্বীকৃতি দান উপলক্ষে এক উৎসব সভায় মিলিত হয়। পৌরহিত্য করেন ডঃ রমা চৌধুরী। বক্তব্য রাখেন সর্বশ্রী সন্তোষকুমার ঘোষ, শওকত ওসমান, মনোজ বসু, গোপাল হালদার, নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্ত্তী, শিল্পী কামরুল হাসান, দীপেন্দ্রনাথ বন্দোপাধ্যায়। সঙ্গীত পরিবেশন করেন শ্রীমতী সুচিত্রা মিত্র, সাবিতব্রত দত্ত। আবৃত্তি করেন সর্বশ্রী শম্ভু মিত্র তৃপ্তি, দেবদুলাল বন্দোপাধ্যায়। শেষে শ্রী অশোকতরু বন্দ্যেপাধ্যায়, সবিতা দত্ত, শ্রীমতী রমা গুহঠাকুতার পরিচালনায় ক্যালকাটা ইয়থ  ও বাংলাদেশের শিল্পীবৃন্ধ সঙ্গীত পরিবেশন করেন। (আঃ বা। প।)

-কলিকাতা সুবোধ মল্লিক স্কোয়ারে এক প্রতিবাদ সভায় সদস্য শ্রী সমর গুহ চীন ও মার্কিনেরা বাংলাদেশ স্বাধীনতা সম্বন্ধে নীতিভঙ্গীর সমালোচনা করেন। হাজরা পার্কের জনসভায় শ্রী অজয় কুমার মুখোপাধ্যায়, শ্রী রণেশ দাশগুপ্ত, মহম্মদ আলী এম,এন,এ বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সাফল্য কামনা করেন।

-আশুগঞ্জে পাক বাহিনীর ১৪ ডিভিশন সুদৃঢ় ঘাঁটি নির্মাণ করেছিল মিত্রবাহিনী ১৮ রাজপুত রেজিমেন্ট পাকব্যুহ ভেদ করে আশুগঞ্জে ঢুকে পড়ে। ‘এস ফোর্স’ ও তিন নম্বর সেক্টর সৈন্যরা বিপুল বিক্রমে এই যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। ডিসেম্বর ১০/১১ পাক সেনারা আশুগঞ্জ ছেড়ে ভৈরব চলে যায় এবং ভৈরব ব্রিজটি ধ্বংস করে। ভারতীয় ১৯ পাঞ্জাব হেলিকপ্টার যোগে নদীর অপর পারে নামানো হয়। দ্বিতীয় বেঙ্গল ও তিন নম্বর অবরোধ রাখে। (১০ খ. ৭৬৩ পৃঃ)

-এক নম্বর সেক্ট্র মুক্তিযোদ্ধারা ছাগলনাইয়া মুক্ত করে। ক্যাপ্টেন মাহমুদ ‘কে’ ফোর্সের সাথে যোগ দিয়ে ফেনী চট্টগ্রাম সড়ক ধরে একদল এবং মুহুরী নদী ধরে অপর দলটি চট্টগ্রামের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। সম্মিলিত বাহিনীর সাতেহ (ডিসেম্বর ৯) জোয়ারগঞ্জ এসে পৌঁছায়। জোয়ারগঞ্জ যুদ্ধে ১২ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। শুভপুর ব্রিজটি পলায়ন পর পাকবাহিনী ধ্বংস করেদেয়। সীতাকুণ্ড দখলের জন্য ক্যাপ্টে মাহফুজ ডানদিক থেকে অগ্রসর হয় এবং মিত্রবাহিনী সম্মুখভাগে এগিয়ে চলে। যৌথ বাহিনী চন্দ্রকান্তের মন্দিরে এসে পৌঁছালে পাকসেনারা আর্টিলারীর সাহায্যে প্রবল্ভাবে বাধা দেয়। ১১ ডিসেম্বর সীতাকুণ্ডের পতন। (১০ খণ্ড ৭৬৪ পৃ)

-১১ নং সেক্টরে মুক্তিবাহিনী হালুয়াঘাট ও নালিতাবাড়ি হয়ে ময়মনসিংহের দিকে ধাবিত হয়। ময়মনসিংহ মুক্ত হয়। (ডিসেম্বর ৬)। জামালপুরে মিত্র ও মুক্তি বাহিনীর সাথে পাকসেনাদের এক প্রচণ্ড যুদ্ধ হয়। পাকবাহিনী পরাজিত হয়। (ডিসেম্বর ১১) মিত্র বাহিনীর মেজর জেনারেল গিল গুরুতরভাবে আহত হলে মেজর জেনারেল গান্ধর্ব নাগরা অধিনায়ক নিযুক্ত হন। পাকসেনারা টাঙ্গাইলের দিকে সরে যায়। সম্মিলিত বাহিনী টাঙ্গাইল পথ অনুসরণ করে। উল্লেখ্য, ১০১ কমিউনিকেশন জোন এলাকার সম্মিলিত বাহিনী তুরা থেকে জামালপুরের দিকে ধাবিত হয়।

-১১ ডিসেম্বর ঢাকা থেকে মিস ক্লেয়ার হোলিং ওয়ার্থ কর্তৃক প্রেরিত এক সংবাদে বলা হয় পূর্ব বঙ্গের গভর্ণর ডাঃ আবদুল মোত্তালেব মালিক আত্মসমর্পণের শর্তাবলী নির্ধারণের উদ্দেশ্যে জাতিসংঘের মাধ্যমে ভারতের সঙ্গে আলোচনার জন্য যে প্রস্তাব পেশ করে তার

বিরুদ্ধে ইয়াহিয়া খান ‘ভেটো’ প্রয়োগ করেন। গত শুক্রবার (১০ ডিসেম্বর) মেজর জেনারেল ফরমান আলী খানের মাধ্যমে ডাঃ মালিকের প্রস্তাব ঢাকায় নিয়োজিত জাতিসংঘের প্রতিনিধির নিকট পেশ করা হয়। প্রস্তাবে উল্লিখিত শর্তাবলী যথাক্রমেঃ

 (১) পূর্বাঞ্চলে নিয়োজিত পাক-সেনা বাহিনী ভারতীয় সেনা বাহিনীর নিকট আত্মসমর্পণ করবে,

 (২) বাংলাদেশ গেরিলাদের সঙ্গে এ ব্যাপারে সরকারীভাবে যোগাযোগ করা হবে না

 (৩) এক লক্ষ বেসামরিক পশ্চিম পাকিস্তানী নাগরিককে পশ্চিম পাকিস্তানে পাঠিয়ে দেয়ার ব্যবস্থা করতে হবে।

 (৪) পাকিস্তানী সেনা বাহিনী পর্যায়ক্রমে ফিরে যাবার ব্যবস্থা করতে হবে এবং

 (৫) জাতীয় পরিষদের আওয়ামী লীগ দলভুক্ত সদস্যদের নিকট ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে। (দি সানডে টেলিগ্রাফ, ১২ ডিসেম্বর)

-১১ ডিসেম্বর জেনারেল এ, এ, কে নিয়াজী হঠাৎ ঢাকা বিমান বন্দরে হাজির হয়ে দম্ভ ভরে ঘোষণা করে যে তিনি পালিয়ে যান নি। তার মৃত্যুর পূর্বে ঢাকার পতন হবে না। (দি সানডে টেলিগ্রাফ। ডিসেম্বর)। উল্লেখ্য এ দিন অন্য এক প্রতিবেদনে সানডে টেলিগ্রাফ বলেঃ বাংলাদেশের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম এবং প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদ সহকর্মীদের নিয়ে সদ্যমুক্ত যশোহর পরিদর্শন করেন। বিপুল জনসমুদ্র, ‘জয় বাংলা’ ধ্বনি দিয়ে তাঁদের সম্বর্ধনা জানায়। সেদিন ‘টাইমস’ পত্রিকায় এক সংবাদে বলা হয় মুসলিম লীগ, জামাতে ইসলামী, নেজামে ইসলাম ও পিপলস ডেমোক্রেটিক পার্টিকে বেআইনী প্রতিষ্ঠান হিসাবে গণ্য করা হবে বলে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম যশোহরে ঘোষণা করেন।

Reference:

একাত্তরের দশ মাসরবীন্দ্রনাথ ত্রিবেদী