You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.12.10 | ২৩ অগ্রাহয়ণ ১৩৭৮ শুক্রবার ১০ ডিসেম্বর ১৯৭১ | একাত্তরের দশ মাস - রবীন্দ্রনাথ ত্রিবেদী - সংগ্রামের নোটবুক

২৩ অগ্রাহয়ণ ১৩৭৮ শুক্রবার ১০ ডিসেম্বর ১৯৭১

-মিত্রবাহিনী ঢাকার পথে হেলিকপ্টারে ৫৭ নং ডিভিশনের সৈন্যদের মেঘনানদী অতিক্রম অভিযান চালাল। ভৈরব বাজার ব্রিজ পাকসেনারা বিধ্বস্ত করে নদীর পশ্চিম পারে অবস্থান নেয়।

-মিত্র বাহিনীর বিমান হামলায় রেডিও ঢাকা স্তব্ধ হয়ে যায়। তিনটি টান্সমিটারই বোমার আঘাতে বিচূর্ণ হয়। পূর্বাঞ্চলীয় বিমানবাহিনীর প্রধান প্রখ্যাত মার্শাল দেওয়ান এ সংবাদ জানান।

সম্মিলিত বিমান বাহিনী আজও বার বার ঢাকার চতুর্দিকে পাক সামরিক ঘাঁটিগুলিতে আক্রমণ চালিয়ে ছিল।

-সম্মিলিত বাহিনী বিভিন্ন কৌশলে এগুতে থাকে। জনগণের অপূর্ব সহযোগিতায় মেঘনা পার হলো সুসজ্জিত মিত্রবাহিণি। একদল এলো ভৈরব বাজার ঢাকা মুলরাস্তায় অন্যদল ময়মনসিংহ হয়ে এগিয়ে আসছে। দু দিক থেকে সাঁড়াশি আক্রমণ পড়েছে পাক বাহিনী।

-বোমাবর্ষণ চলছে চট্টগ্রামে ও চালনা বন্দরে। পাকবাহিনী একদল পার্বত্য চট্টগ্রামের পথে আর সুন্দরবনে আশ্রয় নিয়েছে।

-ঢাকার কারফিউ আর ব্ল্যাক আউট চলছে।

-ভারতীয় নৌবাহিনীর আলফা ফোর্স মংলাপোর্টে পৌঁছে যায়। ইতিমধ্যে মুক্তিবাহিনী বেশ কজন পাকনৌবাহিনীর অফিসার আটক করে। সকাল ১১-৩০ মিনিট খুলনার পশ্চিম পোতাশ্রয় পৌঁছে যায়। চল্লিশ মিনিট গোলাবর্ষণ করে।

-ভারতীয় বাহিনী এবং মুক্তিবাহিনী দ্রুত তাঁদের দায়িত্ব সম্পাদন করে ফেলছে না বলে যারা অখুশী তাঁদের বোঝা উচিত যে, পৃথিবীর এক অতি দুরধিগম্য এলাকায় যুদ্ধ চলছে। তা সত্ত্বেও মুক্তিবাহিনী যে গতিতে ঢাকার কাছে পৌঁছে গিয়েছে তা খুবই প্রশংসনীয়।

তাছাড়া যাতে অসামরিক ব্যক্তিরা নিহত না হয় এবং অসামরিক বস্তু বেশী নষ্ট না হয় মুক্তিবাহিনী সেদিকেও লক্ষ্য রাখছে। সেজন্যই সাধারণ যুদ্ধে যা করা হয় সেভাবে ঝাটিতি আক্রমণ করে শহরগুলি ধ্বংস করে ফেলা হচ্ছে না। যাতে ঢাকাস্থিত পাকসেনারা নিজেরাই ধরা দেয় তাঁর জন্য চেষ্টা করা হচ্ছে। তাহলে সরাসরি আঘাত হানা এড়ানো যাবে। আপাতভাবে এতে অনেকের ধৈর্যচ্যুতি ঘটতে পারে কিন্তু শেষ পর্যন্ত এর ফল ভালো হবে। এরকম পরিস্থিতিতে কিছুটা দেরী হওয়ার কারণ সহজবোধ্য। (আঃ ব.প.)

-লাকসাম, কুমিল্লা, ব্রাক্ষণবাড়িয়া, সিলেট, হালুয়াঘাট, রংপুর, দিনাজপুর, কুষ্টিয়া ও খুলনায় প্রচণ্ড লড়াই। বিভিন্ন রণাঙ্গন পাকিস্তান বাহিনীর ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি স্বীকার।

-জাতিসংঘ থেকে সরকারীভাবে ঘোষণা করা হয় সাধারণ পরিষদে সেনাবাহিনী তাঁদের সার্বিক প্রতিরক্ষার কৌশলগত কারণে পূর্ব পাকিস্তানের যে সব যায়গায় ভারতীয় বাহিনীর অধীনে তথাকথিত বাংলাদেশের সমর্থকেরা বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেছে।

-ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেল (বর্তমান হোটেল শেরাটন) ও হলি ফ্যামিলি হাসপাতালকে নিরপেক্ষ জোন ঘোষণা। কূটনৈতিক ও বিদেশী নাগরিকদের হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল আশ্রয় লাভ।

-রাওয়ালপিণ্ডিতে সেনাবাহিনীর জনৈক মুখপাত্র বলেন, বর্তমান যুদ্ধে আমরাই বিজয়ী হচ্ছি, এ সম্পর্কে আমরা সুনিশ্চিত। পূর্বঞ্চলে লেঃ জেনারেল এ এ কে নিয়াজীর অধিনায়কত্ব পাকিস্তান সেনাবাহিনী যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে। পূর্ব পাকিস্তানের পরিস্থিতি অপরিবর্তিত রয়েছে।

সম্মিলিত বাহিনীর বিমান হামলার ফলে ঢাকা বেতার কেন্দ্রের সম্প্রচার কাজ সম্পূর্ণ বন্ধ। উত্তবঙ্গে অবস্থানরত পাকসেনাদের ঢাকা পলায়নের পথ রুদ্ধ। সন্ধ্যায় যৌথ নৌবাহিনীর আলফা ফোর্স মংলাবন্দরের পতন। কুষ্টিয়া থেকে খুলনা পাবনা ও নাটোরের দিকে পালাবার সময় পাকবাহিনী কর্তৃক হার্ডিঞ্জ ব্রিজ ধ্বংস। পলাশবাড়ি মুক্ত। রংপুর ও দিনাজপুরের পাক সেনারা বগুড়া ও রাজশাহী থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন। রাতে বাহাদুরবাদ মুক্তিবাহিনী নিয়ন্ত্রণে আসে। জামালপুর গ্যারিসন আত্মসমর্পণ। শুভপুর ব্রিজের কাছ যৌথবাহিনীর অবস্থান গ্রহণ। আশুগঞ্জ মুক্ত।

-দৈনিক ইত্তেফাকের বিশিষ্ট সাংবাদিক সিরাজুদ্দিন হোসেন, পি পি আই সংবাদ সংস্থা প্রধান সংবাদদাতা নিজামউদ্দিন আহম্মদ এবং পি পি আই এর চীপ রিপোর্টার ও কলাম্বিয়া ব্রড কাষ্টিং সিষ্টেম এর সংবাদদাতা সৈয়দ নাজমুল হককে আলবদর আলশামস বাহিনীর খুনীরা তাঁদের স্ব স্ব বাসভবন থেকে অপহরণ করে। এরপর তিনজন প্রখ্যাত বাঙালী সাংবাদিককে আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। উল্লেখ্য, জামাতে ইসলামের সশস্ত্র সদস্যদের সমন্বয় গঠিত আলবদর বাহিনীর প্রধান পাকসেনাবাহিনীর ক্যাপ্টেন কাইউমের নেতৃত্বে জেনারেল রাও ফরমান আলীর পরিকল্পনা অনুসারে বাঙালী বুদ্ধিজীবীদের বেছে বেছে অপহরণ করা শুরু হয়।

-রেডিও পিকিং থেকে প্রচারিত এক হুঁশিয়ারিতে চীন জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের যুদ্ধ বিরতি প্রস্তাব গ্রহণ জন্য ভারতের বিরুদ্ধে হুমকি ছাড়ে। অন্যথায় লজ্জাকর পরাজয় বরণ করার জন্য ভারতকে প্রস্তুত থাকার আহবান জানায়। উল্লেখ্য এভাবে হুমকির মুখে ভারতের পররাষ্ট্র দফতরের নীতি নির্ধারণী কমিটির তদানীস্তন চেয়ারম্যান মিঃ ডি পি ধর সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে শীর্ষ পর্যায়ের আলোচনার জন্য মস্কো যাত্রা করেন।

-ভারতের প্রধানমন্ত্রী নয়াদিল্লীতে এক বিশাল জনসভায় ভাষণদান কালে ঘোষণা করেন, এ যুদ্ধের বিজয় হবে তখন যখন ঢাকায় স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উড়বে, যেখানে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের নিজস্ব সরকার গঠিত হবে এবং এক কোটি শরণার্থী ভারত থেকে স্বাধীন সার্বভৌম স্বদেশ ফিরে যাবে।

-ভারতের পররাষ্টমন্ত্রী সর্দার শরণসিং এবং পাকিস্তানের সহ প্রধামনমন্ত্রী জেড এ ভুট্টো নিউইয়র্কে পৌঁছাবার পর ভারতীয় পরিস্থিতি নিয়ে নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠকে বসবে। তাঁরা দুজনেই আজ নিউইয়র্কে পৌঁছেছেন। (পি টি আই/ আ.বা.প।)

-হেলিকপ্টারে এবং ষ্টিমারে মেঘনা নদী পেরিয়ে মিত্রবাহিনী বৃহস্পতিবার রাতেই ভৈরব বাজারে ঘাঁটি থেকে এই সৈন্য বাহিনী সোজা ঢাকার দিক এগুচ্ছিল। সম্মিলিত বিমান বাহিনীর রকেট ও বোমা এবং নৌবাহিনীর গানবোট গুলির কামানের গোলার মুখে পাকসেনাবাহিনীর মেঘনার তীরে মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনীর অগ্রগতি রোধ করতে পারেনি।

-বাইরে থেকে পাকসেনারা ঢাকায় ঢুকতে না পারে সেজন্য ও নদীপথে যতগুলা পাকসেনারা ষ্টিমার বা গানবোট এগুবার চেষ্টা করেছে সবগুলির মিত্র বাহিনীর বিয়ানের গোলায় সলিল সমাধি হয়েছে।

-বাংলাদেশের গানবোট পদ্মা ও পলাশ ভারতীয় গানবোট পানভেল মংলাবন্দর হয়ে খুলনা শীপ ইয়ার্ডের কাছে তিনটি জঙ্গী বিমানের আক্রমণের শিকার হয়। বহু নাবিক নিহত হয় ইঞ্জিনরুম আর্টিফিসার মোঃ রুহুল আমীন অকুতভয় বীর মুক্তিযোদ্ধা পলাশের ইঞ্জিনরুমে শহীদ হন। তাঁর বীরত্ব ও দেশপ্রেম চিরভাস্কর। বাংলাদেশ সরকার তাঁকে বীরশেষ্ট উপাধিতে ভূষিত করেন। উল্লেখ্য বাংলাদেশ গানবোট ১২ অক্টোবর কলকাতার গার্ডেন রীচ জেটি থেকে পানিতে ভাসান হয়। এবং ডিসেম্বর ৭ যশোরের পতন হলে খালিসপুর পাকিস্তানী নৌঘাটি পি এন এস তিতুমীর দখলের উদ্দেশ্যে হলদিয়া ঘাঁটি থেকে বাংলাদেশ প্রবেশ করেছিল। অপারেশন হট প্যান্টস সাংকেতিক নামে এই অভিযানের লক্ষ্য ছল খুলনা ও মংলা এলাকায় শত্রু পক্ষের নৌযানের ওপর আঘাত হানা এবং পশুর নদীর মোহনায় মাইন স্থাপন করা।

-ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী ভারতীয় সেনাবাহিনীর অফিসারদের কাছে প্রেরিত এক বাণীতে বলেছেন, সমগ্র দেশ আপনাদের প্রশংসায় মুখর। সমগ্র জাতি আপনাদের পিছনে রয়েছে। লড়াই চালিয়ে যান। আমাদের জন সুনিশ্চিত।

-ইউ এন আই সংবাদ সংস্থার পরিবেশিত সংবাদে বলা হয়, মুক্তিদূতদের অপেক্ষাত এখন ঢাকা। তাই আজ সেখানকার বিদেশী সাংবাদিকরা তুলে ধরেছেন শহরের একটা ছোট খাটো ছবি। বিবিসির সংবাদদাতা বলেছেন, ভারতীয় বাহিনীর আগমনের মুখে উত্তেজনা বেড়ে চলেছে। কারণ পাকবাহিনী যদি লড়াইয়ে নেমে ফয়সালা করতে চায়, তবে সেক্ষেত্রে প্রচুর প্রাণহানির সম্ভাবনা রয়েছে।

-অষ্ট্রেলিয়ার রেডিওর সংবাদদাতা জানাচ্ছেন, হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে আছেন তিনশরও বেশী বিদেশী ৩৭৩ জন পাক কর্মকর্তা- তাঁরা সবাই পরবর্তী ঘটনাবলীর জন্য উৎকণ্ঠিত। (আ। বা। প।)

-শুক্রবার ভারতীয় নৌবাহিনী বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তর বন্দর চালনা মুক্ত করেছে। মুক্তিবাহিনী পাশে দাঁড়িয়ে লড়াই করে নোয়খালী জেলা কমিটি ছিনিয়ে নিয়েছে।

-খুলনার পথে মিত্রবাহিনী চোঙ্গাগুটিয়া হরিবাংকরা ও ভাঙ্গামারা দখল করে ফুলতলি তে পৌঁছে যায়। কুষ্টিয়া মুক্ত হওয়ার পথে। দিনাজপুর শহরটিও পাকসেনা মুক্ত করা নিয়ে গত চারদিন ধরে প্রচণ্ড যুদ্ধ চলছিল। সৈয়দপুরে তীব্র যুদ্ধ চলছে। পাকসেনারা হিলিতে অবরুদ্ধ। মিত্রবাহিনী হিলি ও গাইবান্ধ্যার মধ্যে সড়কটি কেটে দেয়। সম্মিলিত বিমান বাহিনী ৪০ বার বোমাবর্ষণ করেছে।

-দিনাজপুর-রংপুর ফুলবাড়িয়ার মধ্যে রেল যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন এবং পাকিস্তানী এবং পাক বাহিনীর মিলিটারী স্পেশাল ট্রেন দিয়েছে। জামালপুর গ্যারিসন অবরুদ্ধ। প্রচণ্ড গোলাবর্ষণ হয়েছে হানাদার পাকবাহিনী পালাবার আর কোন পথ নেই।

-ভারতীয় সামরিক বাহিনীর মুখপাত্র সাংবাদিকদের জানান শুক্রবার ভোরে পাক নৌবহর চালনায় তিনঘন্টা যুদ্ধে অন্তত দশটি জাহাজ নষ্ট হয়েছে। বৃহস্পতিবার চট্টগ্রাম বন্দরে চারটি গানবোট ডুবিয়ে দেয়া হয়েছে তিনি আরো বলেন, ময়নামতী ক্যান্টনম্যান্টের পাকসেনারা ভারতীয় সেনাদের উপর পাল্টা আক্রমণের চেষ্টা করলে তা স্তব্ধ করে দেওয়া হয়। লেঃ জেঃ এস এল থাপান জানান, ১৫০০ পাক নিয়মিত সেনা ধরা পড়েছে। ৪১৩  জন মারা গিয়েছে। পাকসেনাদের উত্তরাঞ্চলে ৭টি ট্যাঙ্ক ঘায়েল হয়েছে। চাঁদপুর মুক্ত করার সময় ৯০ জন পাকসেনা বন্দী হয়।

-পাক প্রতিনিধি সহ প্রধানমন্ত্রী জেড এ ভুট্টো নিউইয়র্ক যাবার পথে ফ্রাঙ্কফুটে বলেছেন শান্তিপূর্ণ মীমাংসার জন্য নয়াদিল্লীর সঙ্গে কথা বলতে তার দেশ যে কোনও মুল্যে শান্তিতে তিনি রাজি নন। দরকার হলে ভারতের সঙ্গে তারা আরও লড়ে যাবেন।

-লন্ডনের দৈনিক পত্রিকা টাইমস আর ডেইলি মেল এক সম্পাদকীয় মন্তব্য করে যে, পশ্চিম পাকিস্তানী দখলদার সৈন্যদের এখন আত্মসমর্পণ করাই ভাল। দৈনিকটি আরও বলেছেন যে, ভারতের প্রধান মন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী এই পাক সেনাদের আত্নসমর্পনের জন্য অনুগ্রহ করে আরও ২৪ ঘণ্টা সময় দেন।

    ব্রাসেলস থেকে এক খবরে বলা হয়, পাক ভারত যুদ্ধের ব্যাপারে পঞ্চবৃহৎ শক্তির যে দিকেই যাক না কেন, তলে তলে সবাই কিন্ত প্রতিনিধিদের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে যাচ্ছে। ব্রিটিশ ও ফরাসী সরকার তো স্পষ্ট ভাবছেন যে, স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের অভ্যুদয়াকে এখন আর কোনক্রমেই ঠেকিয়ে রাখতে পারবে না।তাঁরা যেমন বাংলাদেশের প্রতিনিধিদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন, তেমনি যোগ রাখছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রীয়, চীনও বাদ যাচ্ছে না। (আ, বা, প)

  মস্কো থেকে তাস এক রিপোর্টে ভারত পাক সংঘর্ষে মার্কিন নীতিকে একপেশে এবং ভারতবিরোধী বলে অভিহিত করেছে।

রেডিও পাকিস্তান (ডিসেম্বর ৯) বলেছিল, ভারতের সামরিক অভিযানে রাশিয়ানরা রয়েছে। আজ নয়াদিল্লীতে একজন মুখপাত্র এই অভিযোগে সবৈর্ব ভিক্তিহীন বলে উড়িয়ে দেন। তিনি বলেন, কোন রুশ ভারতের হয়ে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে লড়ছেন না। (আ. বা. প.)

  গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার কুমিল্লা ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় অসামরিক প্রশাসন ব্যবস্থা চালু করেছেন। বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ সরকার ও আওয়ামী লীগের যৌথ উদ্যোগে এক জনসভায় আলহাজ্ব জহুর আহম্মদ চৌধুরীর বক্তৃতায় স্বাধীনতার পটভূমিকা বর্ণনা করেন। মুক্তিবাহিনীর সদস্যগণ আইন শৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব নিয়েছেন। শহরে স্বাভাবিক জীবন যাত্রা ফিরে এসেছে।

ভারত বাংলাদেশের মধ্যে একটি যুক্ত সামরিক কমাণ্ডো গঠন ও কিরূপ রণকৌশল গ্রহ্ন করা যায় সে বিষয়ে কয়েক দিনের আলাপ আলোচনার পর দুই সরকারের মধ্যে চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ভারতের পক্ষে চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছেন শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী বাংলাদেশের পক্ষে সই দিয়েছেন অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ। (আ. বা. প.)

ভারতের প্রধান মন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদের উদ্দেশ্যে প্রদত্ত বক্তব্যে বলেন, পাকিস্তানী সেনা বাংলাদেশ ছেড়ে না গেলে ভারত যুদ্ধ বিরতি প্রস্তান গ্রহণ করবে না। জাতিসংঘ যুদ্ধ বিরতি প্রস্তাব পাকিস্তান গ্রহণ করলেও ভারতের পূর্বোক্ত ভুমিকা এখনও অক্ষুন্ন আছে। উল্লেখ্য ভারতের পাকিস্তানে জাতিসংঘ তার পর্যবেক্ষক নিয়োগ করবে এই শর্তে পাকিস্তান যুদ্ধ বিরতি প্রস্তাব মেনে নিতে রাজি আছে। অন্যত্র জেনারেল মানেকশ জাতিসংঘে সামরিক পর্যবেক্ষকদের নেতা জেনারেল টামারা বলেছেন যে, যে উদ্দেশ্যে পর্যবেক্ষক দল রাখা হয়েছিল পাকিস্তান কর্তৃক ভারত আক্রমণের পর তা অর্থহীন হয়ে পড়েছে। (আ. বা. প.)

গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের ত্রান ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জনাব এ এইচ এম কামরুজ্জামানের সঙ্গে ভারতের পূনর্বাসন মন্ত্রী শ্রী আর কে খাদলকার মুজিব নগরে শরণার্থীদের স্বগৃহে সৃষ্ট পুনর্বাসন ব্যবস্থা নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা করেন। (আ. বা. প.)

পাক সামরিক সরকারের বেসামরিক গভর্ণর ডাঃ এ এম মালিক ঢাকাস্থ জাতিসংঘের প্রতিনিধি মিঃ হেনরীর হাতে হাতে যুদ্ধ বিরতির নোটটি তুলে দেন, সে সময় মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী, চীফ সেক্রেটারী মিঃ মুজাফফর হোসেন তার সঙ্গে ছিলেন। উল্লেখ্য যুদ্ধ বিরতি প্রস্তাব জাতিসংঘের কাছে যেতেই তা আর বিশ্বের কাদছে গোপন রাখা গেল না। কয়েকটি প্রধান বিদেশী বেতার কেন্দ্র বিষয়বস্তু প্রকাশ করে দেয়। ১৩ ডিসেম্বর রাওয়াল পিণ্ডিতে এক  সাংবাদিক সম্মেলনে একজন সরকারী মুখপাত্র এই যুদ্ধ বিরতির প্রস্তাবের কথা সরাসরি অস্বীকার করেন।

-সিদ্দিক সালিক লিখছেঃ  ১০ ডিসেম্বর দেয়ালের লিখন এমনই পরিষ্কার হয়ে গেল যে, মেজর জেনারেল জামশেদকে ঢাকার রক্ষক হিসেবে কার্যক্রম হাতে নিতে হলো এবং আরো অন্তরালে স্বেচ্ছা নির্বাসনে চলে গেলেন নিযামী। ঢাকা রক্ষার বহিঃসীমার স্তর অথবা থাম হিসেবে মোকাবেলার জন্যে সৈনিকরা উত্তর পশ্চিম মানিকগঞ্জ রেখা বরাবর অবস্থান নেবে। দক্ষিণে থাকবে কালিয়াকৈর; পূর্বে নারায়ণগঞ্জ, পূর্ব দাউদকান্দিতে এবং দক্ষিণ পূর্ব মুন্সীগঞ্জে। আশা করা হয়, ৯৩ এওহক ব্রিগেড (চাঁদপুর) যথাক্রমে কালিয়াকৈর, নরসিংদী, দাউদকান্দি এবং মুন্সিগঞ্জ এসে অবস্থান নেবে। এ আশা আর বাস্তবায়িত হয়নি। (নিয়াজী আত্মসমর্পণের দলিল পৃঃ ২০১)

-এদিনের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ঘটনা সম্বন্ধে কিসিং আরকাইভস লিখেছেঃ “”Mrs Gandhi, Syed Najrul Islam (acting  president of Bangladesh Government) and Mr. Tajuddin Ahmed (Prime Minister in the Bangladesh Government) signed and agreement on Dec. 10 placing the Mukti Bahini under the command of Lieut-General Jagjit sing Aurora (C-in-C Indian Eastern Command), who would report to the two heads of Government throught General Manekshaw. The Indian forces in East Pakistan and the Mukti Bahini would jointly maintain order in the liberated areas, restore essential services and arrange for the early return of refugees.” (KCA, pp.25054)

-এদিন মুক্তিবাহিণী-মিত্র বাহিনী যৌথভাবে আক্রমণ চালিয়ে ময়মনসিংহ শত্রুমুক্ত করে। এই যৌথ বাহিনী হালুয়াঘাট (৭ ডিসেম্বর), ফুলপুর (৮ ডিসেম্বর), তারাকান্দা (৯ ডিসেম্বর) হানাদার পাক বাহিনীর হাত থেকে মুক্ত করে এবং বিজয় পতাকা উড়িয়ে ময়মনসিংহ শহরে প্রবেশ করে। উল্লেখ্য ময়মনসিংহ শহরে পাক সেনারা ডাকবাংলো, কেওয়াটখালি, বড়বাজার, নিউমার্কেট, কালিবাড়ি ও সাহেবআলি রোড এলাকায় বহু নিরীহ সাধারণ লোককে হত্যা করে। স্বাধীনতার পর ময়মনসিংহ জেলায় ১২টি বধ্যভূমি পাওয়া যায়।

Reference:

একাত্তরের দশ মাসরবীন্দ্রনাথ ত্রিবেদী