You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.12.16 | ২৯ অগ্রহায়ণ ১৩৭৮ বৃহস্পতিবার, ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ | একাত্তরের দশ মাস - রবীন্দ্রনাথ ত্রিবেদী - সংগ্রামের নোটবুক

২৯ অগ্রহায়ণ ১৩৭৮ বৃহস্পতিবার, ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১

মুক্তিবাহিনীর শ্লোগানঃ ঢাকা চলো, ঢাকা মুক্ত, জয় বাংলা

[জেনারে মানেকশ’ দিল্লীর মার্কিন দূতাবাস এবং আকাশবাণীর মাধ্যমে লেঃ জেল এ এ কে. নিয়াজীকে সকাল ৯টার মধ্যে বিনাশর্তে আত্মসমর্পণের প্রস্তাব মেনে নেবার সময়সীমা নির্দিষ্ট করে দেন। গতকাল বিকেলে ৫টা থেকে আজ সকাল ৯টা পর্যন্ত বিমান হামলা বন্ধ ছিল। নিয়াজী শেষ পর্যন্ত স্থির করলেন যে, জেনারেল মানেক শ’র প্রস্তাবই মেনে নেবেন। পাকিস্তান সশস্ত্র বাহিনীর পূর্বাঞ্চলের অধিনায়ক লেঃ জেনারেল আমীর আবদুল্লাহ খান নিয়াজী বেতারে নির্দিষ্ট তরঙ্গ মারফত মিত্রবাহিনীর সঙ্গে যোগাযোগ করে বিনাশর্তে আত্মসমর্পণের সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেন। ২৭৬ দিনের মুক্তিযুদ্ধ আনুষ্ঠানিকভাবে সমাপ্ত হল। স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের নাম পৃথিবীর মানচিত্রে উৎকীর্ণ হল। ঢাকা বাংলাদেশের রাজধানী হল। ধ্বংসস্পুপের মধ্য থেকে বাঙালি জাতি জাগ্রত হল। বিজয় দিবস থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহম্নাএর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের দিন পর্যন্ত দিনলিপি উপস্থাপন করা হল। (লেখক)]

পাক হানাদার বাহিনী মুক্ত ঢাকা। বিকেল ৫টা মিনিটে রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) সম্মিলিত বাহিনীর প্রধান জেনারেল জগজিৎ সিং আরোরা ও বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনী ডেপুটি চীফ অব ষ্টাফ গ্রুপ ক্যাপ্টেন এ.কে খন্দকারের উপস্থিতিতে আনুষ্ঠানিকভাবে জেনারেল নিয়াজী আত্মসমর্পণ করেন। আত্মসমর্পণের দলিল অনুসারে ৯১,৪৯৮ জন পাকিস্তানী সৈন্য ও তাদের সহযোগী এবং পরিবারবৃন্দ আত্মসমর্পণ করেছিল। তন্মধ্যে, সর্বমোট যুদ্ধবন্দীদের মধ্যে ৫১,৯৯৮ জন ছিল নিয়মিত সেনাবাহিনীর, ১৮,২৮৭ জন আধা সামরিক বাহিনীর এবং ১৬,২৯৩ জন ছিল বেসামরিক ব্যক্তি।

মুজিবনগরস্থ বাংলদেশ সরকারের উর্দ্ধতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে ভারত সরকারের পক্ষ থেকে রাইটার্স বিল্ডিং-এ এক জরুরী বৈঠক হয়। বৈঠক চলাকালে মিঃ আর. গুপ্ত (আই সি এস) বাংলাদেশে পাক-বাহিনীর আত্মসমর্পণের সংবাদ জানান। এই বৈঠকে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন সর্বজনাব রুহুল কুদ্দুস, নুরুল কাদের খান, খন্দকার আসাদুজ্জামান, জয়গোবিন্দ ভৌমিক প্রমুখ সচিববৃন্দ সহ এবং আরও কয়েকজন। ভারত সরকারের বহু উর্দ্ধতন সামরিক ও বেসামরিক কর্মকর্তা উপস্থিত ছিলেন। (১৫ খণ্ডঃ ২৮৩ পৃঃ) উল্লেখ্য, এই বৈঠকের পর পরই বাংলাদেশ সরকারের সচিববৃন্ধ প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের সঙ্গে মিলিত হন। বাংলাদেশের সরকারের পক্ষ পাক-বাহিনীর আত্মসমর্পণের অনুষ্ঠানে যোগদানের জন্য বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সেকেণ্ড-ইন-কমাণ্ড জনাব এ.কে খন্দকার (এয়ার ভাইস-মার্শাল)-কে দুপুরের এক বিশেষ ফ্লাইটে ঢাকায় পাঠান হয়। তিনি আত্মসমর্পণের ঐতিহাসিক অনুষ্ঠানে যোগদানের জন্য ভারতীয় বিমান বাহিনীর একটি বিশেষ বিমানে কলকাতা থেকে আগরতলা হয়ে ঢাকা পৌঁছান। উল্লেখ্য প্রধান সেনাপতি কর্ণেল এম.এ.জি. ওসমানী, এম.এন.এ ১৩ ডিসেম্বর থেকে সিলেট রণাঙ্গণ পরিদর্শনে কলকাতার বাইরে ছিলেন। কর্ণেল ওসমানী পূর্বাঞ্চল সীমান্ত সফর শেষে ফেরার পথে তাঁর হেলিকাপ্টার গুলিবিদ্ধ হয় এবং সহযাত্রী ভারতীয় সেনাবাহিনীর ব্রিগেডিয়ার গুপ্ত, বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ডেপুটি চীফ লেঃ কর্ণেল আব্দুর রব, এম .এন . এ আহত হন। তাঁর হেলিকপ্টারকে লক্ষ্য করে গুলি চালানোর ঘটনাটি এতদিন ছিল রহস্যাবৃত। সম্প্রতি জানা গেছে, ভুলক্রমে মুক্তিবাহিনী থেকেই গুলি চালানো হয়েছিল। সে কারণেই প্রধান সেনাপতি কর্ণেল (পরে জেনারেল) এম.এ.জি. ওসমানী, এম.এন.এ আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে উপস্থিত হতে পারেননি। তিনি ২৪ ডিসেম্বর ঢাকায় ফিরেন।

                        আত্মসমপর্ণের পূর্বোরাগ।।

সকাল আটটায় রাজধানী ঢাকা শহরের প্রান্ত সীমায় পৌঁছে ঢাকা মিরপুর সড়কের হেমায়েতপুর সেতুর উপর দাঁড়িয়ে মেজর জেনারেল নাগরা এক টুকরা কাগজ জীপের বানেটে রেখে শত্রু পক্ষের কমাণ্ডার আমী আব্দুল্লাহ নিয়াজীকে যৌথবাহিনীর পক্ষ থেকে আত্মসমর্পণের জন্য পত্র লিখলেন। উল্লেখ্য, মেজর জেনারেল নাগরা ও লেঃ জেঃ নিয়াজী ব্রিটিশ আর্মিতে একই সালে কমিশন ও প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন। চিঠিটি ছিল নিম্নরূপঃ প্রিয় আব্দুল্লাহ, আইম এখানে। কোন চিন্তা করিও না। আমি তোমার ভার নেব। বৃথা রক্তপাত এড়িয়ে আত্মসমর্পণ কর। আমার পত্রবাহক মারফত জবাব দেবে আশা করি-ইতি, তোমার নাগরা। ঐ চিঠির প্রত্যুত্তরে আত্মসমর্পণের বার্তা নিয়ে আসে মেজর জেনারেল জামশেদ। সঙ্গে দু’জন লেঃ কর্ণেল, একজন মেজর, দু’জন ক্যাপ্টেন ও কয়েকজন সেনা। তারা একটি মার্সিডিস বেঞ্জ ও দু’টি জীপে আমিনবাজার মসজিদের সামনে ধাকা-আরিচা রাস্তায় এসে দাঁড়ান। যৌথবাহিনীর সেনাপতিরা দাঁড়ান সারিবদ্ধভাবে। মেজর জেনারেল নাগরার বামে ব্রিগেডিয়ার সান সিং (বাবাজী), তাঁর বামে বিগ্রেডিয়ার হরদেব সিং ক্লে ও সর্বশেষ বীর মুক্তিযোদ্ধা কাদের সিদ্দিকী (বাঘা সিদ্দিকী)। এ প্রসঙ্গে কাদের সিদ্দীকী লিখেছেন, মেজর জেনারেল জামসেদ যৌথবাহিনীর সেনানায়নকেদের সামনে দাঁড়িয়ে সামরিক অভিবাদন করার পর নাগরার সামনে এসে কোমর থেকে রিভলবার খুলে দুই প্রসারিত করে জেনারেল নাগরার সামনে বাড়িয়ে দিল। মেজর জেনারেল নাগরা ছটি বুলেট খুলে রেখে রিভলভারটি আবার জামশেদের হাতে ফেরত দিলেন। এরপর জামশেদ আগের মত দুই প্রসারিত হাতে তাঁর সামরিক টুপিটি নাগরার হাতে অর্পণ করলো। মেজর জেনারেল নাগরা লাইন থেকে বেরিয়ে জামশেদের টুপিটি আমার হাতে তুলে দিলেন। জামশেদ তাঁর গাড়ীর ‘জেনারেল ফ্ল্যাগ’ এনে নাগরার হাতে তুলে দিল। নাগরা জেনারেল ফ্ল্যাগটি ব্রিগেডিয়ার সান সিংয়ের হাতে অর্পণ করলেন। মেজর জেনারেল জামশেদ সবশেষে তার কোমর থেকে বেল্ট খুলে নাগরার হাতে দিল। নাগরা তা ব্রিগেডিয়ার ক্লের হাতে দিলেন। তিনি সাময়িকভাবে ব্যবহারের জন্য জামশেদকে বেল্টটি ফিরিয়ে দিলেন। মেজর জেনারেল নাগরার গাড়ী থেকে যৌথবাহিনীর জেনারেল।

ফ্ল্যাগ’ (যৌথবাহিনীর ছিল না) খুলে আত্নসমর্গিত পাকিস্তাকন বাহিনীর মার্সিডিস বেঞ্জে লাগিয়ে জামশেদকে নিয়ে আমরা অবরুদ্ধ শত্রু ঘাঁটির দিকে এগুলাম।’ সকাল দশটা পাঁচ মিনিটে আমাএদের গাড়ী নিয়াজীর ১৪তম ডিভিশন সদর দপ্তরের সামনে এসে দাঁড়ালো। জামশেদ আমাদের নিয়াজীর দপ্তরে পৌঁছে দিয়ে চলে গেল। সকাল দশটা দশ মিনিটে নিয়াজী তার অফিস ঘরে এল। অফিসে ঢুকে তার চেয়ারের পাশে দাড়িয়ে বিজয়ী সেনাপতিদের সামরিক অভিবাদন জানালো তারপর আলোচনা হলো সময় ও স্থান নিয়ে, কোথায় আত্নসমর্পণ হবে। (স্বাধীঃ ৭১, ২য় খণ্ড, পৃঃ ২৮৩)

  আনন্দবাজার পত্রিকা’ আজ সকালের সংখ্যায় ৬ কলাম শিরোনামে সংবাদ প্রকাশিত হয়ঃ

 ‘নিয়াজির আরজি-যুদ্ধ বিরতি চাই’ ।। মানেকশঃ না, আত্নসমর্পণ।।

মেয়াদ আজ সকাল নয়টা, ততক্ষণ বোমাবর্ষণও বন্ধ।।                              

রাজধানীর রাজনৈতিক সংবাদদাতা)

নয়াদিল্লী, ১৫ ডিসেম্বর ঢাকায় নিরুপায় পশ্চিম পাকিস্তানী সেনানায়ক নিয়াজী এখন নতজানু। রণসাধ তার মিটেছে। তাই এখন তিনি চান যুদ্ধ বিরতি। তার এই আরজি ভারতের সেনানায়ক জেনারেল মানেক ‘শ সমীপে পাঠিয়ে দিয়েছেন দিল্লির মার্কিন দূতবাসে। সঙ্গে সঙ্গে মিলেছে জেনারেলের উত্তর। তিনি বলেছেন, যুদ্ধ বিরতি নয়, আত্নসমর্পণ করুন। আমি আশা করি, বাংলাদেশে আপনার আজ্ঞাবহ সৈনিকদের অবিলম্বে যুদ্ধ থামাতে বলবেন এবং আমার আগুয়ান সেনাবাহিনীকে যেখানেই দেখা যাবে সেখানে তাদের কাছে আত্নসমর্পণ করারও হুকুম দেবেন, বিশ্বাসের প্রমাণ হিসেবে জেনারেল মানেকশ’ জানিয়েছেন, অবরুদ্ধ ঢাকার ওপর আজ বিকাল পাঁচটা থেকে আগামীকাল সকাল ন’টা পর্যন্ত বিমান বাহিনীর আক্রমণ বন্ধ। তবে স্থল বাহিনী এবং মুক্তিফৌজ যথারীতি কাজ চালিয়ে যাবেন। জেনারলে মানেক ‘শ’র উত্তরও গিয়েছে মার্কিন দূতবাস মারফত। নিয়াজীর বার্তায় সাক্ষী হিসাবে সই করেছেন পূর্ব বাংলার জঙ্গীশাহীর গভর্নরের সামরিক উপদেষ্টা মেজর জেনারেল ফরমান আন্সি। এবং ধারণা, নিয়াজির এই আরজিতে রয়েছে পাক প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার গোপন সমর্থন। (আঃ বাঃ পঃ)। [বিঃ দ্রঃ- আনন্দবাজার পত্রিকার অন্য এক সংবাদে বলা হয়, বুধবার কলকাতার একজন সামরিক মুখপাত্র জানান, ভারতীয় বাহিনী ও মুক্তিবাহিনী এখন ঢাকার চতুর্দিক থেকেই নাগপাশের মত এঁটে ধরেছেন। মিত্রবাহিনী চট্টগ্রাম থেকে মাত্র পাঁচ কিলোমিটার দূরে আছেন। খবর পাওয়া গিয়েছে, ঢাকার জেসব অসামরিক লোকজন বাড়িঘর ফেলে অন্যত্র চলে গিয়েছেন, শত্রুসৈন্যরা তাদের পরিত্যক্ত বাড়ি-ঘরে ঢুকে ঘাঁটি গেরেছে। দলে দলে ছত্রী সৈন্যরা উত্তর পশ্চিম দিক থেকে নরসিংদীর উত্তর-পূর্ব দিক থেকে ভারতীয় সৈন্য ও মুক্তিবাহিনীর আর একটি দলও দ্রুত গতিতে ঢাকার দিকে আগুয়ান, ময়নামতি ক্যান্টনমেন্ট অর্ধৈক ভারতীয় নিয়ন্ত্রণে। খুলনার শিরোমণি মুক্ত, গত পাচদিন ধরে পাক-সেনারা জোর লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। মাগুড়ায় প্রচণ্ড লড়াইয়ের মুখে পাক-সেনারা মধুমতি নদী পার হয়ে ফরিদপুর সরে মধুমতিতে সৈন্য চলাচলের জন্য ইঞ্জিনিয়ারিং কোর ব্রিজ তৈরি করেছে। আগামীকালই গোয়াল্লন্দ, ফরিদপুর মুক্ত হবে। সিলেটে বালুচ রেজিমেন্টের এক কোম্পানি পাক-সেনা বুধবার মিত্রবাহিনির নিকট আত্নসমর্পণ করে।”

-যমুনা নদীর এপারে সিরাজগঞ্জ ও ওপারে জগন্নাথ ঘাটের দিকেও ভারতীয় বাহিনীও মুক্তিবাহিনী সৈন্যরা অগ্রসরমান। উদ্দেশ্য পাক-সেনাদের পালাবার পথ রোধ করা। দিনাজপুর, রংপুর ও সৈয়দপুরে পাক-সেনারা প্রচণ্ড বাধা দেয়।

-দুদিন যুদ্ধের পর মিত্রবাহিনী ও মুক্তিবাহিনী ডিসেম্বর ১০ তারিখে পার্বত্য চট্টগ্রামের মহকুমা শহর রামগড় মুক্ত করে।

-পাকিস্তান প্রেসিডেন্ট জেনারেল আগা মোহাম্মদ ইয়াহিয়া খান জাতির উদ্দেশ্যে আগামী ১৭ ডিসেম্বর রাত্রি পৌনে আটটায় বেতার ভাষণ দেবেন, পাকিস্তান রেডিও এ খবর জানায়।

আনন্দবাজার পত্রিকা (বিশেষ সংখ্যা) বিকেলে প্রকাশিত হয়। সংবাদ শিরোনামে ছিলঃ “পাকিস্তান হার মানল, নিয়াজীর বিনাশর্তে আত্মসমর্পণ”

প্রতিবেদনে বলা হয়ঃ বাংলাদেশের দখলদার পাক ফৌজ বৃহস্পতিবার বিনাশর্তে আত্মসমর্পণ করেছে। ঐ ফৌজের সর্বাধিনায়ক লেঃ জেঃ নিয়াজীর আত্মসমর্পণের শর্তাদি নিয়ে আলোচনার জন্য ইষ্টার্ন কমাণ্ডের অধ্যক্ষ মোঃ জেঃ জেকবকে ঢাকায় যাওয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানান। জেঃ জেকব তদনুযায়ী বৃহস্পতিবার সকলেই হেলিকপ্টারে ঢাকা রওনা হয়ে যান। এই সম্পর্কে নয়াদিল্লী থেকে প্রকাশিত এক সরকারী ঘোষণায় বলা হয়েছেঃ জেনারেল মানেক’শ আত্মসমর্পণ যে আহবান জানিয়েছিলেন, আজ সকালে লেঃ জেঃ নিয়াজী তাতে সাড়া দেন। ঢাকা থেকে মাইক্রোওয়েভ মারফত তিনি আত্মসমর্পণে রাজি হওয়ার কথা জানান। জেনারেল মানেক’শ আত্মসমর্পণের সময়সীমা বেঁধে দিয়েছিলেন বৃহস্পতিবার সকাল ৯টা। কিন্তু তখন পর্যন্ত জেঃ নিয়াজীর কাছ থেকে কোন সাড়া শব্দ না পাওয়ায় ভারতীয় বিমানবহর ঢাকার সামরিক লক্ষ্যবস্তুগুলির উপর বোমাবর্ষণ এবং সৈন্যবাহিনী পুনরায় ঢাকার সামরিক ঘাঁটিগুলির উপর গোলাবর্ষণ শুরু করে। এর কিছু পরেই পাওয়া যায় আত্মসমর্পণের খবর। জেনারেল নিয়াজীর কাছে থেকে সর্বশেষ যে বার্তা পাওয়া গিয়েছে তাতে তিনি আরও ছয় ঘন্টা বোমাবর্ষণ বন্ধের আরজি জানিয়েছেন। সেই আরজিতে সায় দিয়ে বেলা তিনটা পর্যন্ত বোমাবর্ষণ মুলতবি রাখা হয়েছে।

-নয়াদিল্লী থেকে ইউ এন আই সংবাদ সংস্থা জানায়ঃ পাকিস্তানী দখলদার বাহিনী আজ বিনাশর্তে আত্মসমর্পনের নথিপত্রে স্বাক্ষর করেন, পাক-বাহিনী প্রধান লেঃজেনারেল নিয়াজী এবং ভারতীয় বাহিনী ইষ্টার্ণ কমাণ্ডের জিওসি-ইন-সি লেঃ জেঃ জগজিৎ সিং আরোরা। লেঃ জেঃ আরোরা এই উদ্দেশ্যে আজ দুপুরে বিমানযোগে বাংলাদেশের রাজধানীতে গিয়েছিলেন। বিকেল ৪টা ৩১ মিনিটে এই নথি স্বাক্ষরিত হয়। বাংলাদেশে মুক্তিবাহিনী পূর্ণ মুক্তি লাভ করলো। (যুগান্তর)

পাক বাহিনীর ঢাকায় বিনাশর্তে আত্মসমর্পণের কথা ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী লোকসভা ও রাজ্যসভায় বিকেল সাড়ে পাঁচটায় ঘোষণা দেন। এই ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গেই উভয় পক্ষ ‘জয় বাংলা’ শ্লোগানে ও উল্লাসে ফেটে পড়ে। ১৬ ডিসেম্বর অপরাহ্নে শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীর লোকসভা ও রাজ্যসভায় প্রদত্ত ঐতিহাসিক ঘোষআণাটি ছিল নিম্নরূপঃ

“I HAVE AN announcement to make. The West Pakistan forces have unconditionally surrendered in Bangladesh. The instrument of surrender was signed in Dhaka at 16.31 hours I.S.T. today by Lt.-Gen A.A.K Niazi on behalf of the Pakistan Eastern Command Lt. Gen. Jagjit Sing Aurora, GOC-in-C of the Indian and Bangladesh forces in the Eastern Theatre, accepted the surrender. Dhaka is now the free capital of a free country. This House and the entire nation rejoice in this historic event. We hail the people of Bangladesh in their hour of triumph. We hail the brave young men and boys of the Mukti Bahini for their valour and dedications. We are proud of our own Army, Navy, Air Forces and the Border Security Force, who have so magnificently demonstrated their quality and capacity. Their discipline and devotion to duty are well known. India will remember with gratitude the sacrifices of those who have laid down their lives and our thoughts are with their families. Our Armed Forces are under strict orders to treat Pakistani prisoners of war in accordance with the Geneva Convention, and to deal with all sections of the population of Bangladesh in a humane manner. The Commanders of the Mukti Bahini have issued similar orders to their Forces. Although the Government of Bangladesh have not yet been given an opportunity to sing the Geneva Convention, they also have declared that they will fully abide by it. It will be the responsibility of the Government of Bangladesh, the mukti Bahini and the Indian Armed Forces to prevent any reprisals.

Our objectives were limited- to assist the gallant people of Bangladesh and their Mukti Bahini to liberate their country from a reign of terror and to resist aggression on our own land. Indian Armed Forces will not remain on Bangladesh any longer than is necessary. The millions who were driven out of their homes across our borders have already begun trekking back. The rehabilitation of the war-torn land calls for dedicated team-work by its government and people.

We hope and trust the Father of this new Nation. Sheikh Mujibur Rahman, will take his rightful place among his own people and lead Bangladesh to peace, progress and prosperity.  The time has come when they can together look forward to a meaningful future in their Sonar Bangla. They have our good wishes. The triumph is not theirs alone. All nations who value the

Human spirit will recognise it as a significant milestone in man’s quest for liberty.” (The years of Endeavour, P-614) (BD-2,P-550-551)

শ্রীমতী গান্ধীর লোকসভা ও রাজ্যসভার প্রদত্ত বিবৃতির বাংলা রূপান্তরঃ

“আমরা একটি ঘোষণা আছে। পশ্চিম পাকিস্তানী সেনারা বাংলাদেশ শর্তহীনভাবে আত্মসমর্পণ করেছে। আজ ভারতীয় সময় ৪টা ১ মিঃ ঢাকায় লেঃ জেনারেল এ.কে. নিয়াজী পাকিস্তানের পূর্বঞ্চলীয় কমাণ্ডের পক্ষ থেকে আত্মসমর্পণপত্রে স্বাক্ষর করেছেন। ভারতীয় বাহিনী ও বাংলাদেশ বাহিনীর জিওসি ইন-সি লেঃ জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরা আত্মসমর্পণপত্র গ্রহণ করেছেন। ঢাকা এখন একটি স্বাধীন দেশের মুক্ত রাজধানী।

এই সংসদ ও সমগ্র জাতি এই ঐতিহাসিক ঘটনায় আনন্দিত। আমরা বাংলাদেশের জনগণকে তাঁদের এই বিজয়ালগ্নে শুভেচ্ছ জানাচ্ছি। বীরত্ব ও আত্মত্যাগের জন্যে আমরা মুক্তিবাহিনীর সাহসী তরুণদেরকে শুভেচ্ছা জানাচ্ছি। আমাদের স্থল, নৌ ও বিমান বাহিনী এবং সীমান্ত নিরাপত্তা। বাহিনী দক্ষতা ও বিচক্ষণতার সঙ্গে তাদের যোগ্যতা প্রতিপন্ন করেছে। আমরা তাদের জন্য গর্বিত। তাদের নিয়মানুবর্তিতা ও একাগ্রতার কথা সুবিদিত। যার জীবন দিয়েছে ভারত তাদের ত্যাগের কথা কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করবে। পাকিস্তানী যুদ্ধবন্দীদের সাথে জেনেভা চুক্তি অনুসারে ব্যবহার এবং বাংলাদেশের জনগণের সাথে মানবিক আচরণ করার জন্য আমাদেরকে সশস্ত্র বাহিনীকে কঠোর নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। জেনেভা চুক্তিতে স্বাক্ষর করার সুযোগ যদিও হয়নি তবুও বাংলাদেশ সরকার যুদ্ধবন্দীদের সাথে অনুরূপ আচরণ করবে বলে ঘোষণা করেছে। কোন প্রতিশোধমূলক ঘটনা যাতে না ঘটে তা দেখার দায়িত্ব বাংলাদেশ সরকার, মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনীর।

আমাদের উদ্দেশ্য সীমিত। আমাদের লক্ষ্য ছিল ত্রাসের রাজত্ব থেকে দেশকে মুক্ত করার ব্যাপারে বাংলাদেশকের বীর জনতা ও মুক্তিবাহিনীকে সাহায্য করা এবং আমাদের মাতৃভূমির উপর আক্রমণ প্রতিহত করা। প্রয়োজনের বেশি একদিনও ভারতীয় সৈন্য বাংলাদেশে থাকবে না। যে লক্ষ লক্ষ লোক তাদের ঘরবাড়ী থেকে বিতাড়িত হয়ে আমাদের সীমান্ত অতিক্রম করেছিল তারা ইতিমধ্যেই ফিরে যেতে শুরু করেছে। যুদ্ধবিধ্বস্ত সেই দেশের পুনর্বাসনের জন্যে সরকার ও জঙগণকে ত্যাগের মনোভাব নিয়ে কাজ করে প্রয়োজন। আমরা আশা করি ও বিশ্বাস করে যে, এই নতুন দেশের জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর জনগণের মধ্যে যথাযোগ্য স্থান গ্রহণ করে বাংলাদেশকে শান্তি ও সমৃদ্ধির পথে নিয়ে যাবেন। সোনার বাংলায় একটি সার্থকতাপূর্ণ ভবিষৎ সৃষ্টির উদ্দেশ্যে আত্মনিয়োগ করার জণ্যে বাংলাদেশের জনগণের সময় এসেছে, তাদের জন্য আমাদের শুভেচ্ছা রইল। তাদের এই বিজয় শুধু তাদের একার নয়। যেসব জাতি মানবিক চেতনার মূল্য দিয়ে থাকে সেসব দেশ এ বিজয়কে মুক্তির সন্ধানে মানুষের বিরাট সাফাল্য হিসেবে স্বীকৃতি দেবে।

The Text of the “Instrument of Surrender” signed by General Aurora and General Niazi was as follows. “The Pakistan Eastern Command agree to Surrender all Pakistan Armed Forces in Bangladesh to Lieut.-General Jagjit singh Aurora G.O –in-C of the Indian and Bangladesh forces in the Eastern Theatre. This surrender includes all Pakistan land, air and naval forces as all paramilitary forces and civil armed forces. “These forces will lay down their arms and surrender at the places where they are currently located to the nearest regular troops under the command of Lieut-General Jagjit Singh Aurora. “The Pakistan Eastern command shall come under the orders of Lieut-General Jagjit Singh Aurora as soon as this instrument has been signed. Disobedience fo orders will regarded as a breach of the surrender terms and will be dealt with in accordance with the accepted laws and usages of war.

“The decision of Lieut.-Geneal Jagjit Singh aurora shall be final should any doubt arise as to the meaning or interpretation of the surrender terms.

“Lieut-General. Jagjit Singh Aurora gives a solemn assurance that personnel who surrender shall be treated with the dignity and respect that soldiers are entitled to in accordance with the provisions of the Geneva Convention, and guarantees the safety and well-being of all Pakistan military and para military forces who surrender. “Protection will be provided to foreign nationals, ethnic minorite4s and personnel of the West Pakistan origin by the forces under the command of Lieut,-General Jagjit Singh Aurora.”

পাকিস্তানী বাহিনীর লেঃ জেঃ নিয়াজী ভারতীয় বাহিনীর লেঃ জেঃ আরোরার কাছে প্রদত্ত যে আত্মসমর্পণ স্বাক্ষর করে তাতে আছেঃ

 ।।আত্মসমপর্ণের শর্ত।।

এতদ্বারা পূর্বাঞ্চলের ভারতীয় ও বাংলাদেশের বাহিনীর জিওসি-ইন-সি লেঃ জেনারেল আরোরার কাছে পাক-বাহিনীর ইষ্টার্ন কমাণ্ড বাংলাদেশস্থিত সমস্ত পাকিস্তানী সশস্ত্র সৈন্যের আত্মসমর্পণের কথা স্বীকার করছে। আত্মসমর্পণ যারা করেছে তাদের মধ্যে আছে পাকিস্তানী স্থল, বিমান ও ণৌ-বাহিনীসহ প্যারা মিলিটারী বাহিনী ও অসামরিক সশস্ত্র বাহিনীর সমস্ত সৈনিক।

এই সশস্ত্র বাহিনীর সৈনিকরা যে যেখানে আছে সেখানকার লেঃ জেনারেল আরোরার অধীনস্থ সৈন্য বাহিনীর কাছে অস্ত্র ও আত্মসমর্পণ করবে। এই নথি স্বাক্ষরের সঙ্গে সঙ্গেই পাকিস্তানী ইষ্টার্ন কমাণ্ড লেঃ জেনারেল আরোরার অধীন হয়ে যাবে। এই আদেশ যে অবজ্ঞা করবে তাকে আত্মসমর্পণ শর্তের পরিপন্থী বলে মনে করা হবে এবং যুদ্ধের প্রচলিত নিয়মানুযায়ী তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। আত্মসমর্পণের শর্তাবলী সম্পর্কে কোন সন্দেহ দেখা দিলে লেঃ জেঃ আরোরা সে বিষয়ে যে ব্যাখ্যা

করবেন তাকেই চূড়ান্ত বলে বিবেচনা করা হবে। লেঃ জেনারেল আরোরা এই প্রতিশ্রুতি দেন যে, যেসব সৈন্য আত্নসমর্পণ করেবে তাদের প্রত্যেকের সঙ্গে জেনেভা চুক্তির শর্তানুযায়ী সম্মান ও মর্যাদাযুক্ত ব্যবহার করা হবে এবং তাদের নিরাপত্তার জন্য সমস্ত ব্যবস্থা অবলম্বন করা হবে। লেঃ জেনারেল আরোরার অধীন সেনাবাহিনীর সাহায্যে বিদেশী নাগরিক, সংখ্যালঘু সম্প্রদায় এবং পশ্চিম পাকিস্তানের বেসামরিক নাগরিকদের নিরাপত্তা প্রদান করা হবে।’ উল্লেখ্য, আত্নসমর্পণের ব্যাপারে সমস্ত ব্যবস্থা করেন ইষ্টার্ণ কমাণ্ডের চীফ অব স্টাফ মেজর জেনারেল জে. এফ. আর. জেকব। লেফ-টেন্যান্ট জেনারেল আমীর আব্দুল্লাহ খান নিয়াজীর আত্নসমর্পণের ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে মেজর সিদ্দিক সালিক লিখেছেনঃ “বিকেলের শুরু হতেই জেনারেল নিয়াজী গাড়ী করে ঢাকা বিমানবন্দরে গেলেন ভারতীয় পূর্বাঞ্চলীয় কমাণ্ডের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট জেনারেল জগজিৎ সিং আড়োরাকে অভ্যর্থনা জানাবার জন্যে। তিনি পত্নীকে সঙ্গে নিয়ে হেলিকপ্টারে করে এলেন। এক বিরাট সংখ্যক বাঙ্গালী জনতা ছুটে গেল তাদের মুক্তিদাতা ও তার পত্নীকে মাল্যভূষিত করতে। নিয়াজী তাকে সাম-রিক কায়দায় স্যালুট দিলেন এবং করমর্দন করলেন। একটি হৃদয়স্পর্শী দৃশ্য। বিজয়ী এবং বিজিত দাড়িয়ে আছে প্রকাশ্য বাঙ্গালীদের সামনে আর বাঙ্গালিরা আরোরার জন্যে তাদের গভীর ভালবাসা এবং নিয়াজীর জন্যে তীব্র ঘৃণা প্রকাশ্যে কোনরূপ গোপনীয়তার আশ্রয় নিচ্ছে না। উচ্চকণ্ঠে চিৎকার ও শ্লোগানের মধ্যে দিয়ে তাদের গাড়ী রমনা রেস্কোর্স-এ এলো। আত্নসমর্পণ অনুষ্ঠানের জন্যে মঞ্চ তৈরি করা হয়। বিশাল ময়দানটি বাঙ্গালী জনতার উদ্বেল আবেগে ভাসছিল। তারা প্রকাশ্যে একজন পশ্চিম পাকিস্তানী জেনারেলের দর্পচূর্ণের দৃশ্য দেখবার জন্যে উদ্গ্রীব হয়ে উঠেছিল। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একটি সুসজ্জিত দল্কে হাজির করা হলো বিজয়ীকে গার্ড অব অনার দেয়ার জন্যে অন্যদিকে একটি ভারতীয় সেনাদল বিজিতের প্রহরায় নিযুক্ত হন। প্রায় দশ লক্ষ বাঙ্গালী এবং কয়েক কুড়ি বিদেশী সংবাদপত্র ও সংবাদ মাদ্ধমের প্রতিনিধিদের সামনে লেফটেন্যান্ট জেনারেল আরোরা ও লেফটেন্যান্ট জেনারেল নিয়াজী আত্নসমর্পণের দলিলী স্বাক্ষর করলেন। ঢাকা দখলের নির্দশনসরুপ জেনারেল নিয়াজি তার রিভল্ভার বের করে আরোরার হাতে তুলে দিলেন রিভলভারের সাথে তিনি পূর্ব পাকিস্তানকেও তুলে দিলেন’। (নিয়াজির আত্নসমর্পনের দলল, পৃঃ ২০৯)

প্রত্যক্ষদসীর বিবরণ থকে জানা যায় যে, ে দিন বিকাল চারটা চল্লিশ মিনিটে পঁচিশ –ছাব্বিশটি ভারতীয় চৈতক হেলিকপ্টার ঢাকার তেজগাঁ বিমান বন্দরে অবতরণ করেছিল। পাকসামরিক বাহিনীর পূর্বাঞ্চল প্রধান লেঃ জেনারেল ে. ে. কে. নিয়াজী বাংলাদেশ ভারত যৌথবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় বিজয়ী সেনাপতি লেঃ জেনারেল জগজিৎ সিং আরোরাকে প্রথমে স্বাগত জানালেন। এরপর বিজয়ী বাহিনীর মেজর জেনারেল স্বগত সিং, মেজর জেনারেল নাগরা, বিগ্রেডিয়ার সান সিং, (মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে বাবাজী নামেই পরিচিত) পঁচিশ হাজার মুক্তিযোদ্ধারা তিনি প্রশিক্ষক।মেঘালয়সহ পূর্বাঞ্চলের অধিকাংশ মুক্তিযোদ্ধা প্রশিক্ষণ শিবির সরাসরি তার নিয়ন্ত্রণে ছিল। বিগ্রেডিয়ার হরদেব সিং ক্লে। মেজর জেনারেল স্বগত সিং, মেজর হায়দার, ফ্লাইট লেঃ ইউসুফ এবং বীর মুক্তিযোদ্ধা কাদের সিদ্দিকী জেনারেল আরোরাকে স্বাগত জানালেন। লেঃ জেনারেল নিয়াজীর সাথে উপস্থিত ছিলেন মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী, মেজর জেনারেল জামশেদ [যিনি সকাল ন’টায় আত্নসমর্পণের সংবাদ জেনারেল নাগরাক জানান] তার পিস্তল,কোমর বেল্ট ও হেড ক্যাপ খুলে দিয়ে প্রমাণ করেছিলেন আত্নসমর্পণের সত্যতা। আমিনবাজারের মসজিদের সামনে ে প্রাথমিক আত্নসমর্পণ করে। হেলিকপ্টারে জেনারেল আরোরার সাথে এসেছিলেন বাংলাদেশ সরকারের প্রতিনিধি ও বাংলাদেশ বাহিনীর উপপ্রধান এয়ার কমোডর ে কে খোন্দকার, জেনারেল আরোরার সহধর্মিনী শ্রীমতী আরোরা আর এসেছিলেন কলকাতা থেকে ষাট সত্তুর জন বিদেশী সাংবাদিক। বিমান বন্দর নয়, ও যেন এক জনসমুদ্র। সবাই আনন্দে উচ্ছ্বাসে বিহবল, উল্লাসে আত্নহারা। নিয়াজীর গাড়ীতেই আরোরা উঠলেন।গাড়ীর পিছনের সিটে নিয়াজী ও আরোরা, সাম্নের সিটে আরোরার সহধর্মিনী।

(লেখক)

বিকেল্ব পাঁচটা পাঁচ মিনিটে রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) বিজিত পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর পুর্বাঞ্চলীয় প্রধান লেঃ জেনারেল এ.কে. নিয়াজী ও ভারত বাংলাদেশ যৌথবাহিনীর প্রধান বিজয়ী জেনারেল জগজিৎ সিং আরোরা আত্নসমর্পনপত্রে স্বাক্ষর করেছিলেন। আত্নসমর্পণ অনুস্থানে বাংলাদেশ সরকারের প্রতিনিধি ছিলেন কমাণ্ডার এ.কে. খোন্দকার। অনুস্থানে আরো উপস্থিত ছিলেন ২নং সেক্টরের গেরিলা বাহিনীর অনন্য প্রশিক্ষক মুক্তিযোদ্ধা মেজর হায়দার, ফ্লাইট লেঃ ইউসুফ ও অকুতোভয় বীর মুক্তিযোদ্ধা ও সংগঠক কাদের সিদ্দিকী (বাঘা সিদ্দিকী)। নিয়াজীর আত্নসমর্পণপত্রে স্বাক্ষর দান শেষ হতেই একশজন পাকবাহিনীর অফিসার ও একজন জওয়ান আত্নসমর্পণের প্রতীক হিসেবে তাদের অস্ত্র মাটিতে নামিয়ে রেখেছিলেন। পাক বাহিনীর পরাজয়ের কারণগুলো নির্ণয় করতে গিয়ে জেনারেল জগগিত স্নগ আরোরা কলকাতায় এক সাংবাদিক সম্মেলনে (ডিসেম্বর ১৭) বলেন, পাক বাকহিনির ,মেঘনা  ও মধুমতির দুপারে সৈন্য সমাবেশ করতে পারলে মিত্রবাহিনীকে কয়েকমাসের জন্য জন্য প্রতিরোধে করতে পারতো। এ প্রসঙ্গে কিসিং কন্টেম্পরারী আর্কাইভাস লিখেছেঃ  “Analysing the reasons for the Indian victory at a press conference in Calcutta on Dec. 17, General Aurora attributed it to the deployment of the Pakistani troops, commenting that.  “If they had concentrated their forces between, the two big rivers, the Meghna and the Madhumati, I think they could have kept on for several months”. (KCA, P.25065)

-সাংবাদিক মোহাম্মদ বিজয় দিবস সম্বন্ধে সেদিনের ঘটনায় বর্ণনা দিতে গিয়ে লিখেছেনঃ অবশেষে এলো ১৬ ডিসেম্বর। রক্তে রঙীন সূর্য যেন সঙ্গে নিয়ে এলো মহাবিজয়ের মহ্য ইঙ্গিত। মিত্র বাহিনী ও মুক্তিবাহিনী ভোর হতে না হলে প্রস্তুত। আর দেরী যেন তাদের সহ্য হয় না। দেখতে দেখতে সকাল ৭টা বেজে গেল। দেখা গেল পশ্চিম-উত্তর কোণ থেকে একখানি বিরাটকায় হেলিকপ্টার এসে সৈন্যদের ছাউনির কাছে নেমে পড়লো। হেলিকপ্টার থেকে বেরিয়ে এলেন মিত্র বাহিনীর ব্রিগেডিয়ার ক্লিয়ার, ব্রিগেডিয়ার সন্ত সিং এবং মুক্তি বাহিনীর অধিনায়ক বাঘা সিদ্দিকী। সাভার মোটর ষ্ট্যাণ্ডের এক মাইল দক্ষিণে যেখানে রাস্তাটা বিরাট রকম বাঁক নিয়েছে মিত্র ও মুক্তিবাহিনী কমাণ্ডাররা সেখানে নেমে এগিয়ে চললেন। পায়ে হেঁটে তারা চলছেন রাস্তার দুই পাশ ধরে সামনে কোন সাড়া শব্দ নেই। মিরপুরের কাছাকাছাই এসে গেছে মিত্র বাহিনী, তখন দেখা গেল ৫/৬ জন সৈন্য প্রাণপণ দৌড় দিয়ে মিত্র বাহিনীর দিকে আসছে। কারা ওরা? শত্রু না মিত্র? অধিনায়করা উৎসুক হয়ে ওদের দিকে তাকিয়ে আছে। এমন সময় দেখা গেল মুক্তিবাহিনী মিরপুর পুলের উত্তর দিকের গ্রামগুলিতে অবস্থান নিয়েছে যাতে ভুল করে তাদে উপর হামলা না করা হয়, সে জন্য ওরা এত ব্যস্ত হয়ে সংবাদ দিতে এসেছে। শত্রু সেনারা মিরপুর পুলর পূর্ব দিকে অবস্থান নিয়েছে। দুঃসাহসী সবুর এত আগে মিরপুর এলাকায় এসে গেল জেনে অধিনায়করা অবাক হয়ে গেলেন।

বেলা প্রায় ৯টার সময় মিত্র ও মুক্তিবাহিনীর কমাণ্ডাররা মিরপুর সেতুর ধারে উপস্থিত হলেন। সৈন্যদের মধ্যে দারুণ উত্তেজনা। পাক বাহিনী আত্মসমর্পণ করবে না প্রতিরোধ যুদ্ধ চালাবে এই নিয়ে জল্পনা কল্পনা চলছে। যদি প্রতিরোধ সংগ্রাম চালায় তা’হলে বেসামরিক জনসাধারণের জীবন ও বিপন্ন হবে। সুতুরাং সে সংগ্রাম পরিচালনা পদ্ধতি নিয়ে সময় নায়করা ম্যাপ খুলে পরিকল্পনা করতে লাগলেন। তারপর পায়ে হেঁটে তাঁরা এগিয়ে চললেন। সঙ্গে মাত্র এক ব্যাটালিয়ন সৈন্য। বাকী সৈন্যরা অনেক পিছনে পড়ে গেছে। বেতারে জেনারেল মানেক’শ ঘন ঘন ঘোষণা করেছে ‘হাতিয়ার ডাল দো’। কিন্তু জেনারেল নিয়াজীর কাছ থেকে আত্মসমর্পণের কোণ সাড়া নেই। মানেক শ’র দেওয়া সময়সীমা পার হয়ে যাচ্ছে। কাজেই দুশমনরা তমসমর্পণ না করলে শেষ আঘাত হানতে হবে। কাজেই মিত্র বাহিনীর জেনারেল নাগরা মিরপুর পুলের উপর থেকেই নিয়জীকে নিম্নলিখিত পত্রখানি লিখলেনঃ প্রিয় আবদুল্লাহ, আমি এখানে। কোন চিন্তা করিও না, আমি তোমার ভার নেব। বৃথা রক্তপাত এড়িয়ে আত্মসমর্পণ কর। আমার পত্রবাহক মারফত জবাব দিবে আশা করি। ইতি তোমার নাগরা। সকাল ৯-১৫ মিনিটে জেনারে নাগরার চিঠি নিয়ে মিত্র বাহিনীর একজন মেজর, একজন ক্যাপ্টেন এবং কয়েকজন জন জোয়ান একটি জীপে সাদা পতাকা উড়িয়ে মি- রপুর পুল পার হয় পাক-বাহিনী ২৬ তম ব্রিগেডিয়ার কমাণ্ডার মেজর জেনারেল জামশেদের সঙ্গে দেখা করলেন। মিরপুর পুরেল উপর অপেক্ষারত নাগরা, সন্তু সিংহ, কল ও বাঘা সিদ্দিকী প্রহর গুনছেন। পাক-বাহিনী ভারতীয় অফিসারদের সঙ্গে বিশবাসঘতকতা করবে না তার কারণ ওদের সে ঐতিহ্য  আছে। ৯ই ডিসেম্বর তারিখে জামালপুরে ব্রিগেডিয়র কল দূত পাঠিয়েছিলেন জামালপুরের পাক বাহিনীকে আত্মসমর্পণের নির্দেশ দিয়ে। জবাবে কর্নেল সুলতান চিঠির মধ্যে একটি বুলেট ভর্তি করে জবাব দিয়েছিল। জেনারেল জামশেদ নিয়াজীর আত্মসমর্পণের সম্মতিপত্র দিয়ে মিরপুর পুলের দিকে রওনা হলেন। মিত্রবাহিনীর পত্রবাহক অফিসাররা আনন্দে আত্মহারা হয়ে ঝড়ের বেগে ফিরে আসতে লাগলেন, কিন্তু পথে কখন যে হাফ সাদা পতাকাটি বাতাসে উড়ে গিয়েছে, তা টের পাননি।

ঝড়ের গতিসম্পন্ন গাড়ীটিকে দুশমনের গাড়ী মনে করে মুক্তিবাহিনীর জওয়ানরা এমব্যুশ থেকে গুলী চালায়। জীপের গতি থেমে গেল। কিন্তু সে কয়েক মুহূর্তঃ তারপর জীপটি এগিয়ে চলল। জীপের মধ্যে মিত্রবাহিনীর ক্যাপ্টেনের মৃতদেহ। গাড়ীর চালক মেজর বুঝতে পারলেন সাদা পতাকাটি পড়ে যাওয়ার ভুল বুঝাবুঝির জন্য এই বিষাদময় ঘটনাটি সংঘটিত হলো। এত আনন্দের মধ্যেও সমগ্র মিত্র ও মুক্তিবাহিনীর মধ্যে শোকের ছায়া নেমে এল। কিছুক্ষণের মধ্যেই মেজর জেনারেল জামশেদ  জেনারেল নিয়াজীর আত্মসমর্পণের পত্র নিয়ে মিত্র বাহিনীর অধিনায়কদের সামনে হাজির হলেন। জেনারেল নাগরা চিঠি পেয়ে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে রওয়ানা  হওয়ার জন্য সকলকে নির্দেশ দিলেন। জেনারেল জামশেদের গাড়ীয়ে উঠলেন জেনারেল নাগরা, ব্রিগেডিয়ার সন্ত সিংহ ক্লিয়ার ও কাদের সিদ্দিকী। মিরপুর সড়ক থেকে ক্যান্টনমেন্ট পর্যন্ত রাস্তায় দুশমনের সৈন্য পাহারায় মোতায়েন। তার মধ্যদিয়ে মিত্র ও মুক্তিবাহিনীর চারজন সমরনায়ক চলেছেন  শত্রু শিবিরে। সঙ্গে আর কোন সৈন্য নেই। বিপদের পড়লে অচিরে সাহায্য পাওয়ার আশা নেই। তবুও তাঁরা চলেছেন অকুতোভয়। প্রায় ১০.৩০ মিনিটের সময় তাঁরা নিয়াজীয় অফিস কক্ষে প্রবেশ করলে মিনিট দশেক পরে নিয়াজী এলেন। সামরিক কায়দায় মিত্র ও মুক্তিবাহিনীর অধিনায়কদের অভিবাদন করে আসন গ্রহণ করলেন। এরপর শুরু হলো আত্মসমর্পণের প্রাথমিক অনুষ্ঠান। এই অনুষ্ঠানে স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশের ভিত্তি হলো সুপ্রতিষ্ঠিত। আর এই অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনী প্রতিনিধিত্ব করলেন বঙ্গবন্ধু প্রিয় শিষ্য তরূণ সমরনায়ক কাদের সিদ্দিকী (পূর্বদেশঃ ১৬.১২.৭২)

-স্বাধীন গ্ণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায় প্রশাসনিক কাঠামো গড়ে তোলার উদ্দেশ্যে বাংলাদেশ সরকারের সেক্রেটারী জেনারেল জনাব রুহুল কুদ্দুসের নেতৃত্ব বাংলাদেশে সরকারের সচিবদের একটি দল মুজিবনগর থেকে ঢাকা এসে পৌঁছান ১৮ ডিসেম্বর। ঐদিনেই আওয়ামী লীগের কয়েকজন নেতৃস্থানীয় ব্যাক্তিও ঢাকা পৌঁছান। ১৯ ডিসেম্বর থেকে স্বল্পসংখ্যক অফিসার ও কর্মচারীদের উপস্থিতিতে কেন্দ্রীয় সেক্রেটারীয়েট প্রতিষ্ঠার কাজ শুরু হয়। ১৮ ডিসেম্বর রায়েরবাজারে কাটাসুর নামক এক ইটখোলার খাদে হাতবাঁধা অবস্তায় দেশের বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবীসহ প্রায় দুইশত ব্যক্তির মৃত দেহ আবিষ্কৃত হওয়ার দেশে মানুষের ক্রোধ, ঘৃণা ও প্রতিহিংসার আবেগ চরমে পৌঁছায়। মুজিবনগর থেকে বিপ্লবী বাংলাদেশ সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী এবং মন্ত্রীসভার সদস্যবৃন্ধ ঢাকা প্রত্যাবর্তন করেন ২২ ডিসেম্বর। মন্ত্রীসভা দ্রুতগতিতে যেসব সুপরিকল্পিত পদক্ষেপ গ্রহণ করেন, তার ফলে মাত্র দুসপ্তাহের মধ্যে একটি কেন্দ্রীয় সরকারের প্রয়োয়জন উপযোগী কেন্দ্রীয় প্রশাসন-ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার কাজ দ্রুত অগ্রসর হয়। (মূলধারা’ ৭১ পৃঃ ২৪৬)

১৬ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় পাক প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান চূড়ান্ত বিজয় অবধি যুদ্ধ চালিয়ে যাবার সংকল্প প্রকাশ করা সত্ত্বেও পাকিস্তানের সর্বত্র গণবিক্ষোভের সূত্রপাত হয়। সশস্ত্র বাহিনী ক্ষোভকে মূলধন করে ইয়াহিয়া খানকে ক্ষমতাচ্যুত করে। পিপিপি নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টোকে নিউয়ার্ক থেকে এনে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট পদে সমাসীন করা হয় ডিসেম্বরের ২০ তারিখে। উল্লেখ্য, মিঃ ভুট্টো তখন ওয়াশিংটন মার্কিন প্রেসিডেন্ট নিক্সনের সাথে সাক্ষাৎ করছিলেন। ১৬ ডিসেম্বর লন্ডনের সান্ধ্য-দৈনিক “দি ইভনিং ষ্ট্যাণ্ডার্ড” এ প্রকাশিত এক সংবাদে বলা হয়, পাকিস্তান সৈন্যবাহিনী আজ পূর্ব বঙ্গে আত্মসমর্পণ করেছে। জেনারেল নিয়াজীর পক্ষে প্রাণহানির সম্ভাবনা দূরে হয়েছে। পত্রিকাটির সম্পাদকয় মন্তব্য বলা হয়, স্বাধীন রাষ্ট্র হিসাবে বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠা এবং একশ’ লক্ষ বাস্তুত্যাগির স্বদেশ প্রত্যাবর্তন নিশ্চিত করার জন্য ভারতের যুদ্ধ প্রচেষ্টা অনেকেই সমর্থন করবে। সবকিছু বিবেচনা করে বলা চলে, দুনিয়ার ইতিহাসে অযোগ্য নেতাদের মধ্যে অন্যতম বিবেচিত ইয়াহিয়া খান মিসেস গান্ধীকে অস্ত্র ব্যবহার করতে বাধ্য করে। (“দি ইভনিং ষ্টাণ্ডার্ড, ১৬ই ডিসেম্বর, ১৯৭১)। ঢাকা থেকে মিস ক্লেয়ার হোলিংওয়ার্থ কর্তৃক প্রেরিত এক সংবাদে বলা হয়, আত্মসমর্পণের জন্য নির্দিষ্ট সময়ের মেয়াদ শেষ হওয়া মাত্র ১০ মিনিট আগে পূর্ব বঙ্গে নিয়োজিত পাকিস্তান সেনাবাহিনী ভারতীয় নির্দেশ মেনে নেয়। বৃহস্পতিবার সকাল ৯টা ২০মিনিটের সময় জাতিসংঘের উচ্চপদস্থ অফিসার জন কেলি পাকিস্তান সৈন্যবাহিনীর পক্ষ থেকে মেজর জেনারেল ফরমান আলী কর্তৃক আত্মসমর্পণের সংবাদ জাতি সংঘের নিজস্ব বেতার যোগাযোগ ব্যবস্থার মাধ্যমে ভারতীয় কর্তৃপক্ষকে জানিয়ে দেয়। (“দি ডেইলি টেলিগ্রাম”, ১৭ই ডিসেম্বর,১৯৭১)।

ঢাকা থেকে এ্যাসোসিয়েটেড প্রেস কর্তৃক প্রেরিত এক সংবাদে বলা হয়, ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে আয়োজিত এক সামরিক অনুষ্ঠানে পূর্ব বঙ্গের নিয়োজিত পাকিস্তানী বাহিনীর অধিনায়ক জেনারেল নিয়াজী পূর্বাঞ্চলে নিয়োজিত ভারতীয় ও বাংলাদেশের বাহিনীর সর্বাধিনায়ক লেঃ জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরার নিকট ৪টা ৩১ মিনিটের সময় আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মসমর্পনের কথা এড়িয়ে যাওয়া হয়। সে শুধু পাকিস্তানী বাহিনীর পরাজয় হয়েছে বলে উল্লেখ করে। এই পদ্ধতি তাদের “অনিষ্টকারী ও নির্মম” প্রতিবেশী কর্তৃক চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। পূর্ব বঙ্গে আত্মসমর্পণকারী সৈন্যদের সে “ইসলামের সৈনিক” বলে অভিহিত করে। পূর্ব বঙ্গে পরাজিত হওয়ার ফলে যুদ্ধ শেষ হয়নি। এই যুদ্ধে শেষ পর্যন্ত তাঁরা জয়ী হবে। শত্রুকে তাড়িয়ে না দেওয়া পর্যন্ত পাকিস্তান ক্ষান্ত হবে না। পাকিস্তানকে সর্বপ্রকার সাহায্যদানের জন্য চীন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সে কৃতজ্ঞতা জানায়। (“দি টাইমস”, ১৭ ডিসেম্বর,১৯৭১) পাকিস্তান সৈন্য বাহিনীর আত্মসমর্পণ সম্পর্ক ১৬ই ডিসেম্বর ভারতীয় পার্লামেন্টে প্রদত্ত ভাষণে মিসেস গান্ধী বলেন, পাকিস্তান বাহিনী বিনা শর্তে আত্মসমর্পণ করেছে। ঢাকা এখন একটি স্বাধীন দেশের রাজধানী। নতুন জাতির জনক শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর দেশের জনগণের মধ্যে ন্যায্য আসন গ্রহণ করে বাংলাদেশকে উত্তরোত্তর সমৃদ্ধির পথে নিয়ে যাবেন বলে মিসেস গান্ধী আশা প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, সোনার বাংলার স্বপ্ন সফল করার জন্য সুযোগ উপস্থিত হয়েছে। এ ব্যাপারে ভারতের শুভেচ্ছা থাকলে বলে তিনি আশ্বাস দেন। এই বিজয় শুধুমাত্র বাংলাদেশের বিজয় নয়। মানবিক দৃষ্টিভঙ্গির প্রতি যেসব জাতি শ্রদ্ধাশীল তারা এই বিজয়কে মানব স্বাধীনতার ইতিহাসে একটি উল্লেখ্যযোগ্য পথনির্দেশ বলে গণ্য করবে। (“দি টাইমস”, ১৭ ডিসেম্বর ১৯৭১)। দি নিউইয়র্ক টাইমস-এ সম্পাদকীয় নিবন্ধে বলা হয়, পূর্ব বঙ্গে পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর বিপর্যয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষেও কূটনৈতিক বিপর্যয় বলে গণ্য হওয়া উচিত। শেষ মুহূর্তে ভারতীয় সৈন্যবাহিনীকে নিরস্ত করার উদ্দেশ্যে “হোয়াইট হাউস” (অর্থ্যাত মার্কিন প্রেসিডেন্ট) কর্তৃক মস্কোর প্রতি সাবধানবাণী উচ্চারণ এবং বঙ্গোপসাগরের দিকে মার্কিন নৌ-বহর পাঠিয়ে গণতান্ত্রিক বিশ্বের চোখে আমেরিকার মর্যাদা রক্ষার ব্যর্থ চেষ্টা করা হয়। এই নিবন্ধে আরো বলা হয়, উপমহাদেশে সোভিয়েত ইউনিয়নের মর্যাদা বৃদ্ধির জন্য আমেরিকা বহুলাংশে দায়ী করা চলে। পূর্ব বঙ্গে সংগঠিত পাশবিক অত্যাচার নির্যাতন সম্পর্কে মৌনভাব অবলম্বন করে এবং পাকিস্তানকে ২৫শে মার্চের পরেও সামরিক ও অর্থনৈতিক সাহায্যদান অব্যহাত রেখে নিক্সন প্রশাসন ভারতকে রাশিয়ার দিকে ঠেলে দেয়।

পূর্ব বঙ্গে সমস্যার বাস্তব পরিস্থিতি ভিত্তিক রাজনৈতিক সমাধানের মাধ্যমে ভারতের উপর সোভিয়েত প্রভাব হ্রাস করা সম্ভব ছিল। মার্কিন এ সম্বন্ধে কোন উদ্যোগ গ্রহণ না করে সোভিয়েত প্রভাব বৃদ্ধির ক্ষেত্রে সৃষ্টি করে। ইসলামাবাদে সামরিক চক্রটির থাকার সম্ভবনা নেই। তা সত্ত্বেও পাকিস্তানের সামরিক এক নায়কতন্ত্র একগুয়ের মত সমর্থনদান করে প্রেসিডেন্ট নিক্সন সোভিয়েত প্রভাব বৃদ্ধির সহায়ক হন। (“দি নিউ ইয়ার্কটাইমস”, ১৭ ই ডিসেম্বর, ১৯৭১) দি টাইমস- এর সম্পাদকীয় নিবন্ধে বলা হয়, পাকিস্তান কর্তৃক আত্মসমর্পণের মাধ্যমে পূর্ব বঙ্গে যুদ্ধ অবসান হওয়ায় সবাই কৃতজ্ঞ বোধ করবে। পাকিস্তান সৈন্যবাহিনীর আত্মসমর্পণের পর পূর্ব বঙ্গে পাকিস্তান সরকারের কর্তৃত্ব অপাসারিত হয়। পূর্ব বঙ্গের প্রতিনিধিরা না চাইলেও পূর্ব অবস্থা ফিরে আসবে না। গত আট মাসের ঘটনাবলীর পর তা আর সম্ভব নয়। বাংলাদেশ সরকারের শীঘ্রই পূর্ণ কর্তৃত্ব স্থাপনের সুযোগ দেওয়া হবে বলে আশা প্রকাশ করে সম্পাদকীয় নিবন্ধে বলা হয়, মিসেস গান্ধী এ সম্পর্কে পরিষ্কার ভাষায় তাঁর উদ্দেশ্য ব্যাখ্যা করেছেন। তিনি বলেছেন, ভারত কখনও বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করবে না। বাংলাদেশের সঙ্গে তাঁর দেশ শান্তি ও বন্ধুত্বপূর্ণ প্রতিবেশির সম্পর্ক বজায় রাখবে। মিসেস গান্ধীর আশ্বাস সম্পর্কে সন্দেহ করার কোন কারণ নেই। ভারত সরকারের পক্ষ থেকে আরও বলা হয়েছে। তাঁদের সৈন্যবাহিনীকে বাংলাদেশের সুরকার যতদিন রাখার প্রয়োজন মনে করবে তাঁর চেয়ে বেশী দিন বাংলাদেশে রাখা হবে না। (“দি নিউইর্ক টাইমস”, ১৭ ডিসেম্বর, ১৯৭১)। ১৬ ডিসেম্বর নিউইয়র্কে অবস্থানরত বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী ও তাঁর সহকর্মীরা ভারত ও বাংলাদেশ বাহিনীর যুক্ত কমাণ্ডের নিকট পাকিস্তান বাহিনীর আত্মসমর্পণের সংবাদ পান। যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশ আন্দোলনের প্রতি সমর্থনদানকারী বিভিন্ন প্রভাবশালী ব্যক্তি প্রতিষ্ঠানকে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করার জন্য আরও কয়েক দিন অবস্থানের পর তিনি এবং বাংলাদেশ প্রতিনিধি দলের ওপর সদস্যগণ ২২ শে ডিসেম্বর লন্ডন ফিরে আসেন। লন্ডন ফিরে আসার পর বিচারপতি চৌধুরী বাংলাদেশের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামের নিকট থেকে একটি তারবার্তা পান। এই তারবার্তায় তাকে অবিলম্বে দেশের ফেরার অনুরোধ জানান হয়।

-মুক্তিযোদ্ধা মিত্র বাহিনী ও পাকবাহিনী হতাহত সম্বন্ধে জানা যায়। “ Indian causalities in the war were officially given as 1047 killed 3,042 wounded and 89 missing in East Pakistan and 1,426 killed 3,611 wounded and 2,140 missing on the western front. No official details of Pakistan casualties were issued, but according to reports from Dacca between 5,000 and 6,000 Pakistani soldiers were killed in East Pakistan between 5,000 and 6,000 Pakistani soldiers were killed in East Pakistan between Nov.19 and Dec. 16 and between 6,000 and 7,000 were missing. According to Indian Official sources, the Indian forces lost 73 tanks and 45 aircraft on both fronts and Pakistan 246 tanks and 94 aircraft. Pakistan’s naval losses were particularly heavy two out of eight warships two out of four submarines two out of eight minesweepers and 16 gun boats. The Indian Navy lost only frigate.” (KCA, 9.25058)

   Cease-fire on Western front

ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দ্রিরা গান্ধী এ দিন পশ্চিম রণাঙ্গনে যুদ্ধ বিরতি ঘোষণা দিলেন। পাকিস্তান যুদ্ধবিরতি প্রস্তাবে সুইস দূতাবাসের মাধ্যমে সম্মতি জানায়। “Mrs Gandhi announced that she ahd ordered a unilateral cease-fire on the western front from 8 pm.on Dec 17. We have repeatedly declared that India has no territorial ambitions” she said. “Now that the Pakistan armed forces have surrendered in Bangladesh and Bangladesh is free, it is pointless in our view to continue the present conflict.” We have ordered our armed forces to cease fire everywhere on the we start front with effect from 20.00 hours (IST) on Friday, Dec 17” (P.25057)

প্রবাসী বাঙালীদের স্বাধীনতা সংগ্রামের ভূমিকা মূল্যায়ন করতে গিয়ে বি পি আই সংবাদ সংস্থা নানাবিধ ঘটনার উল্লেখ করে। সেগুলো হলোঃ সাতই মার্চ তারিখে লন্ডন নগরীতে প্রতিষ্ঠিত হয় বাংলাদেশ ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ। একাত্তরের মার্চ মাস থেকে শুরু করে স্বাধীনতা সংগ্রামে চূড়ান্ত বিজয় অর্জন পর্যন্ত সকল সময়েই ব্রিটেনে গঠিত এই বাংলাদেশ ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্বার্থে নিরলসভাবে সংগ্রাম করে গেছে। তারা বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্বপক্ষে বিশ্ব জনমত যুক্তরাষ্ট্র, সোভিয়েত ইউনিয়ন, ফ্রান্স, গণচীণ, সিংহল, বার্মসহ, বিভিন্ন দেশের সরকারের কাছে আবেদন এবং বাংলাদেশের গণহত্যা বন্ধের জন্য বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দের সাথে সাক্ষাৎ করেছিলেন। আমেরিকান বার এ্যাসোসিয়েশনের সদস্যবৃন্দ, সিনেটর ও কংগ্রেস সদস্যদের এবং বিশ্বের বিভিন্ন মানবতাবদী সংস্থার কাছে বাংলাদেশের ঘটনাবলী সম্পর্কে তথ্যাদি প্রেরণ করেছিলেন। তাঁরা বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম সম্পর্কে বেশ কয়েকটি তথ্য-পুস্তক প্রকাশ করেছিলেন এবং টাইমস, গার্ডিয়ানসহ লন্ডনের বহুল প্রচারিত পত্রপত্রিকায় এতদূরসম্পর্কে আবেদন ও তথ্যাদি প্রকাশের ব্যবস্থাও করেছিলেন। লন্ডনস্থ বাংলাদেশ ছাত্রসংগ্রাম পরিষদ-এর প্রতিনিধিরা বিশ্বের বেশ কয়েকটি দেশে জনমত সৃষ্টি করার জন্য সফর করেছিলেন। বুদাপেষ্ট অনুষ্ঠিত আন্তঃপার্লামেন্টারী ইউনিয়ন কনফারেন্সসহ বিভিন্ন সম্মেলনে প্রতিনিধি প্রেরণ করেছিলেন। এছাড়াও রয়েছে স্বাধীনতা সংগ্রামে সাহায্যের জন্য অর্থ সংগ্রহ, মুক্তিবাহিনীর জন্য রসদ ও উপকরণ প্রেরণ ইত্যাদি। ব্রিটেন প্রবাসী বাঙালী ছাত্রদের এই নিরলস কর্মতৎপরতার মূলে মহতি প্রেরণা হিসেবে যিনি ছিলেন তিনি হলে বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী।

-বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাপ্তাহিক মুখপাত্র ‘জয়বাংলা” প্রথম পাতায় সম্পাদকীয়তেঃ “ভেঙ্গেছে দুয়ার এসে জ্যোতির্ময়’ শিরোনাম এদিন বলা হয়। ‘ঢাকা মুক্ত’। ঢাকা এখন আমাদের। জয়বাংলা। স্বাধীনতার এই পবিত্র উষালগ্নে, সাড়ে সাত কোটি মানুষের পরম প্রত্যাশা পূরণের এই পবিত্র মুহূর্তে আমরা ভাবাবেগে অধীর হ্যে নয়, শান্ত, সমাহিত ও সৌম্য হৃদয়ে স্মরণ করি অসংখ্য বীরের রক্তস্রোত ও মাতার অশ্রুধারাকে। স্মরণ করি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। ‘রাত্রির তমসা শেষে আসিবে না দিন? এই প্রশ্নের জাবাব এসেছে মহানগরী ঢাকায়। স্বাধীনতার রক্তমাখা পতাকা উত্তোলনের মধ্যদিয়ে। আমরা আজ গভীর কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করছি পঞ্চান্নকোটি ভারতবাসীর অকুতোভয় মৈত্রী এবং তাদের জগৎ বরেণ্য নেত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীর ঐতিহাসিক ভূমিকাকে। আমাদের স্বাধীনতা অর্জনের সংগ্রামে ভারতের বীর সৈনিকরাও রক্ত দিয়েছেন, আত্মদান করেছেন এবং রক্তঋণের অচ্ছেদ্য রাখিতে সারা বাংলাদেশকে বেঁধে ফেলেছেন।

জয় বাংলা’ সাপ্তাহিকীর ৫-কলাম ব্যাপী ৩৬ পয়েন্ট লাল অক্ষরের সংবাদ শিরোনাম ছিলঃ ঢাকা আমাদের।। মহানগরীর সরকারী বেসরকারী ভবনে স্বাধীন বাংলার পতাকাঃ বঙ্গবন্ধু দীর্ঘজীবি হোন ধ্বনিতে আকাশ বাতাস প্রকল্পিত।। আজ (বৃহস্পতিবার) বিকেলে ঢাকায় পাকিস্তান সেনাবাহিনী আত্মসমর্পণ করেছে। অগ্রসরমান মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় জওয়ানদের সম্মিলিত অভিযানে বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা নগরী মুক্ত এবং সকল সরকারী বেসরকারী ভবনে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উদ্দীন হয়েছে। জয় বাংলা’। মুজিবনগর থেকে শীঘ্রই স্বাধীন বাংলা প্রশাসনিক সদর দফতর ঢাকায় স্থানান্তরিত হচ্ছে বলে জানা গেছে।

-এদিন মুজিবনগর থেকে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমেদ বাংলাদেশের জনগণের ও সরকারের পক্ষ থেকে ভারত সরকার, মিত্রবাহিনী, মুক্তিবাহিনীর গৌরবজনক ভূমিকার জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। স্বাধীন বাংলার সংবাদে আরো বলা হয়, যুদ্ধবন্দীদের সাথে জেনেভা চুক্তি মোতাবেক আচরণ করা হবে। যদিও বাংলাদেশ জেনেভা চুক্তিতে স্বাক্ষর করেনি। সর্বত্র শান্তি ও শৃঙ্খলা বজায় রাখার আহবান জানান হয়।

-এ দিন জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে পাকিস্তানের বিশেষ প্রতিনিধি জনাব জুলফিকার আলী ভুট্টো নাটকীয়ভাবে সবকটি খসড়া প্রস্তাব ছিঁড়ে ফেলে সদলবে নিরাপত্তা পরিষদ থেকে বেরিয়ে যান। পূর্বে তিনি তার ভাষণে বলেন, এটাই বোধহয় আমার শেষ বক্তৃতা। এখানে আমরা আত্মসমর্পণ মেনে নিতে আসিনি। ইউপিয়াই-এর সংবাদে আরো বলা হয়, জাতিসংঘকে জালিয়াতি ও ধোকার পীঠস্থান’ আখ্যা দিয়ে মিঃ ভুট্টো বলেন, আমার দেশ এবং দেশের জনগণ যখন মৃত্যুর মুখে দাঁড়িয়ে, জাতিসংঘ তখন কতার ফুলঝরি ছুটিয়ে চলেছে। পাকিস্তানের জেনারেল নিয়াজী ভারতীয় কর্তৃপক্ষের কাছে যুদ্ধ বিরতির প্রস্তাব দিয়েছে-ঢাকা থেকে এ সংবাদ আসার সঙ্গে সঙ্গে নিরাপত্তা পরিষদের জরুরী বৈঠক ডিসেম্বর ৪ তারিখে ডাকা হয়। ব্রিটেন, ফ্রান্স, সোভিয়েত ইউনিয়ন ও চীনের ভূমিকা সম্বন্ধে কিছু মন্তব্য রেখে মিঃ ভুট্টোর শেষ কথাঃ চলচলাম যুদ্ধ করতে। এদিন রাত ২টা পর্যন্ত নিরাপত্তা পরিষদের অধিবেশনে প্রতিনিধি জর্জ বুশ (পরে প্রেসিডেন্ট) অবিলম্বে যুদ্ধ বিরতি ঘোষণা, ভারত-পাকিস্তানের সৈন্য স্ব-স্ব সীমান্তের ভিতরে ফিরিয়ে নেওয়ার সিদ্ধান্ত কার্যকর করার উদ্দেশ্যে মহাসচিবকে ক্ষমতা প্রদানের প্রস্তাব উত্থাপন করেছিলেন। যুদ্ধবিরতি প্রস্তাবের উপর সোভিয়েত নিরাপত্তা পরিষদ প্রতিনিধি মিঃ জ্যাকব মালিকভ তিনবার ভেটো (গর্ণম) প্রয়োগ করে,-ইতিমধ্যে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের অভ্যূদয় হয়-মুক্তিবাহিনী-মিত্রবাহিনী যৌথ বাহিনীর কাছে পাকিস্তানী পূর্বঞ্চলীর বাহিনীর আত্মসমপর্ণের মাধ্যমে।। উল্লেখ্য ৬ ডিসেম্বর গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের ভারত সরকার প্রথম স্বীকৃতিদানের প্রেক্ষিতে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমেদ স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে জাতীয় উদ্দেশে ভাষণে অনুরূপ বক্তব্য রাখেন।

Reference:

একাত্তরের দশ মাসরবীন্দ্রনাথ ত্রিবেদী