২৬ অগ্রহায়ণ ১৩৭৮ সোমবার ১৩ ডিসেম্বর ১৯৭১
[ মিত্রবাহিনী ঢাকার দ্বারপ্রান্তে। অকুতোভয় তরুণ যোদ্ধারা ঢাকার ভেতরে ঢুকে পড়েছে। ১১ সেক্টরের মুক্তিবাহিনী ঢাকার উপকণ্ঠে। নিয়াজির আরজি পিণ্ডিতে—আরো সাহায্য চাই—আকাশ—জল-স্থল সবদিকে অবরুদ্ধ। জনগণ রাস্তায় নেমে পড়েছে। পাকবাহিনীর সাথে জেলার বিভিন্ন স্থানে লরছে, মরছে তবু প্রতিশোধ চাই। মাতৃ পিতৃ সন্তান হারানোর প্রতিশোধ। মাতাভগ্নির সম্মান হারানোর প্রতিশোধ। জনতা রাস্তায় নিরস্ত্র তবু রক্তে সশস্ত্রের গর্জন।
আত্নসমর্পনের ফরমান পৌছালো নিউইয়র্কে — নিয়াজী আত্নসমর্পণে প্রস্তুত। ইয়াহিয়া খানঃ অসম্ভব, এটা হতে পারে না। এরকমই ছিল সেদিনের সংবাদ শিরোনাম।]— লেখক।
বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকায় শত শত পাকসেনা আত্নসমর্পণ করল। এক ময়নামতিতেই আত্নসমর্পণ করল ১১৩৪ জন। কিন্ত তখনও লেঃ জেঃ নিয়াজি অবচিল। তাঁর সঙ্গে একমত হয়ে প্রচণ্ড লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে খুলনা, বগুড়া এবং চট্টগ্রামের পাক—অধিনায়করা। পাক-সেনারা কোন পথ পাচ্ছেনা। — মুক্তিবাহিনী বা স্থানীয় মানুষের হাতে পড়লে মৃত্যু অনিবার্য। মেঃ জেঃ রাও ফরমান আলীর উদ্দেসশ্যে জেনারেল মানেকশ’র বাণী প্রচারিত হলঃ আমার সৈন্যরা এখন ঢাকাকে ঘিরে ধরেছে এবং ঢাকার সেনা নিবাস কামানের গোলার পাল্লার মধ্যে, সুতরাং আত্নসমর্পণ করুন। নিরাপত্তার ও ন্যায়সঙ্গত ব্যবহার করা হবে। (১০ খ. পৃ. ৭৯৩)
—- নিয়াজী বললো, প্রতি ইঞ্চি জমির জন্য লড়াই করে যাবো। উল্লেখ্য বিবিসি সংবাদ প্রচার করে জেনারেল নিয়াজি পশ্চিমে পাড়ি দিয়েছে। তাঁর প্রত্যুত্তরে নিয়াজী হোটেল ইন্টার কন্টিনেনটালে সমবেত সাংবাদিকদের বলেন, ধাকাররক্ষার জন্য আমৃত্যু যুদ্ধ চালিয়ে যাবো। এসময়ে ভারতের পররাষ্ট্র বিশয়ক কূটনৈতিক ডিপি ধর মস্কোর উদ্দেশ্য দিল্লী ত্যাগ করেন। সেনা বাহিনীর প্রধানের কাছে পাঠানো এক বার্তায় লেঃ জেনারেল নিয়াজী বলেনঃ ঢাকার পরিস্থিতি এতই খারাপ যে, নেফায় লড়াইরত চীনা সৈন্যরা শিলিগুড়ি সীমান্ত ও এর আশেপাশে বিমান ঘাঁটির ওপর আক্রমণ চালিয়ে ভারতকে ব্যতিব্যস্ত রাখতে পারলএ আমরা এখানে রেহাই পেতে পারি।
-‘ হোয়াইট হাউজ ইয়ারস’ বইয়ে তৎকালীন মার্কিন বিদেশ সচিব হেনরী কিসিঞ্জার পাকিস্তানকে সাহায্য না করার ব্যাপারটি একটু অন্যভাবে বলেছেন। তিনি বলেনঃ সোভিয়েত ইউনিয়ন চেয়েছিল ভারত পূর্বপাকিস্তানে লড়াই চালাক। ভারতকে সোভিয়েত ইউনিয়ন প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল চীনা সৈন্য ভারকে আক্রমণ করলে তারা সামলাবে। তারা একদিকে চীনের দূর্বলতা প্রকাশ করে দিতে চেয়েছিল। অন্যদিকে চেয়েছিল চীন ও আমেরিকার বন্ধুকে বিপদে ফেলতে। এই দুই দেশের কারও উপরই নির্ভরশীল থেকে যে লাভ হবেনা সেটাই প্রমাণ করতে চেয়েছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন।
লেঃ গুল হাসান টেলিফোন পশতু ভাষায় নিয়াজীকে জানায়, ১৩ ডিসেম্বর মধ্যাহ্নে পাকিস্তানী বাহিনী সাহায্য করার জন্য (হলুদ ও সাদা জাতি) উত্তর ও দক্ষিণ উভয় দিকে বন্ধুরা এসে পড়বে। (Pakistan’s Crisis in Leadership, pp. 186) কিন্তু
পরবর্তী সংবাদে জানান হয় নিয়াজী, পাকবাহিনীর সহয়তার জন্য মিত্রদের আগমন আটচল্লিশ ঘন্টা পিছিয়ে দেওয়া হয়েছে। (হোয়াইট হাউজ ইয়ারস পৃঃ ৯১১)
-এদিনের যুগান্তর পত্রিকায় পরিমল ভট্টাচার্য লিখেছেনঃ যুদ্ধ এখন ঢাকায়। দখলদারেরা ভারতীয় কামানের পাল্লার আওতায়। খানসেনারা তিন দিক থেকে বেষ্টিত হয়ে পড়েছে। তাদের স্বরচিত এবং স্বনির্বাচিত মৃত্যু সংবাদ ক্রমশঃ ছোট হয়ে আসছে। ভারতের ছত্রী বাহিনী সংগঠিত, মুক্তিবাহিনী সক্রিয়। ভৈরববাজার থেকে আগুয়ান একদল জওয়ান নরসিংদি পেরিয়ে রাজধানীর উপকণ্ঠে। আর একদল ধেয়ে আসছে জেলাসদর টঙ্গাইল মীর্জাপুরে। সোমবার মুক্ত হয় জয়দেবপুর। শীতলক্ষ্যা নদীপার হওয়ার চেষ্টা চলছে। যমুনার বাধাও অতিক্রান্ত। চাঁদপুর বিজয়ী মুক্তিবাহিনী মেঘনা পার হয়েছেন দাউদকান্দিতে। মুক্তিবাহিনী আছে মিত্রবাহিনীর পাশে।
-অবরুদ্ধ ঢাকা থেকে ভয়েজ অব আমেরিকার সংবাদদাতা জানিয়েছেন, ভারতীয় সৈন্য ঢাকার কেন্দ্র থেকে মাত্র ১১/১২ মাইল দূরে। লড়াই এখন প্রায় শহর এলাকাতেই।
-অন্যদিকে ভারতীয় জওয়ানদের কাছে পাক সেনাদের আত্মসমর্পণের পালা সামনে চলেছে। সোমবার লাকসাম ও কুমিল্লার আরও এক হাজার একশ চৌত্রিশজন আত্মসমর্পণ করেছে। তাদের মধ্যে চৌদ্দজন অফিসার ও পঁচিশজন জে-সি-ও আছেন। তারা ৫৩ ব্রিগেড, ২৩ পাঞ্জাব ১৫ জন বালুচ, ৩৯ বালুচ ৫২ ফিল্ড রেজিমেন্ট, ৪৭ ফিল্ড কোম্পানী ইঞ্জেনিয়ার ও ২১ আজাদ কাস্মীর রেজিমেণ্টের।
-ঢাকা ছাড়া খুলনা, বগুড়া ও চট্টগ্রাম সেক্টরে তুমুল লড়াই চলছে। … হিলির দিক থেকে ভারতের জওয়ানরা পাঁচবিবি মুক্ত করেছেন।…ভারতের জওয়ান ও মুক্তিবাহিনীর লোকজন ঈশ্বরদীর কাছে পদ্মা নদীর উপরে হারডিনজ ব্রিজ, রংপুরে, ময়নামতি নরসিংদি, চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারে কাছে শত্রু ঘাঁটির উপর আক্রমণ চালান। গোয়ালন্দ ঘাটে ও শত্রুঘাটির কিছু মোটর বোট ও সেনাবাহিনীর বহনের যান ধ্বংস করে। ময়নামতি ক্যান্টমেন্ট এখনও শত্রুদের দখলে। লড়াই চলছে। (আ,বা,প, ১৪.১২.৭১)।
-জেনারেল মানেকশ ঢাকাস্থ পাকিস্তানী সামরিক উপদেষ্টা মেজর জেনারেল ফরমান আলী উদ্দেশ্যে এক বার্তায় বলেছেন, ‘আমার সৈন্যরা এখন ঢাকাকে ঘিরে ধরেছে এবং ঢাকার সেনানিবাস কামানের গোলার পাল্লায় মধ্যে। যারা আত্মসমর্পণ করবে তাদের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা হবে এবং তাদের প্রতি ন্যায়সংগত ব্যবহার করা হবে।’
-সমগ্র ব্রিটেন থেকে হাজার বাঙালী রোববার লন্ডনের স্পীকার্স কর্ণারে সম্বেত হন।
ব্রিটেনের আওয়ামী লীগের উদ্যোগ এই সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। বিক্ষোভকারীরা বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দানের জন্য দাবী জানায়। পরে ১০ ডাউনিং ষ্ট্রীটে প্রধানমন্ত্রীর কাছে এক স্মারকপত্র দেন। তারা ভারতীয় হাই কমিশনে যান। সেখানে ভারত বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়ার অভিনন্দন ও ধন্যবাদ জানায়। (ইউ এন আই/ আ.বা.প. ১৪.১২.৭১)
-এদিনের নিরাপত্তা পরিষদে বাংলাদেশ সম্পর্কিত বিতর্ক নিয়ে কিসিংস কন্টেমপরারি আর্কাইভস লিখেছেঃ
“When U.S resolution was put to the vote on Dec.13 it received 11 votes. Poland and the Soviet Union again voted against, and Britain and France abstained.
Mr. Malik stated that the Soviet Union could not support a resolution which ignored the main causes of the conflict, It would strongly support the adoption of effective steps by the security council which would provide for an immediate and to the bloodshed and a political for an political settlement in East Pakistan on the basis of respect for the legitimate rights and interests of the people.
- Koaclusko Morizet said that he had abstained because the resolution did not take all aspects of the problem into consideration.
Mr. Malik again proposed on Dec. 13 that the council should hear the Bangladesh representative, Mr. Justice Abu Sayeed Chowdhury. The President of council, Mr.A.J. pratt (Sierra Leone), however ruled against the proposal on the ground that Mr. Chowdhury was identified as representative of a new state called “Bangladesh” saying that he was not satisfied that such a state existed under international law, Mr. Malik then proposed that he should be heard as an individual with important information to convey. Although Mr. Pratt was prepared to rule in favor of this motion. Mr,
Huang Hua objected, whereupon Mr. Malik withdrew it.
Another draft resolution was submitted on Dec.13 by Italy and Japan calling for cease-fire withdrawal of forces, steps aimed at achieving a comprehensive political settlement, and the appointment of a committee of three council members to assist India and Pakistan in their efforts to “bring about normally in the area of conflict” and achieve reconciliation. After only a brief session on the following day, however the council adjourned without voting on it” (KCA, pp
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদ সোমবার এক বিবৃতিতে এই মর্মে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন যে, বাংলাদেশে থেকে রাষ্ট্রপুঞ্জের যেসব কর্মী কূটনৈতিক প্রতিনিধি ও বিদেশী নাগরিক নিরাপদে সরে আসতে চান বাংলাদেশ সরকার তাঁদের সম্ভাব্য সবরকম সুযোগ সুবিধা দেবেন।
-যশোরের পূর্বতন ডি সি জালালুদ্দিন আহম্মদ ও এস পি জাকারিয়া দখলদার বাহিনীর সঙ্গে সঙ্গে যশোর ছেড়ে গেছেন। যশোর বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক নব নিযুক্ত জেলা প্রশাসক জনাব ওয়ালিউর ইসলাম নতুন করে জেলার প্রশাসন গড়ে তুলছেন। বিদ্যুত সরবরাহ ও টেলিফোন চালু হয়েছে। উল্লেখ্য যশোর মুক্ত করে কারাগার থেকে ২৫০ জন রাজবন্দী মুক্তিলাভ করে তাঁদের নির্যাতনের ইতিহাস প্রকাশ করেন। আনন্দ বাজার পত্রিকায় (১৪ ডিসেম্বর) পার্থ চট্টোপধ্যায়ের সাক্ষাৎকারে ভিত্তিক প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়।
-রোববার সাতক্ষীরায় বাংলাদেশ সরকারের আসামরিক প্রশাসন চালু হয়। খুলনা জেলার এস পি শ্রী পঙ্কজ মিত্র সাতক্ষিরার কার্যভার গ্রহণ করেন। বাংলাদেশ সরকার শ্রী কে সি দাশকে সাতক্ষিরার এস ডি ও নিযুক্ত করেছেন। খুলনা-বরিশাল ও পটুয়াখালী জেলার আঞ্চলিক প্রশাসক জনাব এম এ মোমেন ও সৈয়দ কামালবখত এম,পি,এ সাতক্ষিরার সর্ব্বাত্মক দায়িত্ব পালন করেন। ১২৫ জন রাজকাররা কারাগারে ঢোকানো হয়।
রোববার সাতক্ষিরায় জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ সর্ব জনাব শেখ আবদুল আজিজ, এম এন, এ সৈয়দ কামাল বখত (এম পি এ) সালাউদ্দিন ইউসুফ এম এন এ, আবদুর রব সেরনিয়াবাত এম এন এ বক্তব্য রাখেন।
-সোমবারে মুজিব নগরে বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রীসভার এক জরুরী বৈঠকে শত্রুমুক্ত জেলাগুলোকে অবিলম্বে প্রশাসন চালু করার ব্যাপারে কয়েকাট গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। দুটি জেলায় এখন অসামরিক প্রশাসন ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা করা হচ্ছে। অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন। ত্রাণ ও স্বরাষ্ট্র জনাব এ এইচ এম কামরুজ্জামান, ভারত থেকে দ্রুত শরণার্থীদের ফিরিয়ে নেওয়ার ব্যাপারে ভারতের পুনর্বাসন মন্ত্রীর সঙ্গে তাঁর যে আলোচনা হয়েছে তা বৈঠকে জানান। তিনি মন্ত্রীসভা বৈঠকে জানান,
ভারতে ১ কোটি শরণার্থী ছাড়াও বাংলাদেশে ৩ কোটি দূর্ভিক্ষপীড়িত আবাল-বৃদ্ধ-নরনারী রয়েছেন তাঁদের আহারের ব্যবস্থা করতে হবে।
-উল্লেখ্য সমসাময়িক ঘটনা সম্বন্ধে কিসিং কন্টেম্পরারী আর্কাইভস লিখেছেঃ
The civil war, following the cyclone disaster of Nov. 1970 created the danger of a major famine in East Pakistan. The situation was rendered worse by floods which it was estimated at £41,100,000 on Sept. 9
-মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নিযুক্ত ভারতীয় রাষ্ট্রদূত শ্রী এক কে ঝা গতকাল এক টেলিভিশন সাক্ষাতকারে বলছেন যে, পাকিস্তান যদি বাংলাদেশের অস্তিত্ব স্বীকার করে নেয় তা হলে ভারত অস্ত্র সংবরণ করতে রাজি হতে পারে।
-ভারত যুদ্ধবিরতির আহবানে সাড়া না দিলে পাকিস্তানের সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের যে সব চুক্তি আছে, তাঁর শর্তগুলি কার্যকর করা হবে বলে আমেরিকা ভারতকে হুমকি দিয়েছে। লোকসভায় সকলশ্রেণীর সদস্য আজ তাতে গভীর ক্রোধ ও ক্ষোভ প্রকাশ করেন। রাজ্যসভাতেও নিক্সনের হুমির তীব্র সমালোচনা করা হয়।
-নোয়াখালী জেলার ফেনীতে এখন আবার স্বাধীন বাংলার পতাকা উড়ছে। এছাড়া মুক্তাঞ্চলে বিদ্যু ও জল সরবরাহ, টেলিফোন যোগাযোগ আবার চালু হয়েছে। সভা সমাবেশ, মিছিল করে মুক্তি-উৎসব পালন করা হয়চ্ছে প্রতিটি মুক্তাঞ্চলে। শরণার্থীরাও ফিরে আসছেন।
-যশোর ক্যান্টনমেন্টে পাকসৈন্যদের উচ্চ শক্তিসম্পন্ন মাইক্রোওয়েভ যোগাযোগ কেন্দ্রটি অক্ষত অবস্থায় ভারতীয় বাহিনী পেয়েছে। ডিভিশনাল কমাণ্ডার মেজর জেনারেল দলবীর সিং একথা জানান। তাছাড়া ৮ হাজার টন গোলাবারুদ সহ প্রচুর অস্ত্রশস্ত্র যশোর সেনানিবাসে পাওয়া যায়।
-রয়টার জাতিসংঘ থেকে পরিবেশিত সংবাদে বলা হয়ঃ
শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী জাতিসংঘের মহাসচিব উত্থান্টের কাছে এক পত্রে বলেছেন তিনি বাংলাদেশের নিজস্ব সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে কোন কথা বলতে পারেন না। বাংলাদেশের নিজস্ব বাহিনী নিজেদের মাতৃভূমিতে পাকিস্তানী দখলদার বিরুদ্ধে লড়ছেন। বাস্তবের দাবী জাতিসংঘের বাংলাদেশের বক্তব্য শুনতে হবে। বাংলাদেশ থেকে পাকিস্তানী ফৌজ হটিয়ে নিতে হবে এবং বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে পাক শাসকচক্রকে আলোচনায় বসতে হবে। এখন তাঁরা স্বাধীন। শ্রীমতী গান্ধী প্রশ্ন রাখেন, বহুরাষ্ট্র এখন আমাদের শান্তির ললিতবাণী শোনাচ্ছেন, গত নয় মাস ধরে বাংলাদেশে পাকিস্তানী লক্ষ লক্ষ নর নারী ও শিশু হত্যা করেছে। এক কোটি কোটি লোককে দেশছাড়া করেছে, শান্তিবাদীরা কি তখন চোখবন্ধ করে ছিলেন। ভারত দীর্ঘ দিন সংযত ছিল। …… এখন ভারতের শর্ত এবং বাংলাদেশের জনগণের ইচ্ছার ভিত্তিতেই শান্তি আসছে, আসবে। উল্লেখ্য গত মঙ্গলবার সাধারণ পরিষদে যুদ্ধবিরতি গৃহীত প্রস্তাবের পরিপ্রেক্ষিতেই এই পত্র লিখিত হয়। (আঃ বাঃ প ১৪.১২.৭১)
-পি টি আই, ইউ এন আই, রয়টার, এপি জাতিসংঘ থেকে পরিবেশিত অন্য এক সংবাদে বলা হয়ঃ অবিলম্বে যুদ্ধ বিরতি এবং সৈন্য অপসারণের জন্য সাধারণ পরিষদে যে প্রস্তাব গৃহীত হয়েছে, ভারত যাতে সেই প্রস্তাব কার্যকর করে, সেই উদ্দেশ্যে গতকাল রাতে।
-নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠক ডাকার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র জোর তৎপরতা চালাচ্ছেন। কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়ন ও পোল্যাণ্ড বৈঠক আজ পর্যন্ত স্থগিত রাখার জন্য অনুরূপ দৃঢ়তার সঙ্গে দাবি জানালে শেষ পর্যন্ত স্থগিত রাখা হয়। (আ.বা.প)
-এই সময়ে ঢাকার কর্মরত বাঙালী উচ্চপদস্থ সরকারী অফিসারদের গভর্ণর ভবে একত্রিত হওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়। এই নির্দেশের পিছনে তাদেরকে গ্রেফতার ও হত্যা করার একটি পরিকল্পনা রয়েছে বলা জানাজানি হওয়ায় সংশ্লিষ্ট অফিসারবৃন্দ এই সমাবেশ অনুপস্থিত থাকেন। উল্লেখ্য ২৮ ডিসেম্বর ষ্টেটম্যান পত্রিকায় জনৈক কর্ণেল নাকভীর বরাত দিয়ে বলা হয় যে, গভর্ণর মালেককে জানান হয় বাঙালী অফিসারদের হত্যা করার উদ্দেশ্যে তাদেরকে গভর্ণর হাউজে সমবেত করার জন্য উর্ধতন সামরিক কর্তৃপক্ষ ১৩ ডিসেম্বর এক গোপন পরিকল্পনা গ্রহণ করেছিল।
-উত্তর দিক থেকে জেনারেল নাগরার বাহিনী এবং কাদের সিদ্দিকী পরিচালিত মুক্তিযোদ্ধাগণ সন্ধ্যায় পাকবাহিনীর হালকা প্রতিরোধ ব্যর্থ করে কালিয়াকৈর অবধি এসে পৌঁছায়। বাংলাদেশ নিয়মিত বাহিনীর সর্বপ্রথম ইউনিট হিসাবে ২-ইবি ঢাকার অদূরবর্তী শীতলক্ষ্যার পূর্বপারে মুরাপড়ায় উপস্থিত হয় একই দিনে (ডিসেম্বর ১৩)। (মূলধারা’৭১: পৃঃ ২২৮)
-মুজিবনগর তখন চরম উত্তেজনা। প্রতিমুহূর্তে খবর আসছে ঢাকা ছাড়া বাংলাদেশের প্রতিটি জেলা মুক্ত। বালীগঞ্জে স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্রের ষ্টুডিওতে বসে বার্তা বিভাগীয় প্রধান কামাল লোহানী আর আলী যাকের ও আলমগীর কবির ঘনঘন সংবাদ বুলেটিন পরিবর্তন ও পরিবেশন করে চলেছেন। ১৩ ডিসেম্বর থেকে রেডিও পাকিস্তান ঢাকা কেন্দ্রের অনুষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেছে। বাংলাদেশ মুক্ত হতে চলছে সংবাদে প্রতিটি বাঙালীর মনে উল্লাস। কাজ বিনা কাযে সকলেই থিয়েটার রোড থেকে প্রিন্সেস ষ্ট্রীট বা স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের ষ্টুডিও সর্বত্র সকলের চোখ। শরণার্থী শিবিরগুলোতে স্বদেশে ফেরার ব্যাপক প্রস্তুতি চলথে থাকে। নতুন আশা জাগে, আমরা আর রিজিউজী, শরণার্থী বা নিরাশ্রয় নই। আমরা এখন স্বাধীন সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের নাগরিক। আনন্দ, হাসি, কান্না সব মিলিয়ে এক অনির্বচনীয় অনুভূতি। তাঁদের সকল হৃদয় মন জুড়ে আছে নব অভ্যুত্থানের এক বিরাট প্রত্যাশা।
Reference:
একাত্তরের দশ মাস – রবীন্দ্রনাথ ত্রিবেদী