রাহুমুক্ত কালীগঞ্জ দেখে এলাম
দেব্রত মজুমদার
ভাবতেই পারিনি সত্যি-সত্যিই বাঙলাদেশের মাটিতে পা দেব। আজ থেকে দুই দশক আগে যে দেশ অনেক তিক্ততার মধ্যে দিয়ে ছেড়ে এসেছিলাম, সে দেশ যে আবার ‘ভাই’ বলে সাদরে বরণ করে নেবে, ভাবিনি কখনও।
২৬ নভেম্বর সুযােগ হলাে বাঙলাদেশের মুক্তাঞ্চলে যাবার। টাকী সীমান্ত দিয়ে প্রবেশ করলাম আমরা। কজন। ইছামতীর ওপারে বাংলাদেশ মুক্তিবাহিনীর হেড কোয়ার্টার। বরিশাল, পটুয়াখালি, ফরিদপুর, খুলনা নিয়ে ৯নং সেক্টর। সেক্টর কমান্ডার মেজর জলিল। আতিথেয়তার সঙ্গে তিনি আমাদের গ্রহণ করলেন। নানা কাজে ব্যস্ত, অনবরত খবর আসছে, মুক্তিবাহিনী সাতক্ষীরার এক মাইলের মধ্যে, তিনদিক থেকে যশাের আক্রান্ত। এত ব্যস্ততার মধ্যেও ধীর-স্থিরভাবে আমাদের সঙ্গে কথা বললেন।
কথা বলছি, এলেন একজন মুক্তিযােদ্ধা, বয়স খুব বেশি হলে ২০/২২ মন দিয়ে শুনলেন ওঁর কথা। মিষ্টি করে হেসে বললেন : যাও ভাই, সব দেখব। ওঁরা আমার মেহমান, ওঁদের সঙ্গে কাজটা আগে সারি ।
বাইরে মুক্তিযােদ্ধাদের ভিড়, নানা বয়সের সব। কারও ২৫/২৬-এর উপর নয়। সকলেই চাইছেন গরম জামা, কাপড়, জুতাে। শীত পড়েছে বেজায়—গরম কাপড় বলতে ওঁদের কিছুই নেই। সঙ্গে সামান্যই ছিল, মাত্র ১৫০টি সােয়েটার। আমাদের সঙ্গী বন্ধু জিষ্ণু দে ও সত্যকাম সেনগুপ্ত খুশীমনে সেগুলাে তুলে দিলেন ক্যাপ্টেন জিয়ার হাতে। এত বড় নামকরা যােদ্ধা, কী যে খুশি ! বললেন, “আমার ছেলেরা এতেই যা খুশি হবে…।”
হেড কোয়ার্টারে কাজকর্ম সেরে ইছামতী নদীতে লঞ্চে উঠলাম লক্ষ্য মুক্তাঞ্চল। সামনেই রয়েছে লঞ্চ। মেহমানদের জন্য অপেক্ষা করছে। এই লঞ্চটাই মাত্র কিছুদিন আগে পাকিবাহিনীর কাছ থেকে ছিনিয়ে আনা হয়েছে। এমনি আরও ৯টি। সারা গায়ে বাঙলাদেশের সবুজ রং, মাথায় স্বাধীন বাংলার পতাকা উড়ছে। লঞ্চে উঠতে যাব, দেখা হয়ে গেল একদল তরুণ মুক্তিযােদ্ধার সঙ্গে, সংখ্যা ৩০-৩৫। অপারেশান করে ফিরছে। মুখে ক্লান্তির ছাপ, চোখ জ্বলছে। কারও পায়ে জুতাে নেই, পা খালি, পরনে লুঙ্গি কাঁধে ঝােলান রাইফেল, মেশিনগান বা স্টেনগান। বড় লােভ হচ্ছিল একটা ছবি নিই।
বাঙলাদেশের গা ঘেঁষে চলেছি, পেছনে রইল এপার বাঙলার টাকী, হিঙ্গালগঞ্জ শহর দুটো। সামনেই বসন্তপুর, দূরে কালীগঞ্জ। ১২ মাইল ভিতরে চলে এসেছি।
এ শহরকে রক্ষা করার জন্য পাক ফৌজ ছােট বড় ১৬০টা বাঙ্কার তৈরি করেছিল, কিন্তু পারেনি, এই সেই শহর কালীগঞ্জ, মুক্তিবাহিনীর দখলে। ঘাটেই দেখা হলাে ফরিদ ভাইয়ের সঙ্গে, নামে ওঁকে চিনতাম, এবার চাক্ষুষ পরিচয় হলাে। ইনিও একজন যােদ্ধা। লড়াই করেছেন বরিশাল, পটুয়াখালিতে। এখানেও লড়াই করেছেন, আর “স্বাধীন বাঙলাদেশ” পত্রিকা চালাচ্ছেন।
ফরিদভাই ও পরিমল ঘােষ দুইজনেই মুক্তিবাহিনীর বীর সৈনিক, বয়েস ২৫-এর মধ্যে। ওদের সঙ্গে বেরিয়ে পড়লাম শহর দেখতে। বাজারে দোকান পাট সব ভােলা সারি সারি টিনের ঘর, সব কটির মাথায় উড়ছে জয়-বাঙলার পতাকা। চাষিরা ধান কেটে নিয়ে চলেছে, দর্জির সেলাই কলের শব্দ, দোকানীর কথাবার্তা, বাচ্চদের কলকালানি—সাত মাস পরে যেন কালীগঞ্জ আবার প্রাণ পেয়েছে। একজন ছােট দোকানদারকে জিজ্ঞেস করলাম, কেমন লাগছে? উত্তর এল, ইনশান আল্লা, আমরা এখন স্বাধীন।” একজন চাষি চলেছে ধান নিয়ে, তাকেও জিজ্ঞাস করলাম : যার চলে গিয়েছিল তারা ফিরে আসছে। চাষি হেসে জবাব দিল : কন্ কি বাবু, হিন্দু মুসলমান ভাই সাবরা সব আইতেছেন। আইবেন না ক্যান, ওখন তাে জয় বাঙলা হইছে।”
ফরিদ ভাইএর মুখে শুনলাম ১৯ নভেম্বরের ইতিহাস। দিনটা পবিত্র ঈদের। মাত্র ৫ জন মুক্তিসেনা আক্রমণ করল খানসেনাদের। ওদের সংখ্যা ১৮০ মতাে। পুরােদস্তুর তৈরি ওরা। চারদিকে বাঙ্কার তৈরি করেছে, শহরের মােড়ে মােড়ে, সবকটি পাকাবাড়ির উপরে, এমনকি মসজিদেও। যখন মুক্তিবাহিনী আক্রমণ করল তখন পাকিসেনারা ভয় পেয়ে পালাতে শুরু করল । ধরা পড়ল একজন বালুচ অফিসার। তার কাছ থেকেই জানা গেল যে ওদের কাছে খবর ছিল মুক্তিবাহিনী আসছে হাজরে হাজারে, নির্দেশ ছিল বেগতিক দেখলেই পালাবে। হলােও তাই, কাপুরুষের দল সামান্য যুদ্ধ করেই পালাল। কালীগঞ্জ, শ্যামগঞ্জ সহ একরাতেই ৪টি থানা দখল করল মুক্তিফৌজ। | নদীর ধারেই থানা। থানার দালান এখন মুক্তিবাহিনীর থাকবার জায়গা। একটা ঘর ছেড়ে দেওয়া হয়েছে ৪ জন রাজাকারকে। এদের মধ্যে একজন পােস্টমাস্টার, একজন বড় ব্যবসায়ী। খুন, লুট ও নারীধর্ষণের দায়ে এরা বন্দি।
পৌনে ৪টা নাগাদ খাওয়া-দাওয়া সারলাম। ফিরব ভাবছি। আলাপ হলাে জনাব মঞ্জুরের সঙ্গে। এর পরিচয়, ইনি আগে ছিলেন ব্যবহারজীবী, রাজনীতিতে আওয়ামী লীগ এম এন এ, এখন মুক্তিযােদ্ধা। সারাক্ষণ একটা বাচ্চা ছেলেকে আমাদের পাশে ঘুর ঘুর করতে দেখছি, কাঁধে একটা ভারী রাইফেল, ওজনটা ওর চেয়ে ভারী মনে হলাে। নাম জিজ্ঞেস করলাম। বলল : নাসিরউদ্দিন। জিজ্ঞেস করলাম। বলল: নাসিরউদ্দিন। জিজ্ঞেস কললাম : রাইফেল ছুড়তে জানিস? এতচুকুও ইতস্তত না করে একটা ঝাকুনি দিয়ে রাইফেল তুলল। মঞ্জুর ভাইকে জিজ্ঞেস করল? ছুঁড়বাে স্যার? বললাম, যুদ্ধ করেছিস? ক্ষোভের সঙ্গে বলল : না, আমাদের লড়াইএ নেয় না। এ্যানেড ছুড়েছি শালাদের বাংকারে। জানতে চাইলাম। মরেছে? মরছে কিনা ক্যামনে বলব, এ্যানেড ছুইড়ে ধানক্ষেত দিয়া পালাইছি।” মঞ্জুর ভাই বললেন : এবার বিচ্ছুবাহিনী। খবর সংগ্রহ করা থেকে শুরু করে এহেন কাজ নেই এরা না পারে। এরাই অর্ধেক লড়াই লড়ছে বাকিটা আমরা।” বিচ্ছুর দিকে তাকিয়ে আমার বারবার মনে হচ্ছিল, এরা স্বাধীনতা জিতে নেবেই, এদের কেউ হারাতে পারে না। যে দেশের দুগ্ধপােষা শিশু ও নিজেকে মুক্তির সৈনিক ভাবে, পৃথিবীতে এমন কেউ নেই যে এদের হারাতে পারে।
ফিরে চলেছি। নদীর তীর উপছে পড়ছে, মেহমানদের বিদায় দিতে এসেছেন গ্রামবাসীরা। কোথায় ফিরে চলেছি। যেখানে রাতের অন্ধকারে ভাই ভাইয়ের বুকে বেঁধাবার জন্য গােপনে ছুরি শানায়, দিশাহারা যৌবন নিষ্ফল আক্রোশে পুড়ে ছাই হয়ে যায়, প্রতিবেশী প্রতিবেশীকে খুন করে শ্রেণীসংগ্রাম করে? ইছামতীর পবিত্র জলধারায় এপার বাঙলায় অশুচি আত্ম কি পবিত্র হবে না?
সূত্র: সপ্তাহ, ১৭ ডিসেম্বর ১৯৭১