You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.03.08 | অগ্নিগর্ভ পূর্ব পাকিস্তান | কালান্তর - সংগ্রামের নোটবুক

অগ্নিগর্ভ পূর্ব পাকিস্তান

পূর্ব পাকিস্তানে বারুদের স্কুপে তােপ দেগে জঙ্গী রাষ্ট্রপতি ইয়াহিয়া খান দাবানল জ্বেলেছেন। সাত কোটি বাঙালীর প্রাণে আজ দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছে। গগনস্পর্শী অগ্নিশিখা দেখে জেনারেল সাহেব নিজের হঠকারিতার কথা ভেবে হয়তাে খানিকটা বিচলিত হয়ে পড়েছেন। তাই ২৫ মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশন ডেকে কিঞ্চিৎ শান্তিবারি সিঞ্চনের প্রয়াস পেয়েছেন। কিন্তু সে অধিবেশন কোথায় হবে তিনি ঘােষণা করেন নি। সঙ্গে সঙ্গে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে বিমান ও জাহাজযােগে আরাে ফৌজ পূর্ব পাকিস্তানে পাঠাচ্ছেন তিনি। এটা পূর্ব পাকিস্তানকে শান্ত করার সদিচ্ছা নয়, আরাে ভীতি প্রদর্শনের নমুনা। সহস্র সহস্র শহীদের শােণিতসিক্ত পথের স্মৃতি বিস্মৃত হয়ে আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মুজিবর রহমান ইয়াহিয়া খানের এই শয়তানীর কাছে আত্মসমর্পণ করে তার জল্লাদপনাকে প্রশ্রয় দেবেন এমন ধাতুতে তিনি গঠিত নন। এই নির্বিচারে গণহত্যার জন্য ইয়াহিয়া খানকে অবশ্যই কৈফিয়ৎ দিতে হবে।
কোনাে গুপ্ত অস্ত্রাগারে পূর্ববঙ্গের এই বারুদখানা আবিষ্কৃত হয় নি। সাত কোটি মানুষের নিশ্চিন্দ্র গণতান্ত্রিক ঐক্যই এই অগ্নিগর্ভ বারুদাগার। ১৯৫২ সালে মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষার জন্য প্রাণ বিসর্জন দিয়ে যাঁরা অগ্নিস্ফুলিঙ্গ জ্বেলেছিলেন তাঁদের বুকের পাজরে গড়া বজ্রই আজ সারা পূর্ব পাকিস্তান কার্যত পশ্চিম পাকিস্তানের উপনিবেশে পরিণত। জীবিকার ওপর আঘাত, মাতৃভাষার ওপর আঘাত, গণতান্ত্রিক অধিকারের ওপর আঘাত। আঘাতের পর আঘাত পূর্ব বঙ্গের মানুষকে সচেতন ও সংগ্রামী করে তুলেছে। গণতান্ত্রিক শক্তিকে দাবিয়ে শােষণ অব্যাহত রাখার অবশ্যই জঙ্গী শাসনের অন্তরালে শােষকবর্গের আশ্রয় গ্রহণ। কিন্তু অভিজ্ঞতার কষ্টিপাথর পরীক্ষিত পূর্ববঙ্গের সাতকোটি মানুষের বজ্র কঠিন ঐক্য আজ যখন এই বৈষম্যের মুলােৎপাটনে বদ্ধপরিকর ঠিক তখনি সেই গণতান্ত্রিক শক্তির উপর পুনরায় জঙ্গী আঘাত।
পাকিস্তানে আজ দুটো শক্তি মুখােমুখি দাঁড়িয়ে। একদিকে নিরস্ত্র অথচ দুর্বার গণতান্ত্রিক শক্তি -অন্য দিকে সশস্ত্র পাহারায় প্রতিক্রিশয়াশীল শক্তি। গণতান্ত্রিক শক্তির পেছনে পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের সমর্থন, আর সংখ্যালঘু প্রতিক্রিয়াশীল গােষ্ঠীর রক্ষকরূপে সামনের সারিতে হাজির সামরিক বল। গণতন্ত্র সেখানে এক অগ্নিপরীক্ষার সম্মুখীন। সংকীর্ণতাবাদী ভাসানীর দলের হঠকারিতাকে কোণঠাসা করে মুজিবর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ পূর্ব পাকিস্তানে এমন এক গণতান্ত্রিক ভিত্তি রচনা করেছে যেখান থেকে সেই শক্তিকে অস্ত্রবলে হটিয়ে দিতে জাদরেল জেনারেল ইয়াহিয়া খানকে হিমশিম খেতে হচ্ছে। জীবনমৃত্যু পায়ের ভৃত্য করে বুক দিয়ে সেখানে মানুষ লড়ছে। গণতন্ত্রের জন্য এ এক অভূতপূর্ব সংগ্রাম।
জেনারেল ইয়াহিয়া খান বলেছেন পাকিস্তানের ঐক্য বিনষ্ট হতে পারে এমন কোনাে সংবিধান তিনি অনুমােদন করবেন না। মুজিবর রহমান পাকিস্তানের অখণ্ডতার বিরুদ্ধে কোনাে কথাই বলেন নি। তাঁর দল আওয়ামী লীগ শুধু প্রদেশের আত্মনিয়ন্ত্ৰাধিকার চায়। এতে পাকিস্তানের অখণ্ডতা বা সার্বভৌমত্ব বিনষ্ট হবার নয়। এর দ্বারা শুধু পশ্চিম পাকিস্তানের একাধিপত্য ক্ষুন্ন হতে পারে। মুজিবর রহমানের এই সঙ্গত গণতান্ত্রিক দাবিই পশ্চিম পাকিস্তানের শােষক গােষ্ঠী ও তাদের মুখপাত্র জঙ্গী রাষ্ট্রপতিকে বেকায়দার ফেলেছে। আওয়ামী লীগ নেতার কণ্ঠে বিচ্ছিন্নতার বা সশস্ত্র প্রতিরােধের লেশমাত্র সুর থাকলেও ইয়াহিয়া খান বিদ্রোহী আখ্যা দিয়ে বিদ্রোহ দমনের নামে একটা সশস্ত্র যুদ্ধের অবস্থা সৃষ্টি করতে পারতেন। কিন্তু মুজিবর সাহেব তাঁকে সে সুযােগ দেননি। তিনি শুধু পূর্ব পাকিস্তানকে স্তব্ধ করে দিয়েই প্রতিরােধের দুর্গ গড়ে তুলেছেন যে দুর্গে আঘাত হানতে গিয়ে জেনারেল ইয়াহিয়া খানের হাতই দুর্বল হয়ে পড়ছে।
শেখ মুজিবর রহমান ও তাঁর আওয়ামী লীগ আজ শুধু পূর্ব পাকিস্তানেরই নয়, গােটা পাকিস্তানেই সাধারণ মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষা ও শােষণমুক্তির জন্য লড়ছে। সামরিক চক্রের বর্মাচ্ছাদিত প্রতিক্রিয়াশীল চক্রের শাসন কবল থেকে অব্যাহতি না পেলে পশ্চিম-পাকিস্তানের সাধারণ মানুষেরও শােষণ থেকে মুক্তি নেই। পূর্ব-পাকিস্তানে গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠিত হলে পশ্চিম পাকিস্তানের সাধারণ মানুষও তার দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে এই গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য সংগ্রাম শুরু করতে পারে আর সেজন্যই পূর্ববঙ্গের গণতান্ত্রিক অভ্যুত্থানকে পশ্চিম-পাকিস্তানের প্রতিক্রিয়াশীল শশাষকগােষ্ঠীর এত ভয়।
শেখ মুজিবর রহমান বিচ্ছিন্নতা চান না, জেনারেল ইয়াহিয়া খানই তাঁর অবিমৃষ্যকারিতার দ্বারা পাকিস্তানকে দ্বিখণ্ডিত করার পথ ধরেছেন। এসম্বন্ধে পাকিস্তানের ভূতপূর্ব এয়ার মার্শাল আসগর খান একটি সময়ােচিত সতর্কবাণী। উচ্চারণ করে বলেছেন, পশ্চিম পাকিস্তানকে সম্পূর্ণরূপে সামরিক তাবে আনবার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র চায় পাকিস্তানকে দ্বিখণ্ডিত করতে। জেনারেল ইয়াহিয়া খান সম্ভবত সেই মার্কিন ফাঁদেই পা দিয়েছেন। তাঁর নির্মম অস্ত্রাঘাতে অস্থির হয়ে পূর্ববঙ্গে যদি বিচ্ছিন্নতার অনুকুলে মনােভাব প্রবল হয়ে ওঠে ও তার ফলে গৃহযুদ্ধ বাধে তার জন্য দায়ী হবেন তিনি।
পূর্ব-পাকিস্তান আজ শুধু স্বদেশের প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির বিরুদ্ধেই নয়, সামাজ্যবাদী চক্রান্তের বিরুদ্ধেও লড়ছে। গণতান্ত্রিক শক্তি যে সামরিক শক্তির মােকাবিলা করতে সমগ্র ভারতের মধ্যবর্তী নির্বাচনকালে পূর্বপাকিস্তানের অভীমন্ত্রে দীক্ষিত কোটি কোটি সংগ্রামী মানুষ আমাদের সে শিক্ষাই দিচ্ছে।

সূত্র: কালান্তর, ৮.৩. ১৯৭১