২৫ মার্চ পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের অধিবেশন ইয়াহিয়া খানের ঘােষণা
নয়াদিল্লী, ৬ মার্চ (ইউ এন আই) – পূর্ব পাকিস্তানের দাবির প্রতি নতি স্বীকার করে আজ এক বেতার ভাষণে পাকিস্তানের জঙ্গী প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান আগামী ২৫ মার্চ পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের অধিবেশন অনুষ্ঠানের তারিখ ঘােষণা করেন।
প্রসঙ্গতঃ উল্লেখযােগ্য যে, দু’বছর আগে এই ২৫ মার্চ তারিখেই প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট আয়ুব খান-কে গদিচ্যুত করে জেনারেল ইয়াহিয়া খান পাকিস্তানের শাসন ক্ষমতা দখল করেন।
বেতার ভাষণে উক্ত অধিবেশনের স্থান সম্পর্কে উল্লেখ করা হয় নি। গত ৩ মার্চ ঢাকা শহরে জাতীয় পরিষদের প্রথম অধিবেশন শুরু হওয়ার কথা ছিল কিন্তু ১ মার্চ জেনারেল ইয়াহিয়া খা অনির্দিষ্টকালের জন্য এই অধিবেশন স্থগিত করে দেন।
এই অধিবেশন স্থগিতের প্রতিবাদে পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিটি প্রান্তে এক প্রচণ্ড গণ-বিক্ষোভ বিস্ফোরণের আকারে ফেটে পড়ে। ঢাকার রাজপথে সেনাবাহিনী ও জনসাধারণের যে খণ্ডযুদ্ধ শুরু হয় তাতে দু সহস্রাধিক ব্যক্তি হতাহত হয়। আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মুজিবর রহমানের আহ্বানে লাগাতর ধর্মঘট চলতে থাকে।
এ-পি’র এক সংবাদে জানা যায় যে, গতকাল ঢাকার উপকণ্ঠে টঙ্গী শিল্পাঞ্চলে নিরাপত্তা বাহিনী ও বিক্ষোভকারী শ্রমিকদের মধ্যে এক সংঘর্ষে ২০ ব্যক্তি নিহত হয়।
গতকাল এক জনসভায় ভাষণদান প্রসঙ্গে শেখ মুজিবর সৈন্যবাহিনীকে ব্যারাকে ফিরে যেতে আহ্বান জানান। শেখ মুজিবর আরও ঘােষণা করেন-সৈন্যবাহিনী ছাড়াও বাঙালী শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে জানে।
এক সপ্তাহব্যাপী সাধারণ হরতালের ঘােষণা অনুসারে আজও পূর্ব পাকিস্তানে পূর্ণ হরতাল প্রতিপালিত হয়।
শেখ মুজিবর রহমানের পরামর্শ অনুসারে ২ ঘন্টার জন্য কোন কোন অফিস ও ব্যাঙ্ক খােলা থাকে এবং এই সময় শ্রমিক ও কর্মচারীদের বেতন দেওয়া হয়। লাগাতর ধর্মঘট চলতে থাকায় বেতন দেওয়া স্থগিত ছিল।
আজ জেনারেল ইয়াহিয়া খানের বেতার ভাষণের কয়েক ঘন্টা পরও জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিতের প্রতিবাদে ঢাকায় ও পূর্ব পাকিস্তানের বিভিন্ন স্থানে বিক্ষোভ চলতে থাকে। শেখ মুজিবর ১ সপ্তাহব্যাপী যে হরতালের আহ্বান জানিয়েছিলেন আজ তার শেষ দিন।
আজ রাত্রিতে ছাত্ররা টর্চ লাইটসহ দুটি মিছিল পরিচালনা করে। আওয়ামী লীগের মহিলাদের পক্ষ থেকে দুটি পৃথক সমাবেশ হয়।
ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির (ওয়ালি গ্রুপ) পূর্ব-পাকিস্তান শাখাও মিছিল সংগঠিত করে।
সাংবাদিকদের পূর্ব-পাকিস্তান ইউনিয়ন এক বৈঠকে সংবাদপত্রের উপর সম্প্রতি যে বিধিনিষেধ আরােপ করা হয়েছে তা প্রত্যাহারের দাবি জানানাে হয়। মাধ্যমিক স্কুল শিক্ষকরাও প্রতিবাদ জানান।
জেনারেল ইয়াহিয়া খান তার তের মিনিটের বেতার ভাষণে ২৫ মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশনের তারিখ ঘােষণা করে বলেন যে সেনাবাহিনী পাকিস্তানের পূর্ণ ও অখণ্ড সংহতি রক্ষা করবে।
জে. ইয়াহিয়া খান আশা প্রকাশ করেন তার সিদ্ধান্ত সমস্ত রাজনৈতিক দলগুলির মধ্যে দেশপ্রেমিক ও গঠনমূলক মতামত জানাতে সাহায্য করবে। তিনি আরও আশা প্রকাশ করেন যে সংবিধান রচনার ক্ষেত্রে নেতৃবৃন্দ একটি সর্বসম্মত সিদ্ধান্তে পৌছিবেন।
জেনারেল ইয়াহিয়া খান জোর দিয়ে বলেন যে জনগণের প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করাই তার লক্ষ্য কিন্তু তিনি দুঃখ প্রকাশ করে বলেন যে পূর্ব পাকিস্তানের নেতৃত্ব জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিতের ঘােষণাকে সম্পূর্ণ ভুলভাবে গ্রহণ করেছেন। তিনি আরও বলেন যে এই নেতৃত্বের ভুল প্রতিক্রিয়ার ফলেই জীবন ও সম্পত্তির ধ্বংস সাধন হল। জেনারেল ইয়াহিয়া খান বলেন যে, কোন সরকারই পূর্ব-পাকিস্তানের এরূপ ধ্বংসাত্মক পরিস্থিতির সামনে নীরব দর্শক হিসাবে থাকতে পারেন না।
উপসংহারে জেনারেল ইয়াহিয়া খান বলেন “আমি স্পষ্টভাষায় বলতে চাইলে, যা কিছুই ঘটুক না, যতক্ষণ পর্যন্ত আমি পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতি এবং সামরিক বাহিনীর সর্বাধিনায়ক হিসাবে থাকব ততক্ষণ আমি পাকিস্তানের ঐক্য ও সংহতি রক্ষার কাজকে সুনিশ্চিত করব। এ সম্পর্কে কোন ভুল বা সন্দেহের অবকাশ নেই।”
ইউ এন আই এর সংবাদ : জেনারেল ইয়াহিয়া খানের বেতার ভাষণের পর আওয়ামী লীগের কার্যকরী কমিটির একটি জরুরী অধিবেশন সুরু হয়। বেতার ভাষণের উপর আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে এখনও কোন সিদ্ধান্ত জানান হয়নি।
আগামীকাল বিকালে এক জনসভায় আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মুজিবর রহমান একটি জরুরী ঘােষণা দেবেন।
ইতিমধ্যে জেনারেল ইয়াহিয়া খানের বেতার ভাষণের সঙ্গে সঙ্গেই পিপলস পার্টির চেয়ারম্যান শ্রী জেড এ ভুট্টো জাতীয় পরিষদে যােগদানের সম্মতি জানান।
পাকিস্তান মুসলিম লীগের নেতা খান আবদুল কায়ুম খান এবং জমিয়েত-ই-ইসলামীর নেতা মৌলানা মওদুদি জেনারেল ইয়াহিয়া খানের সিদ্ধান্তের প্রতি স্বাগত জানান।
সূত্র: কালান্তর, ৭.৩.১৯৭১