পূর্ব বঙ্গের গণ-অভ্যুত্থান ও তার শিক্ষা
-সত্যব্রু শর্মা
বঙ্গ যে শক্তির ওপর দাঁড়িয়ে শেখ মুজিবর রহমান সামরিক শক্তিকে চ্যালেঞ্জ করেছেন সেটি কিন্তু ভােটের দ্বারাই অর্জিত গণতান্ত্রিক শক্তি। এই গণতান্ত্রিক শক্তি দাঁড়িয়ে আছে একটি নৈতিক মানদণ্ডের ওপর। নির্বাচনের মধ্য দিয়ে সাধারণ মানুষের যে ইচ্ছাশক্তি প্রকাশ পেয়েছে সেই ইচ্ছাশক্তির মধ্যে কোনাে দ্বিধা ছিল
বলেই তা এমন এক ঐক্যশক্তিতে পরিণত হয়েছে যা ইস্পাতসদৃশ কঠিন। এটি গণতান্ত্রিক ঐক্যবােধ। পূর্ব পাকিস্তানের অধিবাসীদের মধ্যে ও শ্রেণী স্বার্থের সংঘাত ছিল এবং এখনাে আছে। কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানের শােষণ ও সামরিক শাসনের কবল থেকে মুক্তি না পেলে যে পূর্ব বঙ্গের কোন শ্রেণীর মানুষেরই বাঁচার উপায় নেই সেই বােধই সর্বসাধারণকে এনে দিয়েছে আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব। এটাই গণতান্ত্রিক অধিকার বােধ যা থেকে আসে স্বাধিকার লাভের সংকল্প সেই সংকল্পই পূর্ব বঙ্গের সাত কোটি মানুষকে আজ একসূত্রের বেঁধে দিয়েছে। তারা একমন, একপ্রাণ।
এই গণতান্ত্রিক ঐক্যবােধ একদিনে আসে নি। এজন্য পূর্ববঙ্গের সাধারণ মানুষকে বহু অগ্নি-পরীক্ষার মধ্যে দিয়ে আসতে হয়েছে। একথা ঠিক শ্রেণী বিভক্ত সমাজে জনসংখ্যার অধিকাংশকেই শােষণ যন্ত্রের নিষ্পেষিত হতে হয়। আবার এই শােষণ প্রণালীতেও স্তরভেদ থাকে এবং তদনুযায়ী শ্রেণী বিন্যাস হয়। বিভিন্ন শ্রেণীর প্রতিনিধিত্ব করে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল। ক্ষমতা লাভের আশায় প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক নে পরস্পরের মধ্যে বিরােধ বাধিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যেও অনৈক্য সৃষ্টি করেন। তার ফলে কোনাে বৃহত্তর ঐক্যের ক্ষেত্র প্রস্তুত হতে পারে না। অথচ গণতন্ত্রের মূল লক্ষ্যই জনসাধারণের বৃহত্তম অংশকে ঐক্যবদ্ধ করা। জনগণের সাধারণ স্বার্থ উপেক্ষা করে শুধু নিজ দলের শক্তি বৃদ্ধির চেষ্টা করলেই গণতন্ত্রের কুঠারাঘাত করা হয়। গণতন্ত্রের মূলে আসন প্রতিষ্ঠা ও শক্তি নির্ভর করে ঐক্যের ওপর। সগ্রামের বিভিন্ন স্তরে রণকৌশলের ভেতর দিয়ে এই গণ-ঐক্য যেমন বাড়তে পারে, আবার রণকৌশলে ভ্রান্তিবশতঃ তা ভেঙেও যেতে পারে। মূল শক্ত নির্ধারণ করেই সগ্রামেও বিভিন্ন স্তরে রণকৌশল নির্ধারণ করতে হয় এবং তা সঠিক হলে সগ্রামী মিত্র খুঁজে পেতেও কষ্ট হয় না। শত্রুর শক্তির পরিমাপ করেই মিত্রশক্তিকে এমনভাবে বাড়াতে ও সংহত করতে হয় যাতে শত্রু আঘাত হানতে এলে নিজেই পর্যন্ত হয়ে যায়।
পাকিস্তানের জন্মের কিছুদিনের মধ্যেই পূর্ববঙ্গের সাধারণ মানুষ বুঝতে পারে যে পশ্চিম পাকিস্তানের শশাষক গােষ্ঠী ইসলামের দোহাই পেড়ে পূর্ব বঙ্গকে সর্বতােভাবে দোহন করতে চায়। কিন্তু সদ্যজাত পাকিস্তান রাষ্ট্রের পূর্ব অংশে তখনাে পর্যন্ত সর্বস্তরে এই চেতনা আসে নি।
পূর্ব বঙ্গের ভূস্বামী গােষ্ঠী ও স্বল্পসংখ্যক মধ্যম শ্রেণীর পুঁজিবাদী ভাবলেন পশ্চিম পাকিস্তানীদের জুটী হয়ে তাঁরাও এই শশাষণের অংশীদার হবেন। এই জোটের পুরােভাবে ছিল মুসলিম লীগ যার নেতারা প্রধান হাতিয়ার রূপে ব্যবহার করতেন সাম্প্রদায়িকতা, বৈষম্যমূলক শাসন ও নগ্ন শশাষণ পূর্ব বঙ্গের মানুষের চোখ খুলে দিল। তারা বুঝতে পারলাে মুসলিম লীগের কবল থেকে শাসন ক্ষমতাকে মুক্ত করতে না পারলে পর্ব বঙ্গের বাঁচোয়া নেই। ছাত্র সমাজ এগিয়ে এলাে মাতৃভাষার দাবি নিয়ে। ১৯৫২ সালের সেই ভাষা আন্দোলনই পূর্ব বঙ্গের মুসলমান সমাজে আনলাে এক নতুন জোয়ার।
মুসলিম লীগ-বিরােধী রাজনৈতিক দলগুলিকে ঐক্যবদ্ধ করার প্রয়াস চললাে। তার ফলে ফজলুল হকের নেতৃত্বে গঠিত হলাে বিভিন্ন দল ও গণসংগঠনের যুক্তফ্রন্ট। ১৯৫৪ সালে সাধারণ নির্বাচনে সেই যুক্তফ্রন্ট পূর্ববঙ্গে মুসলিম লীগকে কবর দিয়ে ক্ষমতায় এলাে। ফজলুল হকের নেতৃত্বে গঠিত হয় মন্ত্রিসভা। কিন্তু কর্মসূচী রূপায়নে যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভায় প্রবল মতবিরােধ দেখা দেয়। যুক্তফ্রন্টের অভ্যন্তরে শ্রেণীস্বার্থের সংঘাত বাধে। শ্রমিক ও দরিদ্র কৃষকদের স্বার্থকে প্রাধান্য না দিয়ে ফজলুল হক গেলেন ধনী কৃষকদের সুবিধে করে দিতে। তার ফলে যুক্তফ্রন্ট সরকারের প্রতি শ্রমিক শ্রেণী ও গরিব কৃষকদের আগ্রহ অনেক খানি কমে গেল। ঐক্যকে নিচের তলার দিকে সম্প্রসারিত না করে আরাে সংকুচিত করে আনা হলাে যার ফলে গণতন্ত্রের মূল ভিত্তিটাই গেল শিথিল হয়ে। পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার তার সুযােগ নিতে ছাড়লেন না। আদমজি জুট মিলে শ্রমিক-শ্রমিকে দাঙ্গা বাধিয়ে এক ভয়াবহ অবস্থার সৃষ্টি করা হলাে। সেই দাঙ্গার জন্যে দায়ী করা হলাে এক মন্ত্রিসভার নীতিকে। বাঙালী-অবাঙালী বিরােধ বাধিয়ে ফজলুল হক ভারতের প্ররােচনায় পাকিস্তানের ঐক্য বিনষ্ট করতে চান এই অজুহাত দেখিয়ে পাক কেন্দ্রীয় সরকার হক মন্ত্রিসভাকে বরখাস্ত করেন ও গবর্নরের হাতে পূর্ববঙ্গের শাসনভার তুলে দেন।
এসব খেলায় সাম্রাজ্যবাদীদের হাত সর্বদাই পেছনে থাকে। যুক্তফ্রন্টের একটা দাবি ছিল পাকিস্তানকে মার্কিন সামরিক জোট থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। পূর্ব বঙ্গের এই মেজাজ স্বাভাবিক ভাবেই মার্কিন শাসকরা বরদাস্ত করতে পারেন নি। তাই পেছনে থেকে মার্কিন কূটনীতিকরা কেন্দ্রীয় পাক-সরকারকে দিয়ে এই কাজটি করান। কিন্তু গণতন্ত্রের ওপর এতবড়াে আঘাত পূর্ববঙ্গকে তখন হজম করতে হয় যুক্তফ্রন্ট সরকারের নীতির দুর্বলতার জন্যে; কারণ যুক্তফ্রন্ট ক্ষমতায় এসে গণতন্ত্রের ভিত্তিকে আরাে সম্প্রসারিত ও দৃঢ় করার পরিবর্তে গণ ঐক্যকে দলীয় তথ্য শ্রেণীস্বার্থের কাছে বলি দেন। গণতন্ত্রের কাঠামাে থাকলেও মূলত শ্রমিক শ্ৰেণী শােষিত কৃষক সমাজ ভিত্তিক না হওয়ায় প্রথম আঘাতেই তা ভেঙ্গে যায়; প্রতিরােধের শক্তি থাকে না।
যুক্তফ্রন্ট সরকারের অপঘাতে মৃত্যু হলেও তার ভাবমূর্তি পশ্চিম পাকিস্তানের সাধারণ মানুষকেও অনুপ্রাণিত করে এবং কেন্দ্রের লীগ সরকারের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অঙ্গ রাজ্যে গণবিক্ষোভ দেখা দেয়। বেগতিক বুঝে পশ্চিম পাকিস্তানের সমস্ত অঙ্গ রাজ্যের অস্তিত্ব মুছে দিয়ে সবগুলােকে নিয়ে পশ্চিম পাকিস্তান রাজ্য গঠন করা হয়। সেই থেকে পশ্চিম পাকিস্তান ও পূর্ব পাকিস্তান নামে দুটি অংশ পাকিস্তানের সামগ্রিক পরিচয় হয়ে দাড়ায়। এ করেও যখন পশ্চিম পাকিস্তানের শােষক গােষ্ঠী লীগ নেতৃত্বের উপর আর ভরসা রাখতে পারলাে না তখনি তারা সামরিক শাসনের ছত্রছায়ায় আশ্রয় নিল। ১৯৫৮ সালে আয়ুব খান সামরিক ডিক্টেটর হয়ে বসলেন।
এর পরে বুনিয়াদী গণতন্ত্রের নামে চলে প্রহসন। তাও টিকল না। অবশেষে আবার সামরিক শাসন। এই দীর্ঘকালীন উত্থান-পতনের মধ্য দিয়ে পূর্ববঙ্গের সাধারণ মানুষ অনেক অভিজ্ঞতা অর্জন করেছে। সমস্ত অভিজ্ঞতাকে ছাপিয়ে একটি অভিজ্ঞতা তাদের প্রজ্ঞাকে এমন ভাবে নাড়া দিয়েছে যে সেটি আজ সাত কোটি মানুষ অধ্যুষিত পূর্ববঙ্গের প্রতিটি মানুষের ধমনীতে ধমনীতে রক্তের সঙ্গে প্রবাহিত। তারা বুঝতে পেরেছে। স্বাতন্ত্র লাভ করা ছাড়া এই দাসত্ববন্ধন ও শােষণ নিগঢ় থেকে তাদের মুক্তি নেই। তাই আজ মুক্তির জন্য তাদের প্রাণপণ লড়তে হচ্ছে।
জঙ্গীশাহীর দাপটে পূর্ববঙ্গে সাধারণ মানুষের মনে যে তীব্র অসন্তোষ দেখা দেয় তাকে বিপথগামী করে গণতান্ত্রিক আন্দোলন থেকে বিচ্ছিন্ন করার প্রয়াস কম হয়নি। এই উগ্রপন্থীদের নায়ক মৌলানা ভাসানী। পিকিং নেতারা যেমন সব দেশেই কমিউনিস্ট পার্টিকে ও গণতান্ত্রিক আন্দোলনকে দ্বিধাবিভক্ত করতে প্রয়াসী, পূর্ববঙ্গেও তেমনি ভাসানীর নেতৃত্বকে সমর্থন করে তারা আওয়ামী লীগের গণতান্ত্রিক আন্দোলনে কীলক ঢােকাতে চেষ্টা করেছিলেন। তাই ভাসানীর শ্লোগান পূর্ববঙ্গকে পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন করে স্বাধীন পূর্ববঙ্গ রাষ্ট্র গড়ে তোেল। তিনি চরম হঠকারিতার পরিচয় দিলেন গত সাধারণ নির্বাচনের প্রাক্কালে নির্বাচন বয়কটের ফতােয়া দিয়ে। কিন্তু তার সেই ফাঁদে কেউ পা দিল না। পূর্ববঙ্গের আপামর জনসাধারণ গণতান্ত্রিক নির্বাচনে ভােট দিয়ে আওয়ামী লীগকে গােটা পাকিস্তানে নিরঙ্কুশ সংখ্যা গরিষ্ঠ দলের আসনে বসালাে। পিকিং প্ররােচিত ভাসানীর সংকীর্ণতাবাদ গণতান্ত্রিক চেতনা ও শক্তির কাছে প্রচণ্ড মার খেল। পূর্ববঙ্গের মানুষের গণতান্ত্রিক চেতনার তাৎপর্য এখানে-তার শক্তির জয় এখানে।
আমরাও এখানে এক গণতান্ত্রিক পরীক্ষার মধ্য দিয়ে এলাম। পশ্চিমবঙ্গে ও কেরালায় বামপন্থী যুক্তফ্রন্ট গড়ে উঠে শুধু দু’রাজ্যেরই নয়, সারা ভারতেরই সাধারণ মানুষের মনে যে আশার আলাে জ্বেলেছিল, মার্কসবাদী কমিউনিস্ট পার্টি তার দলীয় সংকীর্ণতাবাদের দ্বারা তা অনেকখানি স্তিমিত করে দিল কিন্তু গণতন্ত্র রক্ষার জন্যেই বামপন্থী যুক্তফ্রন্টের প্রয়ােজন আজ অনস্বীকার্য। কেরালার ও পশ্চিম বঙ্গে তাই কমিউনিস্ট পার্টি যুক্তফ্রন্ট রক্ষা ও গণতান্ত্রিক শক্তির সহযােগিতায় তার পরিধি বিস্তারের জন্য বুক দিয়ে লড়ছে। শ্রমিক নেতৃত্ব ও কৃষক নেতৃত্বকে আরাে জোরদার করে দেশের বামপন্থী ও গণতান্ত্রিক শক্তির সমম্বিত বলই পারে প্রতিক্রিয়াশীল শক্তিকে কোনঠাসা করে প্রকৃত গণতন্ত্রকে কায়েম করতে। এই ঐক্যের পথে যারাই আজ বাধা সৃষ্টি করছে তারাই গণতন্ত্রের শত্রু জাতীয় স্বার্থের পরিপন্থী।
সূত্র: কালান্তর, ১১.৩.১৯৭১