গৃহযুদ্ধের আবর্তে পূর্ব-বাঙলা ও বাঙলা দেশ স্বাধীন
শেখ মুজিবর রহমানের ঘােষণা
জনতার হাতে চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্র
সবকটি শহরে পথে পথে লড়াই
বাঙলা দেশ স্বাধীন।
মুজিবর রহমান কোন এক স্বাধীন বেতার কেন্দ্র থেকে এই ঘােষণা করেছেন বলে ইউ এন আই জানাচ্ছে। ঐ সূত্র এ-ও জানিয়েছে যে, চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্র বাঙলাদেশের স্বাধিকারের দাবিতে উদ্বুদ্ধ জনতার হাতে এসেছে।
পূর্ব পাকিস্তান রাইফেল বাহিনী ও পুলিস জনতার সঙ্গে সৈন্যবাহিনীর বিরুদ্ধে অস্ত্র হাতে দাঁড়িয়েছে।
ঢাকা, কুমিল্লা সিলেট, রাজশাহী, চট্টগ্রাম ও অন্যান্য শহরের পথে পথে লড়াই হচ্ছে। জনতা দলে দলে মরছে-কিন্তু সৈন্যদের মৃত্যুসংখ্যাও কম নয়।
জেনারেল ইয়াহিয়া করাচীর নিরাপদ আশ্রয় থেকে বাংলাদেশের সংগ্রামী জনতাকে ক্ষমতালােভী ও পাকিস্তানের শত্রু বলে বিষােদগার করছে। ওদিকে বঙ্গবন্ধু মুজিবর বেতার কেন্দ্র থেকে ঘােষণা করেছেন। “আমরা কুকুর বিড়ালের মত মরব না-বাঙলা মায়ের সুযােগ্য সন্তানের মত মরব।”
সামরিক শাসন কবলিত বাঙলাদেশ মুজিবরের ঐ ডাকে নির্ভীকভাবে সাড়া দিচ্ছে। অধিক রাত পর্যন্ত বিভিন্ন সংবাদ যা এসে পৌঁছেছে তা এ সংবাদের সত্যতা প্রমাণ করছে।
বাংলাদেশ এখন যথার্থ অর্থেই গৃহযুদ্ধের আবর্তে। গতকাল প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া ঢাকা থেকে কোন পূর্ব ঘােষণা ছাড়াই চলে যাওয়ার সময় থেকে এই যুদ্ধের সূচনা। ইয়াহিয়া ঢাকা ছেড়েছেন রাত ১১ টায়সৈন্যবাহিনী একশানে নেমেছ রাত ১২টায়। এদের লক্ষ্য ছিল পূর্ব-বাংলার জনতার প্রতি বিশ্বস্ত পূর্ব-পাকিস্তান রাইফেলবাহিনী ঐ অঞ্চলের সশস্ত্র পুলিসবাহিনী এবং সামরিক শাসনের হস্তচ্যুত ঢাকা বেতার-কেন্দ্র।
ইয়াহিয়া ১১ দিন ধরে আলােচনার নামে জনতার বিরুদ্ধে হিংস্র, সশস্ত্র আক্রমণের প্রস্তুতি করছিলেন তার পরিচয় মেলে যুগপৎ এইগুলির উপর আক্রমণের ঘটনা থেকে। স্মরণ থাকে যে গতকালই সংবাদ ছিল পাকিস্তানী সৈন্যের ৬০ হাজারের বিরাট বাহিনী পূর্ব বাংলার বিভিন্ন বন্দরে অবতরণ করে। ইয়াহিয়া এদেরই প্রতীক্ষায় সম্ভবত আলােচনাতে কাল হরণ করছিলেন।
বাংলাদেশের মুক্তিযােদ্ধারা সৈন্য বাহিনীর আক্রমণের বিরুদ্ধে এক প্রবল প্রতিরােধ গড়ে তুলছে। রেল লাইন ব্রীজ উড়িয়ে দিয়ে এবং নানাভাবে ব্যারিকেড তৈরি করে সৈন্যবাহিনীর অভিযান প্রতিহত করা হচ্ছে। স্বাধীন বাংলার বেতার কেন্দ্র থেকে দাবি করা হয়েছে যে ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা এবং দিনাজপুর শহরসহ এক বিস্তীর্ণ এলাকা শেখ মুজিবর রহমানের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণাধীনে আনা হয়েছে।
“পাকিস্তানের শত্রু রহমান”
– ইয়াহিয়া জেনারেল ইয়াহিয়া খান পূর্ব বাঙলার পূর্ণ স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে সংগ্রামী জনগণ ও তার নেতা মুজিবর রহমানের বিরুদ্ধে কুৎসা ও বিষােদ্গার করছেন। অন্যদিকে প্রাদেশিক দাঙ্গা লাগিয়ে দেওয়ার জন্য পূর্ব বাঙলার লক্ষ লক্ষ অবাঙালী মুসলমানকে প্রকাশ্যে সংঘর্ষে নেমে পড়ার আহ্বান দিয়েছেন।
গতকাল গভীর রাতে ঢাকা থেকে হঠাৎ প্রায় পালিয়ে যাওয়ার মত তিনি গােপনে করাচী যান। আজ সেখান থেকে বেতার ভাষণে মুজিবর রহমান ও তার দলকে বিশ্বাসঘাতক, পাকিস্তানের শত্র, ক্ষমতালােভী প্রভৃতি বাছাই বিশেষণে বিষােদগার করেন।
জেনারেলের বক্তৃতার মধ্যে জাতীয় পরিষদের অধিবেশন কবে বসবে তার কোন উল্লেখ নেই। রহমানের সঙ্গে ১১ দিন যে কথাবার্তা হলাে তার ফলাফল সম্পর্কে কোন উল্লেখ নেই। তার পরিবর্তে তিনি অভিযােগ করেন, রহমান বিশ্বাসঘাতক। রহমান ও তাঁর অনুগামীরা ক্ষমতালােভী ও পাকিস্তানের শত্রু। এরা পাকিস্তানের জাতীয় পতাকার অবমাননা করেছে। এরা পাকিস্তান প্রতিষ্ঠাতা জিন্নার ছবি অপবিত্র করেছে। এরা পূর্বাঞ্চলকে পাকিস্তানের বাইরে নিয়ে যেতে চায়।
জেনারেল ইয়াহিয়া পূর্ব-বাঙলায় যে “অসংখ্যা” অবাঙালী পাকিস্তানী আছেন তাদের “অবর্ণনীয় দুঃখের উল্লেখ করে বলেছেন, রহমান ও তাঁর অনুগামীরা সমগ্র পূর্ব-পাকিস্তান জুড়ে বিশৃঙ্খলা ও অরাজকতার সৃষ্টি করেছে।
জেনারেলের ভাষায় পাকিস্তানী বাহিনী এতদিন অদ্ভুত সংযম দেখিয়েছে। তাদের বিদ্রুপ ও উপহাসের পাত্র করা সত্ত্বেও তারা নিজেদের সংযত রেখেছে।
জেনারেল খান রহমানের উদ্দেশ্যে ঐ বিষােদগার করে বলেন, “এই অপরাধের শাস্তি দেওয়া হবেই। আমরা কিছু ক্ষমতালােভী এবং দেশদ্রোহীর হাতে দেশের ধ্বংস দেখতে পারি না।”
জেনারেল জাতীয় পরিষদ সম্পর্কে, নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে শাসনভার তুলে দেওয়া প্রভৃতি প্রতিশ্রুতি পূরণ না করলেও তিনি বলেন, ৬ মার্চ আমি বলেছিলাম পাকিস্তানের সৈন্যবাহিনী পাকিস্তানের সংহতি, নিরাপত্তা এবং অখণ্ডতা রক্ষা করবে। আমি তাদের সেই কর্তব্য পালনের নির্দেশ দিয়েছি এবং সরকারের কর্তৃত্বের পূর্ণাঙ্গ প্রতিষ্ঠার জন্য নির্দেশ দিয়েছি।”
সূত্র: কালান্তর, ২৭.৩.১৯৭১