You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.03.24 | বাঙলা দেশের স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম এক ঐতিহাসিক ঘটনা | কালান্তর - সংগ্রামের নোটবুক

‘বাঙলা দেশের স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম এক ঐতিহাসিক ঘটনা
ইউনিভার্সিটি ইনস্টিটিউটে অনুষ্ঠিত সভায় কমিউনিস্ট নেতৃবৃন্দের অভিনন্দন
(স্টাফ রিপাের্টার)

কলকাতা, ২৩ মার্চ-“সামরিক শাসনের নিষ্ঠুর পীড়নের বিরুদ্ধে স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে পূর্ববঙ্গের অধিবাসীগণ শেখ মুজিবর রহমানের সফল নেতৃত্বে যে বিপুল সাফল্য লাভ করেছেন তা বিভিন্ন দিক থেকে অপূর্ব ও ঐতিহাসিক।”
ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির পশ্চিমবঙ্গে রাজ্য পরিষদের উদ্যোগে ইউনিভার্সিটি ইনস্টিটিউট হলে আহূত কলকাতার নাগরিকদের এক সভা থেকে পূর্ববঙ্গের সংগ্রামী জনগণের প্রতি পূর্ণ সমর্থন এবং আন্তরিক অভিনন্দন জানিয়ে উপরােক্ত মর্মে সভায় একটি প্রস্তাব গৃহীত হয়।
প্রস্তাবে আরও বলা হয় যে, “একটি জাতির সামগ্রিক ঐক্য কিভাবে উগ্রতম প্রতিক্রিয়ার সশস্ত্র শক্তিকে পরাভূত করতে পারে পূর্ববঙ্গের সাম্প্রতিক ইতিহাস তারই এক অভূতপূর্ব উজ্জল দৃষ্টান্ত।
“পূর্ববঙ্গের জনগণের বিরুদ্ধে পাকিস্তানের সামরিক শাসকরা ও সাম্রাজ্যবাদীদের ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে এই সভা তাতে ধিক্কার জানাচ্ছে। সেই সঙ্গে শেখ মুজিবর ঘঘাষিত সেখানকার জনগণের ৩৫ দফা দাবি মেনে নিয়ে পূর্ববঙ্গের স্বাধিকার স্বীকার করার জন্য এই সভা দাবি জানাচ্ছে।”
অধ্যাপক অমিয় দাশগুপ্ত তার দীর্ঘ ভাষণে বাঙলার বর্তমান আন্দোলনের কথা প্রসঙ্গে ১৯৪৮ সাল থেকে শুরু করে বিগত নির্বাচনকালের এক বর্ণনা দিয়ে বলেন যে মুজিবর রহমান আপসহীন জাতীয়তাবাদী নেতা। পাকিস্তানকে অত্যাচারী মুসলিম লীগ শাসনের হাত থেকে মুক্ত করার সঙ্কল্প তিনি গ্রহণ করেছেন। সাম্রাজ্যবাদ ও প্রতিক্রিয়াশীলদের বিরুদ্ধে আন্দোলনের মধ্যেই তাঁর পরিচয় নিহিত আছে। সেই কারণে বিগত নির্বাচনে শতকরা ৯৮ ভাগ ভােট তাঁর দল পেয়েছে।
আজকের এই আওয়ামী লীগ যার পূর্বে নাম ছিল আওয়ামী মুসলিম লীগ কিন্তু গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রের আন্দোলনই তাদের মূল লক্ষ্য ছিল বলে শ্রী দাশগুপ্ত জানান।
তিনি আরও বলেন যে, পাকিস্তানে কমিউনিস্ট পার্টি আগাগােড়া বে-আইনী ছিল। সামরিক শাসনের মাধ্যমে ‘৫৪ সালে প্রথম যুক্তফ্রন্ট সরকার ভেঙ্গে দিয়ে নির্বাচন বন্ধ করে দেওয়ার পর কমিউনিস্ট পার্টি সারা পাকিস্তানে ঐক্যবদ্ধ গণতান্ত্রিক আন্দোলনের আহ্বান জানায়। ইতিমধ্যে একদিকে পূর্ব বাংলায় ধীরে ধীরে অর্থনৈতিক অগ্রগতি ও গণতন্ত্রের প্রসারের জন্য আন্দোলন শুরু হতে থাকল এবং অপরদিকে সামরিকচকে দমননীতি দুর্বারভাবে চলতে শুরু হল। পরবর্তী কালে পূর্ব বাংলার স্বাধীকারের মানুষের সমম্বয়ে যুক্তফ্রন্টের ৬ দফা দাবি ঘােষিত হয় বলে শ্রী দাশগুপ্ত জানান।
তিনি আরও জানান যে, নির্বাচনােত্তরকালে মার্কিনী দালাল পাক শাসকচক্র পাকিস্তানকে গণতন্ত্রের হাতে ছেড়ে দিতে প্রস্তুত নয়। তাই ভুট্টোকে শিখণ্ডী খাড়া করে জাতীয় পরিষদের বৈঠক নষ্ট করে দিল। গত কয়েক দিনের মধ্যে সামরিক শক্তির সামনে পূর্ববাংলার লক্ষ লক্ষ লােক লড়াই শুরু করে শতশত প্রাণ উৎসর্গের মধ্যে দিয়ে অভূতপূর্ব বীরত্বের পরিচয় দিল। এ এক অভূতপূর্ব বিপ্লব যা পূর্বে দেখা যায় নি। নেতৃত্ব সশস্ত্র সগ্রাম ঘােষণা করে নি কিন্তু সামরিক চক্রের বিরুদ্ধে ব্যাপকতম গণ জাগরণের ফলে সামরিক গােষ্ঠীকে ব্যারাকে ফিরে যেতে হয়। সমগ্র জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করতে পারলে সমস্ত রকম পশু শক্তির মােকাবিলা সম্ভব এটাই হ’ল অভিজ্ঞতা। ইয়াহিয়া খান যদি জনগণের অধিকার মেনে না নেয় তবে আগামী দিনে সশস্ত্র সংগ্রামের পথে পূর্ব বাংলার সমস্ত জাতিকে এগিয়ে যেতে হবে বলে শ্রী দাশগুপ্ত জানান।
পরিশেষে তিনি পূর্ব বাংলার জনগণের উদ্দেশ্যে আহ্বান জানিয়ে বলেন আমরা তােমাদের পাশে আছি। তােমাদের সংগ্রাম আন্দোলনের মাধ্যমে শিক্ষালাভ করে পশ্চিম বাংলা তথা ভারতের মুক্তি সংগ্রামকে এগিয়ে নিয়ে যেতে চাই।
সভার সভানেত্রী শ্রীমতী ইলা মিত্র তাঁর ভাষণে সাম্রাজ্যবাদ বিরােধী পূর্ব বাংলার জনগণের যুক্তফ্রন্টের সগ্রামের প্রতি সমর্থন জানান এবং তা থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে ভারতবর্ষের আগামী দিনের আন্দোলনের জন্য ব্যাপকতর যুক্তফ্রন্ট গঠন করার জন্য আহ্বান জানান।
সভায় শ্রী তরুণ সান্যাল তাঁর ভাষণে বলেন পূর্ব বাংলার লেখক ও সাহিত্যিকেরা নবযুগের আন্দোলনের পথে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। সেখানে গণতান্ত্রিক আন্দোলনের দ্বারা সাম্প্রদায়িকতা চূর্ণ হয়েছে। কমিউনস্টি নেতা মহঃ ইলিয়াস তাঁর ভাষণে বলেন পূর্ব বাংলায় যে নতুন হাওয়া উঠেছে তা সেখানকার মুক্তির আন্দোলন। তাদের আওয়াজ উঠেছে তােমার আমার ঠিকানা “পদ্মা-মেঘনা, যমুনা তাদের সংগ্রাম সামন্তবাদী, সাম্রাজ্যবাদী ও একচেটিয়া পুঁজিবাদীদের বিরুদ্ধে, এই আন্দোলনের জয়ুযুক্ততার মাধ্যমে সমস্ত রকম শৃঙ্খল মােচন করে পূর্ববাংলায় নতুন সমাজের সূচনা হবে বলে শ্ৰী ইলিয়াস জানান।
ভারতের কমিনিস্ট পার্টির কলকাতা জেলা পরিষদ সম্পাদক শ্রী অজয় দাসগুপ্ত তাঁর ভাষণে বলেন, পূর্ব বাংলার জনগণের সংগ্রাম সেখানকার সামরিক চক্রের বিরুদ্ধে শুধু তাই নয়, সারা পৃথিবীর সাম্রাজ্যবাদ বিরােধী সংগ্রামের অন্তর্ভূক্ত। পূর্ববাংলার জনগণের জয়ের মাধ্যমে এশিয়া মহাদেশে নবযুগের দ্বার খুলবে। সভায় কবি শ্রী সিদ্ধেশ্বর সেন তাঁর স্বরচিত কবিতা “মায়ের মুখের পূণ্য” পাঠ করেন।

সূত্র: কালান্তর, ২৪.৩.১৯৭১