You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.03.28 | গৃহযুদ্ধ নয় বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রাম -সত্যব্রত শর্মা | কালান্তর - সংগ্রামের নোটবুক

গৃহযুদ্ধ নয় বাংলা দেশের মুক্তি সংগ্রাম -সত্যব্রত শর্মা

মিঃ জিন্নার মুসলিম লীগ ছােরা বসিয়ে ভারতকে তিন খণ্ড করেছিল, আর জেনারেল ইয়াহিয়া খান পূর্ববঙ্গের সাড়ে সাত কোটি বাঙালির বুকে বন্দুক ও মেশিন গান ধরে পাকিস্তানকে রাজনৈতিক দিক দিয়ে দ্বিখণ্ডিত করলেন। ভৌগােলিক দিক থেকে এতদিন পাকিস্থানের অবস্থান দুখণ্ডে বিভক্ত থাকলেও এবষ্কাল রাষ্ট্রীয় বিচারে তা অখণ্ডই ছিল। কিন্তু জেনারেল ইয়াহিয়া খান ও তার সামরিক চক্রের হঠকারিতার দারুণ সেই রাষ্ট্রীয় অখণ্ডতা বিপন্ন হলাে। গণতন্ত্রের ওপর সরাসরি সশস্ত্র আঘাতের ফলে আওয়ামী লীগ বাধ্য হয়ে পূর্ববঙ্গের আপামর জনসাধারণকে সশস্ত্র প্রতিরােধের ডাক দিয়েছে। কেবল তাই নয়-পূর্ব বঙ্গ বাংলা দেশের স্বাধীন সার্বভৌম লােকায়ত্ত সাধারণতন্ত্র” রূপে ঘােষিত হয়েছে। প্রবল সামরিক চাপের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে এই নবজাত স্বাধীন রাষ্ট্রের অস্তিত্ব রক্ষা করা যাবে কিনা ভবিষ্যতই বলতে পারে। তবে একটা দেশের গােটা জাতি যদি বৈপ্লবিক শক্তি নিয়ে বিদ্রোহী হয়ে ওঠে, জনসাধারণের কোনাে অংশেরই সমর্থন বা সাহায্য যদি সৈন্যরা না পায়, কেবল সামরিক বলের দ্বারা সেই বিদ্রোহকে দমন করা আজকের দিনে সম্ভব কিনা ভাববার বিষয়। পূর্ববঙ্গের সঙ্গে পশ্চিম পাকিস্তানের স্থলপথে কোনাে যােগাযােগ নেই। খবরে প্রকাশ, চীন ও ব্রহ্মদেশ হয়ে পাক বিমানসেনা বিমানপথে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে বাংলা দেশে আসছে। দীর্ঘ সমুদ্রপথ ঘুরে সাত জাহাজ সৈন্য এবং সমরসম্ভারও বাঙালী জাতিকে শায়েস্তা করার জন্যে এসে পৌছেছে। কিন্তু সাতসমুদ্র তের নদী পার হয়ে এসে এক তপ্ত কাটাহবৎ পরিমণ্ডলে সাধ্য হবে কি সাড়ে সাত কোটি বাঙালীর বিদ্রোহ দমন করা? একটা জাতি যখন পণ করে মুক্তিযুদ্ধ শুরু করে তখন অস্ত্রবলে অপেক্ষাকৃত দুর্বল থাকলেও মনোেবলে সে অনেক বেশি বলীয়ান হয়। দক্ষিণ ভিয়েতনামই তার সাক্ষী। প্রশান্ত মহাসাগরে সপ্তম নৌবহর রেখে এবং ভিয়েতনামের বুকে প্রায় ৬ লক্ষ সৈন্য নামিয়েই কি মার্কিন শাসকরা পেরেছেন ভিয়েতনামীদের পদানত করতে? দক্ষিণ ভিয়েতনাম পূর্ব বঙ্গের চেয়ে আয়তনে অনেক ছােট এবং তার লােকসংখ্যা ও এক তৃতীয়াংশের বেশি নয়। সায়গনে একটা পুতুল সরকার ও একটা তাঁবেদার বাহিনীর পেয়েও যদি মার্কিন বাহিনী মুক্তিযােদ্ধাদের দ্বারা নাস্তানাবুদ হয়ে থাকে তবে বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের প্রতিরােধের সামনে ইয়াহিয়া খানের সৈন্যরা কতদিন দাঁড়াতে পারবে?
কিন্তু পূর্ববঙ্গের মানুষ এমন একটা দাবদাহের মধ্যে যেতে চায় নি। আগুন জ্বেলেছেন ইয়াহিয়া খান। সে আগুন-নেভাতে হবে পূর্ববঙ্গের মানুষকে বুকের টাটকা খুন ঢেলে। তারা চেয়েছিল শান্তিপূর্ণ পথেই একটা গণতান্ত্রিক পরিবর্তন, যে পরিবর্তন বাংলাদেশের ঘরে ঘরে এনে দেবে শান্তি, মুখে মুখে বিমল হাসি আর দমন-পীড়ন-শশাষণ থেকে মুক্তির আনন্দ। কিন্তু খল ভুট্টো ও তার সাঙাদের পরামর্শে ইয়াহিয়া খান তার পরিবর্তে উদ্যত হলেন রক্তের বন্যা বইয়ে দিতে। তাঁর এই অবিমৃষ্যকারিতাই পূর্ববঙ্গবাসীদের পূর্ণ স্বাধীনতা ঘােষণা করতে বাধ্য করলাে। ইয়াহিয়া খানের সশস্ত্র আঘাতই পূর্ববঙ্গবাসী বাঙালী জাতির মুক্তি সংগ্রামের ন্যায্যতা প্রতিপন্ন করে দিল।
গােটা পশ্চিম পাকিস্তানের আয়তন ৩ লক্ষ ১০ হাজার ৪০৩ বর্গ মাইলের বেশি নয়। লােক-সংখ্যা ৫ কোটির মতন। চারটি প্রদেশ নিয়ে সেটি গঠিত- পশ্চিম পাঞ্জাব, সিন্ধু, বেলুচিস্তান ও উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ। চার প্রদেশে ভিন্ন ভিন্ন জাতির বাস-যেমন পাঞ্জাবী, পাঠান, সিন্ধী, বালুচ ও উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের পাঠান, পাকতুন, আফ্রিদি প্রভৃতি জাতি ও উপজাতি সমূহ। এসব জাতির ভাষা, সংস্কৃতি ও আচার ব্যবহার এক নয়। সুতরাং পশ্চিম পাকিস্তানকে একটা জাতি বলা যায় না। আর সেখানে পূর্ববঙ্গের ক্ষেত্রফল মাত্র ৫৫ হাজার ১২৬ বর্গমাইল অথচ যার লােক সংখ্যা সাড়ে সাত কোটি। ভাষা এক সংস্কৃতি এক, আচার ব্যবহার এক -অর্থাৎ এক কথায় একটা বাঙালী জাতি। জাতি বলেই তার স্বাতন্ত্রবােধ স্বাভাবিক। গোঁজামিল দিয়ে গড়া পশ্চিম পাকিস্তানের শােষকগােষ্ঠী একটি সামরিক চক্র হাত করে যদি শুধু ধর্মের দোহাই পেড়ে পূর্ববঙ্গের বাঙালী জাতির স্বাতন্ত্র্য বিলুপ্ত করতে উদ্যত হয় তবে তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ দেখা দিতে বাধ্য। পশ্চিম পাকিস্তানেও চারটি অঙ্গরাজ্যের বিলুপ্তি ঘটিয়ে যখন একমাত্র পশ্চিম-পাকিস্তানের অঙ্গীভূত করা হয় তখনাে প্রবল অসন্তোষ দেখা দিয়েছিল। কিন্তু সামরিক দাপটে তা স্তব্ধ করে দেয়া হয়। গত সাধারণ নির্বাচনের পরে পুনরায় সেই চারটি অঙ্গ রাজ্যের স্বতন্ত্র অস্তিত্ব স্বীকৃত হওয়া সত্ত্বেও ভুট্টো এখনাে পর্যন্ত বলে বেড়াচ্ছেন তিনিই গােটা পশ্চিম পাকিস্তানের একমাত্র দাবিদার। অথচ তার পিপলস পার্টি নির্বাচনে উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশে পেয়েছে মাত্র একটি আসন আর বেলুচিস্তানে দুটি। সুতরাং বেলুচিস্তান ও উত্তর পশ্চিম সীমান্ত দেশের হয়ে তার কথা বলার অধিকার কোথায়? যাকে বলে গায়ে মানে না আপনি মােড়ল-ভূট্টোর হয়েছে সেই দশা। এখন কার্যত পশ্চিম-পাকিস্তান বলতে কিছু নেই-অথচ ভুট্টো গায়ে পড়ে নিজে নিজে পশ্চিম পাকিস্তানের মুরুব্বি সাজেন।
ভুট্টোর পিপলস্ পার্টি আসলে ভােট পেয়েছে বেশি পশ্চিম পাঞ্জাব ও সিন্ধুতে। পাঞ্জাবী পুঁজিদার ও অভিজাত সম্প্রদায় এবং সিন্ধুর সওদাগরদের স্বার্থরক্ষার জন্যেই ভূট্টো পশ্চিম পাকিস্তানের গােলকধাধা সৃষ্টি করেছেন। বেলুচিস্তান এবং উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশও কিন্তু বাংলাদেশেরই মতাে অনেক খানি উপেক্ষিত। কিন্তু তাদের জনবল ও ঐক্যশক্তি কম বলে করাচী রাওয়ালপিন্ডি চক্র ঐ দুটি প্রদেশকে দাবিয়ে রাখতে সমর্থ হয়েছে। হিসেব করে দেখলে তথাকথিত পশ্চিম পাকিস্তান বলতে যা বােঝায় তার সবটাই ভুট্টোর পেছনে নয়। গােটা পাকিস্তানে পাঞ্জাব ও সিন্ধুর প্রাধান্য অক্ষুন্ন রাখার জন্যেই আপ্রাণ চেষ্টা আর পূর্ববঙ্গের জাতীয় স্বাতন্ত্রবােধ চূর্ণ করার জন্য বেপরােয়া অস্ত্র-আস্ফালন।
পূর্ববঙ্গকে এই পাঞ্জাবী-সিন্ধী শােষণের দাস কীভাবে করে রাখা হয়েছে তার সামান্য দু একটি দৃষ্টান্ত দিলেই বােঝা যাবে। পাকিস্তান সৃষ্টির গােড়ার দিকে প্রতিটি মােজনার সিংহভাগ যেত পশ্চিমাংশের জন্য। পূর্ববঙ্গে এ নিয়ে প্রবল অসন্তোষ দেখা দিলে পরে খানিকটা পরিবর্তন করা হয়। ১৯৬২-৬৩ সালের জন্য যেখানে বরাদ্দ ছিল ১০ কোটি টাকা, ১৯৬৪-৬৫ সালের জন্যে সেখানে বরাদ্দ করা হয় ২৫ কোটি টাকা আর পশ্চিম পাকিস্তান পায় ১৫ কোটি টাকা। এই বাহ্য। শিল্পোন্নতির জন্যে কেন্দ্রীয় তহবিল থেকে যে অর্থ দেবার কথা তার ৯০০ কোটি টাকাই সংরক্ষিত রাখা হয় সিন্ধু উপত্যকা প্রকল্পে বিনিয়ােগের জন্য। পূর্ববঙ্গের পাট ও চা রপ্তানী দ্বারা যে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জিত হয় তার মােটা অংশই চলে যায় পশ্চিম পাকিস্তানের উদরে। এমন কি পূর্ব বঙ্গের জন্যে বরাদ্দ করা ত্রাণ তহবিলের টাকাও নিয়ে খরচ করা হয় পশ্চিম পাকিস্তানে। পূর্ব বঙ্গের অধিবাসীদের মাথা পিছু যত আয় তার চেয়ে ৪০ শতাংশ বেশী। পূর্ববঙ্গের অর্থনীতিকে এমন স্তরে রাখা হয়েছে যে শিল্পজাত পণ্য পশ্চিম পাকিস্তান থেকে কেন ছাড়া বাঙালীদের উপায় নেই। এক কথায় পূর্ববঙ্গ অর্থনীতির ক্ষেত্রে পশ্চিম পাকিস্তানের ওপর নির্ভরশীল যাতে থাকে তারই জন্য সমস্ত রকম ব্যবস্থা।
প্রশাসন যন্ত্রেও চরম বৈষম্য বিদ্যমান। সৈন্য বাহিনী ও সিভিল সার্ভিসে পাকিস্তানের পশ্চিমাংশেরই প্রাধান্য। উচ্চস্তরের পদগুলি তাদের জন্য প্রায় সংরক্ষিত বললেই চলে। ব্যবসা ও শিল্পের লাইসেন্সগুলিও পশ্চিম পাকিস্তানীদেরই বেশি করে দেয়া হয়।
একই রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে থেকে একাংশের দ্বারা অন্য অংশকে এভাবে শােষণ ও শাসন একটা আত্মসচেতন জাতি বেশিদিন সহ্য করতে পারে না। তাই পূর্ব বঙ্গে বার বার বিদ্রোহের স্ফুলিঙ্গ জলে ওঠে। বিদ্রোহের পরিধি সীমাবদ্ধ। তাই একটা সংহত সামরিক শক্তির তা দমন করতে বেশি সময় লাগে না। কিন্তু বিদ্রোহের কারণটা যদি থেকেই যায় বিদ্রোহ বাহ্যত দমিত হলেও ভেতরে ভেতরে ক্ষোভ তুষের আগুনের মতাে জ্বলতেই থাকে। যে কোনাে উপলক্ষে তা আবার আত্মপ্রকাশ করে। পূর্ববঙ্গে ভাষা আন্দোলন উপলক্ষ করে ১৯৫২ সালে ছাত্র সমাজের মধ্যে যে বিদ্রোহের সূচনা হয় তার পরে গত ১৮ বছর পূর্ব বঙ্গের বুকে বার বার প্রচণ্ড বিক্ষোভের ঢেউ খেলে গেছে। সেই তরঙ্গাভিঘাতে পাক শাসকবর্গ কেঁপে উঠেছেন এবং মিলিটারির বুটের তলায় ফেলে গণ-আন্দোলনকে পিস্ট করেছেন।
এবার সাধারণ নির্বাচনে পূর্ব বঙ্গের সেই বিক্ষুব্ধ জনতা আওয়ামী লীগকে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতায় বসিয়ে গণতান্ত্রিক শক্তির জোরেই প্রতিক্রিয়াশীল চক্রের ভরসাস্থল জঙ্গীশাহীকে সরাসরি চ্যালেঞ্জ করেন। এই দুর্বার গণতান্ত্রিক শক্তিকে বেসামরিক কায়দায় আর রােধ করা সম্ভব হচ্ছিল না বলেই ব্যালটের শক্তিকে বুলেটের দ্বারা হত্যার পথ ধরেছেন ইয়াহিয়া খান কিন্তু গণতন্ত্রের বক্ষ এতই বিস্তৃত যে বুলেটের দ্বারা সেই বৃক্ষ ভেদ করার সাধ্য তার নেই -সাড়ে সাত কোটি মানুষের বৃক্ষ ভেদ করার বহু আগেই ইয়াহিয়া খানের বুলেট ফুরিয়ে যাবে। পূর্ববঙ্গের বিদ্রোহ আজ গণতান্ত্রিক বিপ্লবে রূপান্তরিত তাই সেই বিপ্লবের বহ্নি ব্যাপ্ত সমাজের সর্বস্তরে। এই বিপ্লবকে সফল করার জন্যেই শুরু হয়েছে মুক্তিযুদ্ধ। এটা গৃহযুদ্ধ নয় মুক্তির জন্যে একটা জাতির সর্বস্ব পণ করে সশস্ত্র সগ্রাম।

সূত্র: কালান্তর, ২৮.৩.১৯৭১