You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.06.21 | দু-নৌকোয় পা | কালান্তর - সংগ্রামের নোটবুক

দু-নৌকোয় পা

বাঙলাদেশের মুক্তি-সংগ্রাম সম্পর্কে ভারত সরকারের মতিগতি ভাল ঠেকছে না। বাঙলাদেশকে সময় মত স্বীকৃতি না দিয়ে ভারত সরকার যে দ্বিধা ও দুর্বলতার সূত্রপাত করেছিল ক্রমে সেই ভুলের বােঝা ভারী হয়ে উঠছে। পার্লামেন্টে প্রধানমন্ত্রী এতােদিন বারবার একথাটাই বােঝাবার চেষ্টা করে এসেছেন যে, বাঙলাদেশকে স্বীকৃতি দিতে ভারত সরকারের কোন আপত্তি নেই-তবে কখন স্বীকৃতি দিতে হবে সেই নির্দিষ্ট সময়ক্ষণ সম্পর্কে কিছু কূটনৈতিক বিচারের প্রয়ােজন আছে। কিন্তু সেই অবস্থান থেকে ভারত সরকার যে পশ্চাদপসরণ করছে, তারই বিলক্ষণ ইঙ্গিত এখন পাওয়া যাচ্ছে। ইসলামাবাদের কাছে ভারত সরকারের কূটনৈতিক নােট, যার মধ্যে দাবি করা হয়েছে যে পাকিস্তান সরকার যেন বাঙলাদেশের জমির স্বত্ব ইত্যাদির রেকর্ড অম্লান রাখে, তার নির্গলিতাৰ্থ এইরূপই দাঁড়ায় যে, বাঙলাদেশের ব্যাপারে ইয়াহিয়ার কর্তৃত্ব যেন বিলুপ্ত হয়নি। বাঙলাদেশের জমির স্বত্ব ইত্যাদি পাকিস্তানের জঙ্গী শাসকদের কাছে আবেদন জানিয়ে কিংবা দাবি পেশ করে রক্ষা করা যাবে না। রাজনৈতিক কর্মীদের বিতাড়ন ও হিন্দুদের দেশছাড়া করার যে-নীতি ইয়াহিয়া খা ধরেছে, তারই অপরপিট হল বিতাড়িত ব্যক্তিদের অস্থাবর সম্পত্তির লুণ্ঠন, তাঁদের গৃহে অগ্নিসংযােগ এবং ঐ সব পরিবারের স্থাবর সম্পত্তিও দালালদের মধ্যে বিতরণ করে দেওয়া। বাঙলাদেশের স্বাধীন সরকারই এই ভাঙ্গা ঘর ক্রমে জোড়া দেবে। আজ যে জমিও সম্পত্তির রেকর্ড পােড়ান হচ্ছে, বিপ্লবী বাঙলাদেশ সরকার নিশ্চয়ই পুনরায় সেই রেকর্ড জনসাধারণের সহযােগিতায় সৃষ্টি করবে। বিপ্লবী জনতার সেই সৃজনশীলতাই হল ভরসা। ইয়াহিয়ার উপর ভরসা কোন ভরসাই নয়।
বাঙলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতি না দেবার দরুনই ভারত সরকার নিত্যনূতন ফাঁপড়ে পড়ছে। ৮০ লক্ষ থেকে ১ কোটি শরণার্থী ইয়াহিয়ার রাজত্বে কিছুতেই ফিরে যাবে না। ইয়াহিয়ার সঙ্গে ভারত সরকার যদি কোনরূপ সমঝােতার হাবভাব দেখায়, তা সঙ্গে সঙ্গে শরণার্থীদের স্বদেশে প্রত্যাবর্তনের ইচ্ছার উপরও ছাই ঢালে। তাছাড়া ইয়াহিয়া খা জমির ও সম্পত্তির স্বত্বের কাগজপত্র পুড়িয়ে ফেলেছে বলেই বাঙলাদেশের স্বাধীন বিপ্লবী সরকার সেই ছাই গাদায় চাপা পড়বে কিংবা উৎপাদন, সমাজ ও সভ্যতাকে পুনগঠনে অক্ষম হবেএসব চিন্তা ও বিচার সম্পূর্ণ ভ্রান্ত। অথচ ভারত সরকারের নােট ঐসব ভ্রান্ত ধারণাগুলিকে উস্কানী দেয় এবং শরণার্থীদের মধ্যে যারা দুর্বলচেতা, তাদের দুর্বলতাকেই আরও বৃদ্ধি করে।
দু-নৌকোয় পা রাখার নীতির পরিণাম অমনই হয়। ভারতে আগত শরণার্থীর স্বদেশে ফিরতে অক্ষম হলে ভারতও ডুববে এবং ভারতের স্বার্থেই স্বাধীন বাঙলাদেশে শরণার্থীদের প্রত্যাবর্তনকে আবশ্যিক করতে হবে। সুতরাং বাঙলাদেশের স্বাধীনতা শুধু বাঙলাদেশবাসীর প্রয়ােজন নয়, সেই প্রয়ােজন ভারতেরও। মুক্তির আন্দোলন ও মুক্তিফৌজকে সাহায্য দিয়েই ভারত সরকার এই অবস্থায় নিজ কর্তব্য পালন করতে পারে। আর এই মুক্তিবাহিনীকে উপযুক্তভাবে সাহায্য দেবার জন্যই বাঙলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতি দিতে হয়। সােজাসুজি এই কাজ-কোন বাকাচোরা কূটনীতি এক্ষেত্রে অচল। তবু নয়াদিল্লীর কর্তাদের চিন্তা ও কাজের মধ্যে কিছুতেই ভেজাল দূর হচ্ছে না।
আসলে নয়াদিল্লীর কর্তাদের মধ্যে স্বাধীন চিন্তা ও স্বাধীন কর্মই বিলক্ষণ বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছে। পশ্চিমী সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলির বাঙলাদেশ সম্পর্কিত শয়তানী কূটনীতির সঙ্গে তালে তাল মেলাতে গিয়েই ভারত সরকারের কূটনীতি জলে পড়ছে। বাঙলাদেশকে অবিলম্বে স্বীকৃতি দিয়ে ভারত সরকারকে এখনই ঐ জঙ্গলে পথ হারানাে অসংলগ্ন কথাবার্তা ছেড়ে দিতে হবে। বাঙলাদেশের ভাগ্য নিয়ে পশ্চিমী সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলি খেলতে পারে, কিন্তু ভারত সরকার তা পারে না। কারণ তার ফলশ্রুতি হল বাঙলাদেশ ও ভারতের এক সঙ্গে ভরাডুবি। ভারত সরকার কর্তৃক বাঙলাদেশকে স্বীকৃতিদান ও মুক্তিফৌজকে অকৃপণ সাহায্যদান আর এক মুহূর্তও বিলম্ব সইতে পারে না।

সূত্র: কালান্তর, ২১.৬.১৯৭১