দু মাসের নব-জাতক বাঙলাদেশকে রক্ষার জন্য
শয়তানদের অপ-প্রচারকে স্তব্ধ করে দিতে হবে
-দিবাকর গুপ্ত
বাঙলাদেশের সশস্ত্র বিপ্লবী মুক্তিযুদ্ধের বয়স মাত্র তিন মাস এবং স্বাধীন সার্বভৌম বাঙলাদেশ রাষ্ট্রের বয়স দু’মাসের অধিক নয়। অথচ এই সামান্য কয়েকটি দিনের মধ্যেই নবজাত শিশুটির বিরুদ্ধে এমন গাদা গাদা নালিস উপস্থাপিত করা হচ্ছে যেমন কর্ম কেবলমাত্র ঘােরতর প্রাচীন ও প্রতিক্রিয়াশীলদের দ্বারাই অনুষ্ঠিত হওয়া সম্ভব। ঐসব অভিযােগের কোন মা-বাপ নেই। কিন্তু নূতনের উন্মেষকে অতীত… কিন্তু, কিছু অবাঙালির মৃত্যুকেই একচেটিয়া প্রচার করা এবং তার দ্বারা সহস্রগুণ বাঙালীর মৃত্যুকে চাপা দেবার চেষ্টা করা কোনমতেই সাধু উদ্দেশ্য নয়। লক্ষ… বাঙলাদেশের মুক্তি সংগ্রামীদের আশ্রয় পায় না। বিষয়টা যখন এরুপ যে, কুইসলিং-দের ধরাপৃষ্ঠ থেকে না সরালে বাঙলাদেশের অপসৃত শরণার্থীর দেশে… রক্ষার ডাক দিলে মুহূর্তে মানুষ কিভাবে শান্ত হয়েছিল সেকথা বিশ্ববাসী এতদিনে বিলক্ষণ জেনেছেন। বাঙলাদেশের বাঙালীদের মৃত্যুর জন্যও কাঠগড়ায় তুলতে হবে ইয়াহিয়া খাকে। এটাই ঐতিহাসিক সত্য এবং এই সত্য কিছুতেই কারাের অপপ্রচারে, বিশেষ করে ইয়াহিয়ার চরদের প্রচারে চাপা পড়বে না। পাকিস্তান রাষ্ট্রকে হত্যা, পাকিস্তান রাষ্ট্রের বাঙালী অবাঙালীকে হত্যা এবং পাকিস্তানের হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে গণহত্যা হিন্দুমুসলমান নির্বিশেষে গণহত্যা সব কিছুর আসামী ইয়াহিয়া খান। আজও বাঙলাদেশের মুক্তিযােদ্ধাদের হাতে পশ্চিম পাকিস্তানের সহস্র সহস্র সৈন্য মার খাবে এবং মরবে। তারা অবাঙালী বলে নয়। বাঙলাদেশের মুক্তিসগ্রামের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরেছে বলেই তারা মার খাবে ও মরবে। বাঙলাদেশের মুক্তি-সংগ্রামীদের হাতে আজও বাঙালী কুইসলিং-রা মরবে। তারা বাঙালী বলে নয়-বাঙলাদেশের মুক্তি-সংগ্রামের বিরুদ্ধে শক্রর সাহায্যকারী হবার জন্য তারা মার খাবে ও মরবে। বাঙলাদেশের শত শত নির্দোষ এবং সাধারণ মানুষও প্রাণ হারাবে। তারা দুর্ভিক্ষে শুকিয়ে মরবে, মহামারীতে নিঃশেষ হবে। বাঙলাদেশের ভিতরে মরবে, বাঙলাদেশের বাইরে ভারতের পথে ঘাটেও বিড়াল-কুকুরের মত মরবে। নিরীহ যে-শিশুগুলি আজ কলেরায় মরছে, ইয়াহিয়ার বিরুদ্ধ অস্ত্র ধারণ করা দূরস্থান, এমনকি একটি ভােট দিয়ে ইয়াহিয়ার বিরুদ্ধাচরণের সুযােগও ওদের ঘটেনি। তবুও আজ ঝাঁকে ঝাঁকে মরছে তারাও। এই ভয়ংকর মৃত্যুর মিছিল সৃষ্টি করেছে ইয়াহিয়া খা। সেই ভয়াবহ মৃত্যুর কথা এবং তার শ্ৰষ্ঠা সেই শয়তানের কথা না বলে শুধু অবাঙালীর মৃত্যুর কথা যারা বলে, তারা ইয়াহিয়ারই তল্পিবাহক। ইয়াহিয়ার জন্য রাজনৈতিক পুঁজি সংগ্রহ করাই তাদের মতলব। কিন্তু তাদের উদ্দেশ্য সিদ্ধ হবার নয়। বাঙলাদেশে বাঙালী- অবাঙালী এবং হিন্দু-মুসলমানের মৃত্যুকে একসঙ্গেই হবে। তার উপায় হল ইয়াহিয়াকে বন্দী করা। নতুবা ভাগ ভাগ করে কোন মৃত্যুকেই প্রতিরােধ করা যাবে না আর এই রক্তস্নাত যখন স্থিত হবে, তখন সেখানে বাঙালী-অবাঙালী এবং হিন্দু-মুসলমান সকলে হবে ভাই-ভাই।
অন্ধ রাজনীতির ক্রুর সেনাপতি হল ইয়াহিয়া খা। বাঙালী- অবাঙালী গৃহযুদ্ধ লাগিয়ে ইয়াহিয়া প্রথম সােপান তৈরি করেছিল হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা ও ভ্রাতৃযুদ্ধের উস্কানী দেওয়া এবং সেই বীভৎসার মধ্যেই কার্যোদ্ধার করা। বাঙলাদেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধে সম্প্রতি জঙ্গী শাসকেরা হিন্দু- বিতাড়নকে প্রাধান্য দিয়েছে। এখন ভারতে আগন্তক শরণার্থীদের অধিকাংশ হিন্দু এবং তারা হিন্দু-নির্যাতনের কাহিনীগুলি নিয়ে আসছে। ৯ জুন পত্রিকার সংবাদে দেখা যায় যে, নদীয়ায় আগের দিন প্রবেশকারী ৫ হাজার শরণার্থীর মধ্যে ৮ শত মুসলমান এবং বাকীরা হিন্দু। প্রথমদিকে মুসলমান শরণার্থীদের সংখ্যা বেশি হত। কারণ প্রথম পর্যায়ে ইয়াহিয়া রাজনৈতিক নেতা ও কর্মীদের নিশ্চিহ্ন করার জন্যই মনােনিবেশ করেছিল। যুব ও ছাত্ররাই ছিল প্রথমদিকে আক্রমণের মুখ্য লক্ষ্য তার ফলে প্রথমদিকে তারাই এসেছিল ঝাঁকে ঝাঁকে। সম্প্রতি হিন্দুশরণার্থীর সংখ্যাধিক্য দেখিয়ে ভারতের সাম্প্রদায়িক শক্তিরা হিন্দুদেরই সর্বনাশ ঘটল বলে আর এক মড়াকান্না শুরু করেছে। বলাইবাহুল্য যে অবাঙালীর দুর্দিন বলে ইয়াহিয়ার প্রচারকেরা যে-কাজ হাসিল করতে চেয়েছিল, হিন্দুর দুর্দিনের প্রচারকেরা তাদেরই জাত ভাই। শরণার্থীদের একাংশও বলা শুরু করেছে। আর পাকিস্তানে নয়, এবার ভারতেই পুনর্বাসন চাই।’
মুক্তিযুদ্ধ মুসলমান তরুণেরা শুরু করেছে। আজও তারা মুক্তির জন্য প্রাণ ঢালছে। মুক্ত বাঙলাতে ছাড়া তাদের দাঁড়াবার কোন ভূমি নেই। ঐ মুক্তিযােদ্ধা ছাত্রদের বাবা এপারে মা ওপারে, আর সে নিজে এপার-ওপার করে। ঐসব যুবা নিজে এপারে তার প্রেয়সী ওপারে। এপার-ওপার মিলিয়ে তাদের মুক্তি যুদ্ধের প্রাঙ্গন। কি জন্য ওরা লড়ছে? গণতন্ত্রের জন্য মুসলমান ছাত্র-যুবরা প্রাণ দিচ্ছে। কি জন্য ওরা মরছে? ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র গঠনের জন্য ওদের আত্মদান। সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ শুরু করার আগের মিটিং মিছিল এবং অসহযােগ সগ্রামের মধ্য দিয়েই বাংলাদেশের মুক্তির সৈনিকরা নিজেদের গণতান্ত্রিক ও ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের ভিত তৈরি করেছিল। সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের আগেই পূর্ববাঙলা থেকে সাম্প্রদায়িকতা ধুয়ে মুছে শেষ হয়ে গিয়েছিল। বাঙলাদেশ গর্ভভরেই বলতে শুরু করেছিল যে, ভারত-উপমহাদেশের মধ্যে বাঙলাদেশেই হ’ল প্রথম দ্বীপ যেখানে হিন্দু-মুসলমান বিরােধ ও সংঘর্ষের অন্ধকার যুগ অস্তমিত হল।
বাঙলাদেশের সেই গণতান্ত্রিক ও ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রকে স্থায়ীভাবে সুপ্রতিষ্ঠার জন্য বাঙলার ছেলেরা যখন আরও প্রাণ এবং আরও রক্ত ঢালছে, তখনই পিছনে হতে সাম্প্রদায়িকতাবাদীদের এই খল প্রচার যে, কে বেশি ক্ষগ্রিস্থ হচ্ছেন? ওরা হিন্দু না মুসলমান প্রকৃতপক্ষে শহীদ বাঙলা দেশের প্রতি চরম অপমান এবং তাদের সংগ্রামের প্রতি চূড়ান্ত বিশ্বাসঘাতকতারই পরিচয়।
বাঙলাদেশের সংগ্রামে ভারত সর্বপ্রকার সাহায্য দিতে প্রতিশ্রুত। ভারতের পার্লামেন্টের সর্বসম্মত প্রস্তাব ভারতের মর্মবাণীকে প্রকাশ করেছিল। তবু ভারতের বুকেই আজ সাম্প্রদায়িকতাবাদীদের যে প্রচার শহীদ বাঙলাদেশকে অপমানিত করে। কিংবা তাদের সগ্রামকে দুর্বল করে, গােটা ভারত আজ ঐ সব শয়তানের কণ্ঠ ডুবিয়ে দেবে।
বাঙলাদেশের স্বাধীনতা সম্পর্কে সন্দিহান কিছু শরণার্থী ভারতে পুনর্বাসনের চিন্তা করে সেকথা ঠিক। ভারতের কর্তব্য হল ঐসব শরণার্থীর দুর্বল চিন্তাকে ভাঙ্গা। ভারতের কর্তব্য হল একথাই বােঝানাে যে, শরণার্থীদের স্বদেশে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করেই ভারত তার কর্তব্য পালন করবে। ভারতের সব দল ও সব মানুষ দুর্বলচিত্তদের এই ভরসাই দেবে যে, বাঙলাদেশ ও ভারত উভয়ের সম্মিলনে যে-মুক্তির সগ্রাম, কিছুতেই তাঁর পরাজয় নেই। ভারতের সব ব্যক্তি ও সব দল সকলকে এই শিক্ষাই দেবে যে, বাঙলাদেশে যদি বাঙালী হিন্দুরা না ফেরে তবে বাঙলাদেশের গণতান্ত্রিক শক্তিসমূহ এবং ছাত্র ও যুবরা স্বাধীন সার্বভৌম ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠার যে সংগ্রাম করছে সেই রাষ্ট্রের মর্মবাণীর মর্মটাই হারিয়ে যায়। শরণার্থীদের মধ্যে এই রাজনৈতিক প্রচারই আজ প্রধান হয়ে উঠবে যে, ভারতে তাদের পুনর্বাসন অর্থ হল ইয়াহিয়া খাকে সুখী করা- বর্বরতাকেই পথ ছেড়ে দেওয়া। মৃত্যুর কাছে ঐরূপ আত্মসমর্পণ নিষ্প্রয়ােজন। কারণ বাঙলাদেশ জিতবে।
সূত্র: কালান্তর, ১৪.৬.১৯৭১