খুনের সাহায্যে খুনীর অস্ত্র
পাক জঙ্গীশাহীর দাপটে যখন বাঙলাদেশে ত্রাহি ত্রাহি ডাক, লক্ষ লক্ষ নরবলি, অর্ধ কোটিরও অধিক নরনারী স্বদেশ থেকে বিতাড়িত তখনাে তার প্রতি অস্ত্ৰকৃপা বর্ষণে মার্কিন শস্ত্রপাণিদের হস্ত উদার। সুন্দরবন’ নামে একটি পাকিস্তানী জাহাজ মার্কিন মারণাস্ত্র বক্ষে ধারণ করে ৮ মে নিউইয়র্ক বন্দর ত্যাগ করে। এতক্ষণে জাহাজটি হয়তাে করাচী বন্দরে পৌছে নােঙর গেড়েছে। দ্বিতীয় কিস্তি আসবে পাকিস্তানের ‘পদ্মা’ জাহাজে। আগস্টের মাঝামাঝি সেটির করাচী পৌছবার কথা। দ্বিতীয়টিতে আসবে ৮টি বিমান, বেশ কিছু পরিমাণ প্যারাশুট, টন টন বিমান ও ট্রাকের অতিরিক্ত যন্ত্রাংশ ইত্যাদি।
খবরটি অবিশ্বাস করার কারণ নেই। আমেরিকারই নিউইয়র্ক টাইমস’ দিয়েছে এই খবর। এগুলাে নাকি মার্কিন উদ্ধৃত্ত অস্ত্রের গুদাম থেকে দেয়া হয়েছে এবং মার্কিন বিমানবাহিনী পাকিস্তানের কাছে বেচেছে এই অস্ত্র। খবরটা ফাঁস হয়ে যাওয়ায় মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের পক্ষ থেকে সাফাই গাওয়া হয়েছে এই বলে যে, অস্ত্র বােঝাই দুটো জাহাজ ফসকে বেরিয়ে গেলেও কেউ যেন মনে না করে, পাকিস্তানে অস্ত্র না পাঠাবার সংকল্প থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সরে দাঁড়িয়েছে। গত ২৫ মার্চের পরে পাকিস্তানকে অস্ত্র সাহায্য না করার সিদ্ধান্ত ঠিকই আছে এবং সেই সিদ্ধান্তের বাইরে কোন কাজ করা হয়নি। পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র সেখানেই থামেন নি; শাক দিয়ে মাছ ঢাকার আরাে চেষ্টা করেছেন। তিনি বলেছেন, বিদেশ থেকে অস্ত্র কেনার অধিকার প্রত্যেক দেশেরই আছে এবং তাতে কারাে কিছু বলার নেই।
এ যেন নিজের হাতে অন্যের গাঁজা টিপে খেয়ে যাওয়ার মত অবিশ্বাস্য কৈফিয়ৎ। মার্কিন বিমানবাহিনী কি মার্কিন সরকারের আওতা বহির্ভূত একটি স্বয়ম্ভু প্রতিষ্ঠান যে সরকারের অনুমতি ব্যতীতই বিদেশের কাছে সে অস্ত্র বেচে বসল? আর কিনা সে অস্ত্র বেচা হল জলের দরে। সরকারের অনুমােদন ছাড়া অস্ত্র ও সমরসম্ভার বােঝাই করে জাহাজ বন্দরই বা ছাড়ে কেমন করে? আর উদ্ধৃত্ত অস্ত্র গুদামের মাল? উদ্ধৃত্ত হলেও অস্ত্রগুলােতে নিশ্চয়ই মরচে ধরে যায় নি। পাকিস্তান ছাড়া সেগুলাের সদ্ব্যবহার আর কোথায় হতে পারে। অতএব বাঙলাদেশের উদ্ধৃত্ত মানুষগুলাের ভবলীলা সঙ্গী করার জন্য মার্কিন উদ্ধৃত্ত অস্ত্র পাক জঙ্গী সর্দার ইয়াহিয়া খানেরই প্রাপ্য। গুদামে পড়ে থেকে মরচে ধরার চেয়ে রক্তের স্বাদ পেলে অস্ত্রগুলােও তৃপ্ত হবে।।
বাঙলাদেশে গণহত্যা শুরু হবার পর কবে যে মার্কিন শাসকরা পাকিস্তানকে অস্ত্রসাহায্য না করার সরকারী সিদ্ধান্ত করলেন, কারাে তা জানা নেই। তাদের মুখপাত্ররা অনেক উল্টাপাল্টা কথাই বলে থাকেন। সকালের কথা বিকেলে বাসি হয়। খবর যারা রাখেন তাঁরা জানেন যে, ২৫ মার্চের পর থেকে এ যাবত মার্কিন অস্ত্র দাক্ষিণ্য থেকে পাকিস্তান কোন সময়েই বঞ্চিত হয় নি। ধরা পড়ে সমালােচনার সম্মুখীন হলে আমেরিকার পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্ররা অমনি গেয়ে উঠেন-না না, এগুলাে পুরনাে চুক্তির প্রাপ্য অস্ত্র-পাকিস্তানকে অস্ত্র সাহায্যের নতুন কোন চুক্তি হয় নি।
ঠাণ্ডা লড়াই শুরু হবার পর থেকেই পাকিস্তানকে সিয়াটো-সেন্টো চুক্তির অন্তর্ভূক্ত করে আমেরিকা তাকে সামরিক জোটে টেনে নেয় এবং মারণাস্ত্র যােগাতে থাকে। সেই অস্ত্রবলেই ১৯৬৫ সালে পাক জঙ্গীবাদীরা ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে সাহসী হয়। সেদিন মার্কিন প্যাটন ট্যাঙ্ক ও স্যাবর জেট বিমানই ছিল তাদের প্রধান হাতিয়ার। এবারও বাঙলাদেশে পাকিস্তানী জল্লাদরা সেই মার্কিন প্যাটন ট্যাঙ্ক নিয়েই নিরস্ত্র বাঙালী জাতির বুকের পাঁজর গুড়িয়ে দিতে হা-রে-রে করে বেরিয়ে পড়ে। ভিয়েতনামে নৃশংস যুদ্ধ চালিয়ে যেসব মার্কিন বীরপুঙ্গব কীর্তি অর্জন করেছে তারা অস্ত্রের সদ্ব্যবহারের জন্য এমন যােগ্য পাত্র ও স্থানই তাে খুঁজে বেড়াবে।
গণতন্ত্র ও স্বাধীনতার জন্য বাঙলাদেশে আজ যারা জীবনপণ করে লড়ছেন তারা এ থেকে শিক্ষা নেবেন নিশ্চয়ই। তাদের মধ্যে সামান্য কোন অংশেরও যদি মার্কিন কর্তাদের সম্বন্ধে বিন্দুমাত্র দুবর্লতাও থেকে থাকে তবে বাঙলাদেশের পরম শত্রু নরঘাতকই ইয়াহিয়া খানকে দু-জাহাজ অস্ত্র খয়রাতি করার পরে নিশ্চয়ই তারা সেই দুর্বলতা থেকে মুক্ত হবেন। মনে রাখতে হবে খুনীরা খুনীকেই সাহায্য করে। খুনীদের সম্বন্ধে মােহ থাকার কারণ নেই।
সূত্র: কালান্তর, ২৪.৬.১৯৭১