অবিলম্বে স্বাধীন বাংলার স্বীকৃতি চাই
সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে পাকিস্তানে রক্তক্ষয়ী লড়াই-এর মধ্যে এক নতুন ইতিহাস রচনা হচ্ছে। সেই ইতিহাস হচ্ছে এক নতুন রাষ্ট্রের জন্ম, যে রাষ্ট্রের ভিত্তি হচ্ছে গণতন্ত্রের বিকাশ এবং শ্রমিক, কৃষক, মধ্যবিত্ত তথা বিপ্লবী জাতীয়তাবাদ। রক্তক্ষরণের মধ্যে যে রাষ্ট্র জন্ম নিয়েছে, সেই রাষ্ট্রের নাম স্বাধীন বাংলা প্রজাতন্ত্র। যে মাউন্টবাটন রােয়েদাদ বাংলাকে খণ্ডিত করেছে, বাঙালী জাতিকে দ্বিধাবিভক্ত করেছে এবং পূর্বপ্রান্তে সেই খণ্ডিত বাংলা ও বাঙালীকে ইসলামাবাদের সামরিক শাসন বার বার বিশ্বাসঘাতকতার পর নরহত্যা ও আধুনিক মারণাস্ত্র দ্বারা দমনপীড়ন করছে, সেই সাম্রাজ্যবাদী রােয়েদাদ ও সামরিক একনায়কত্ব স্বাধীন বাংলার সংগ্রামী মানুষের চরম আঘাতে লণ্ডভণ্ড ও বিপর্যস্ত। একটা নতুন রাষ্ট্রের যখন জন্ম হয় তখন চরম বেদনা, অভূতপূর্ব সাহস ও আত্মত্যাগ এবং জাগ্রত জনসাধারণের সংগ্রাম তরঙ্গশীর্ষে ওঠে। স্বাধীন বাংলার সংগ্রামী মানুষের ঐক্য অভূতপূর্ব, সংগ্রামে বীরত্বের নানা কাহিনীতে সমৃদ্ধ, জাতিসত্তার চেতনায় উদ্বুদ্ধ ও সংগঠিত। এ কারণেই ক্রুরতম জঙ্গী নৃশংসতার মােকাবিলা করে বাংলাদেশের মানুষ চরম ত্যাগ স্বীকার করে স্বাধীনতা ও গণতন্ত্র রক্ষার জন্য বীরত্বপূর্ণ সংগ্রাম চালাচ্ছেন। ওপারের বাংলায় যে বিপ্লব সংগঠিত হচ্ছে সেই বিপ্লব কেবল সেখানকার মানুষের জীবনে নতুনত্ব সৃষ্টি করছে না, তার উত্তাল তরঙ্গ এপারে বাংলা ও সমস্ত ভারতবাসীকে এক নবজীবনের আবির্ভাবে উত্তাল করে তুলেছে। তাই ভারতের লােকসভা ও রাজ্যসভা ওপারের বাংলার যুদ্ধরত মানুষের সঙ্গে সংহতি জ্ঞাপন করেছে। কেবল তা নয়, দেশ-বিদেশের মানুষ ওপারের বাংলার নবজীবনের সংগ্রাম ও লড়াইকে অভিনন্দন জানাচ্ছে।
এই কারণেই অবিলম্বে স্বাধীন বাংলা দেশকে স্বীকৃতি দানের প্রশ্ন অপ্রতিরােধ্য হয়ে উঠেছে। শেখ মুজিবর রহমানের নেতৃত্বাধীন সরকার শুধুমাত্র বৈধ সরকার নয়, সারা দেশের সমস্ত মানুষের সমর্থনও সেই সরকারের পেছনে রয়েছে। তাছাড়া গত ডিসেম্বর মাসের নির্বাচনেও এ সরকার যে জনতার সুস্পষ্ট রায়ের অধিকারী হয়েছিলেন তা-ও সর্বজনবিদিত। কেউই ইতিহাসের এই গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাকে অস্বীকার করতে পারে না। ওপারের বাংলার মানুষ শান্তিপূর্ণ উপায়ে সংবিধান রচনা করতে চেয়েছিলেন এবং সরকার গঠনের দাবি করেছিলেন। কিন্তু সামরিক শাসনকর্তা জনসাধারণের রায়ের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করে তাদের বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ করেছে বলে বাংলার মানুষও বাধ্য হয়ে সশস্ত্র সংগ্রামের পথে অগ্রসর হয়ে বাংলার স্বাধীনতা ঘােষণা করেছেন। এই বিদ্রোহ অত্যন্ত ন্যায়সঙ্গত ও গণতন্ত্রসম্মত। অতএব যে সরকার জন্ম নিয়েছে সেই সরকার বৈধ ও গণতান্ত্রিক।
বাংলার মানুষ মৃত্যুভয় তুচ্ছ করে ও দৃঢ় সংকল্পে যে লড়াই চালাচ্ছেন তা এক অত্যাশ্চর্য ব্যাপার এবং প্রশংসার দাবি রাখে। স্বাধীন বাংলার শহীদের চরম ত্যাগ স্বীকার ও আত্মােৎসর্গের প্রতি ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি শ্রদ্ধা নিবেদন করে অবিলম্বে স্বাধীন বাংলার স্বীকতি দাবি করেছে।
স্বাধীন বাংলার স্বীকৃতি প্রতিক্রিয়াশীল সামরিক শাসন ও তাদের উপদেষ্টা সাম্রাজ্যবাদের চক্রান্তের বিরুদ্ধে স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের দুর্বার জয়যাত্রারই স্বীকৃতি। ভারত সরকারকেও এই স্বীকৃতি দানের দিকে দ্রুত অগ্রসর হতে হবে। আজ গণতন্ত্রকামী সাধারণ মানুষ ও পার্টি সমূহ গণতন্ত্র রক্ষার কাছে এক ঐতিহাসিক পরীক্ষার সম্মুখীন। কাল বিলম্ব না করে সকলকেই এই ন্যস্ত দায়িত্ব পালনে অগ্রসর হতে হবে। মনে রাখতে হবে যে বাংলাদেশের স্বার্থ ও আমাদের স্বার্থ এক ও অভিন্ন। আমরা বিশ্বাস করি, ওপার বাংলায় গণতন্ত্রের যে জয়যাত্রা শুরু হয়েছে, তা সফল হবেই।
সূত্র: কালান্তর, ২.৪.১৯৭১