You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.12.11 | দিল্লীতে এ সম্বর্ধনা আর কেউ পায় নি | আনন্দ বাজার পত্রিকা - সংগ্রামের নোটবুক

দিল্লীতে এ সম্বর্ধনা আর কেউ পায় নি

(দিল্লী অফিস থেকে)

 ১০ই জানুয়ারি- পাকিস্তানের অন্ধকার কারাগৃহে ন’মাসের অধিককাল যাপনের পর স্বাধীন, সার্বভৌম প্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান আজ সকালে লন্ডন থেকে ব্রিটিশ বিমান বাহিনীর একটি কমেট বিমানে এখানে এসে পৌঁছলে তাকে সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় বিপুল সম্বর্ধনা জানানাে হয়।

স্বাধীনতার পর গত ২৫ বৎসর বহু রাষ্ট্রপ্রধানকে সম্বর্ধনা জানানাে হয়েছে, কিন্তু এমনটি আর কখনও দেখা দেখা যায়নি এ যেন যুদ্ধজয়ের পর স্বদেশ প্রত্যাগত বীরের প্রতি সম্বর্ধনা। অভ্যর্থনার স্বতঃস্ফূর্ততা ও আন্তরিকতার জন্য আজকের দিনটি অবিস্মরণীয় নয় অথবা বাংলাদেশের স্বাধীনতা লাভ ও শেখ মুজিবের মুক্তি এই যুগল জয়ে, ভারত ও বাংলাদেশের সাড়ে ৬২ কোটি অধিবাসীর সম্মিলিত আনন্দোচ্ছাসের জন্যই আজকের দিনটি স্মরণীয় হয়ে থাকবে না। আজকের দিনটি স্মরণীয় হয়ে থাকবে কারণ বঙ্গবন্ধুর এই ঐতিহাসিক সফরের মধ্যে দিয়ে গণতন্ত্র ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্রের আদর্শের দৃঢ়ভিত্তির ওপর দুই প্রতিবেশী রাষ্ট্রের মধ্যে ঐক্য ও মৈত্রী সুপ্রতিষ্ঠিত হলাে।

সকাল ৮ টা ৬ মিনিটে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে ব্রিটিশ বিমানটি অবতরণ করা মাত্র ২১ বার তােপধ্বনি করে তাকে অভ্যর্থনা করা হয়। মুজিব বিমান থেকে বেরিয়ে এলে সমবেত জনতার ‘জয় বাংলা’ ধবনিতে আকাশ বাতাস মুখরিত হয়ে ওঠে। বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট হিসেবে শেখ মুজিবর রহমান সর্বপ্রথম ভারতে রাষ্ট্রীয় সফরে এলে রাষ্ট্রপতি শ্রীগিরি ও প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী গান্ধী তাঁকে স্বাগত জানান। রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী তাঁকে স্বাগত জানাবার পরে শেখ মুজিব অন্যান্য মন্ত্রী এবং সমবেত অন্যান্যদের সঙ্গে করমর্দন করেন। সম্বর্ধনা অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকার জন্য শ্রীতরুণকান্তি ঘােষ আজ সকালে দিল্লী পৌঁছান। শেখ মুজিবের সঙ্গে করমর্দনের সময়ে শ্রীতরুণকান্তি তার পিতা শ্রীতুষার কান্তি ঘােষের পক্ষ থেকে তাকে স্বাগত জানালে শেখ মুজিব আবেগ ভরে ওহাে’ করে ওঠেন।

 ‘ভারতের জনসাধারণ, সশস্ত্র বাহিনী ও ভারতীয় নেতারা যে সহানুভূতি ও অনুগ্রহ দেখিয়েছেন আমরা তা কখনাে ভুলবাে না।’

 আমি গত ৯ মাস পশ্চিম পাকিস্তানে বন্দী ছিলাম এবং আপনাদের মহীয়সী নেত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী আমার মুক্তির জন্য চেষ্টা করতে কিছু বাকী রাখেননি, তিনি এজন্য অনেক কষ্ট করেছেন।

মুজিব বলেন, এখন বাংলাদেশ মুক্ত কারাে প্রতি আমার ঘৃণা অথবা শত্রুতা নেই। এখন বাংলাদেশকে তৈরী করার জন্য বিশ্বের সকল স্বাধীনতা প্রিয় মানুষের সাহায্য ও সহানুভূতি আশা করি।

তিনি বলেন, বাংলাদেশ ধর্ম নিরপেক্ষতা, সমাজতন্ত্র ও গণতন্ত্রের ওপর দাঁড়িয়ে থাকবে।

জনসাধারণ প্রায়ই আমাকে প্রশ্ন করে থাকেন যে, তার নীতি ও শ্রীমতি গান্ধীর নীতির মধ্যে এতটা মতৈক্য ও সাদৃশ্য কেন।

এর উত্তর হল আদর্শ, দৃষ্টিভঙ্গী ও তাৎপর্যের পরিচয় আছে।

শেখ বলেন, দু’দিন আগেও তিনি পশ্চিম পাকিস্তানের অন্ধ কারাগারে বন্দী ছিলেন। তিনি জানতেন না, তিনি কখনাে তার দেশে ফিরে গিয়ে সেখানকার জনসাধারণের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে পারবেন কিনা।

এটা আপনাদের জন্য, আপনাদের সশস্ত্র বাহিনীর জন্য এবং আপনাদের প্রধানমন্ত্রীর জন্য আমার মুক্তিসম্ভব হয়েছে। আমি যখন আমার দেশে ফিরে যাবাে তখন ক’জন সহকর্মী ও বুদ্ধিজীবীকে দেখতে পাবাে তা আমি জানি না। আত্মসমর্পণের দুদিন আগে পশ্চিম পাকিস্তানীরা ঠাণ্ডা মাথায় বিপুল সংখ্যক বুদ্ধিজীবী ও বহু সহকর্মীকে হত্যা করেছে।

তিনি বলেন, এ রকম কাপুরুষােচিত ব্যবহার ও জঘন্যতম অন্যায় ইতিপূর্বে কোথাও সংঘটিত হয় নি।

জনগণের কাছ থেকে বিদায় নেবার পর তিনি ‘জয় বাংলা জয় হিন্দ’ ও ‘জয় ইন্দিরা গান্ধী বলে তাঁর ভাষণ শেষ করেন।

শ্ৰীমতী ইন্দিরা গান্ধীও মাইকের কাছে এসে শেখ মুজিবর রহমান জিন্দাবাদ’ বলেন।

জনগণও তার সঙ্গে উল্লাস জয়ধ্বনি করে ওঠেন। এবং কৌতূহলদ্দীপক বলে বর্ণনা করে জানান, “এই আলােচনায় আমি অখুশি হইনি।”

বিমানবন্দর থেকে রাষ্ট্রপতি ভবনে এসেই বঙ্গবন্ধু শ্রীমতি গান্ধীর সঙ্গে আলােচনা শুরু করেন। পরে তিনি রাষ্ট্রপতি গান্ধী ও অন্যান্য বিশিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে আলােক চিত্র গ্রহণের জন্য ভবন প্রাঙ্গণে এসে দাঁড়ান। এই সময় তিনি সাংবাদিকদের প্রশ্নেরও উত্তর দিতে থাকেন। তিনি বলেন, এই মুহূর্তে তার মন সেই সব হতভাগ্যদের জন্য পীড়িত ও আচ্ছন্ন হয়ে আছে যাদের ঠাণ্ডা মাথায় খান সেনারা হত্যা করেছে। তাদের আত্মার শান্তির জন্য তিনি প্রার্থনা করছেন।

আনন্দবাজার : ১১.১২.১৯৭১

Reference:

গণমাধ্যমে-বাংলাদেশের-মুক্তিযুদ্ধ – মুনতাসীর মামুন