You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.10.03 | ইয়াহিয়ার ব্যাপক গণহত্যায় বাঙলাদেশের মানুষ কম্পনাতীত | কালান্তর - সংগ্রামের নোটবুক

ইয়াহিয়ার ব্যাপক গণহত্যায়
বাঙলাদেশের মানুষ কম্পনাতীত
সর্বনাশের কবলগ্রস্ত
বিশ্ব শান্তি-সংসদের চার নেতার বিবৃতি

কলকাতা, ২ অক্টোবর (সংবাদদাতা) -বিশ্ব শান্তি-সংসদের পক্ষ থেকে বাঙলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম ও শরণার্থী-সমস্যার নানাদিক সম্পর্কে অবহিত হবার জন্য জন্য সম্প্রতি ভেনেজুয়েলার আইন-সভার সদস্য ডা. এ ফ্যারাকো, ফরাসী শান্তি-আন্দোলনের নেতা অধ্যাপক জলি, মালাগাসির আইন-সভার সদস্য এম এ র্যাটুসিফেরা এবং সিরিয়া শান্তিসংসদের সাধারণ সম্পাদক এম-কুয়াতাল পশ্চিমবঙ্গ সফর করে নিম্নলিখিত বিবৃতি প্রচার করেছেন।
সারা ভারত শান্তি-সংসদ এবং আফ্রোশীয় মৈত্রী সমিতিরি আমন্ত্রণে আমরা সেপ্টেম্বরের শেষদিকে পনের দিন ধরে ভারত সফর করেছি। এই সফরের উদ্দেশ্য ছিল বাঙলাদেশে যে হত্যাকাণ্ড চলেছে তার সম্পর্কে অব্যাহত হওয়া ও সেখানকার বাস্তব অবস্থা সংক্রান্ত তথ্য সংগ্রহ করা।
আমরা কলকাতা ও উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন শরণার্থী শিবির ঘুরে দেখেছি। এর ফলে সারা বাঙলাদেশের মানুষ যে কল্পনাতীত সর্বনাশের কবলগ্রস্ত হয়েছেন তার সঠিক পরিমাপ করা আমাদের পক্ষে সম্ভব হয়েছে। যে লক্ষ লক্ষ মানুষ এখন এই সব শিবিরে রয়েছেন, তাঁরা পাকিস্তানী বাহিনীর ব্যাপক গণহত্যা, অগ্নিসংযােগ ও ধ্বংসকাণ্ডের সন্ত্রাসে বিপর্যস্ত জনগণের শুধু এক ক্ষুদ্রাংশেরই প্রতিনিধিত্ব করছেন। এঁরা এই সব অত্যাচারের শিকার এবং সাক্ষী।
বয়স, শ্রেণী ও ধর্মনিবিশেষে শরণার্থীরা মানব মর্যাদার পক্ষে অপমানজনক যে অবস্থায় দিনযাপন করছেন, তা কোন মানুষের পক্ষেই সহ্য করা সম্ভব নয়। যে সব শরণার্থীকে প্রশ্ন করেছি, তারা সকলেই জবাব দিয়েছেন যে একমাত্র দেশ স্বাধীন হলেই তারা স্বদেশে ফিরে যেতে ইচ্ছুক। তাঁদের মতে বাঙলাদেশে শান্তি প্রতিষ্ঠার এ ছাড়া অন্য পথ নেই।
এদের উচ্চ মনােবল, বর্তমান অবস্থা দূর করার ব্যাপারে আগ্রহ, স্বাধীনতা ও আইন সংগত অধিকার প্রতিষ্ঠা সম্পর্কে আশাবাদী মনােভাবে আমরা বাস্তবিকই খুব প্রভাবিত হয়েছি। আমাদের মনে হয়েছে, এই মহান উচ্চাশা অবস্থা দূর করার ব্যাপারে আগ্রহ, স্বাধীনতা ও আইন সংগত অধিকার প্রতিষ্ঠা সম্পর্কে আশীবাদ, মনােভাবে আমরা বাস্তবিকই খুব প্রভাবিত হয়েছি। আমাদের মনে হয়েছে, এই মহান উচ্চাশা এবং দৃঢ়তা ভবিষ্যতের পক্ষে এক প্রধান নিশ্চয়তা।
এই শরণার্থীদের অভ্যর্থনার ব্যাপারে ভারতের জনগণ ও সরকার যে বিপুল প্রয়াস করছেন তাও আমরা লক্ষ্য করেছি। পৃথিবীর অন্য কোন জাতি হয়ত এই বিরাট সমস্যার মুখােমুখি হতে চাইত না। শরণার্থীদের সাহায্যকল্পে স্বেচ্ছায় অগ্রণী ভারতীয় নাগরিকগণ মানবসমাজের সামনে এক আদর্শ স্থাপন করেছেন। এই জন্য সারা পৃথিবীর শ্রদ্ধা তাঁদের প্রাপ্য।
বাঙলাদেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠনের নেতৃবৃন্দের সঙ্গেও আমরা দেখা করেছি। আলােচনার মাধ্যমে পাকিস্তানী বাহিনীর ব্যাপক গণহত্যা এবং বাংলাদেশের জনগণের বিরােচিত প্রতিরােধ সম্পর্কে বেশ কিছু মূল্যবান তথ্যসংগ্রহ করেছি আমরা। এঁদের সকলেই বলেছেন যে বাঙলাদেশের স্বাধীনতা ঘােষণাই সেখানকার জনগণের মুক্তি এবং গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার একমাত্র পথ।
আমরা যে যার দেশে ফিরে যাবার সময় সঙ্গে নিয়ে যাচ্ছি এমন সত্য তথ্য, যা আমাদের বিভিন্ন জাতিকে এই সংগ্রামের প্রকৃত অর্থ উপলব্ধিতে সাহায্য করবে। শরণার্থী সম্পর্কিত যাবতীয় সমস্যার বিষয়ে জনমত সৃষ্টির কাজে আমরা যথাসাধ্য চেষ্টা করব, যাতে এই সমস্যা শুধু ভারত সরকারের নয়, সারা পৃথিবীর দায়িত্ব বলে গণ্য হতে পারে। আমরা এ সত্যও ব্যাখ্যা করব যে শরণার্থী-সমস্যা শুধু মানবতার প্রশ্ন নয়, জাতির নিরাপত্তা ও অধিকার প্রতিষ্ঠার প্রশ্নের সঙ্গেও জড়িত।

সূত্র: কালান্তর, ৩.১০.১৯৭১