You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.06.14 | পাক-সামরিক চক্রের ভেঙে পড়া অর্থনীতিকে ঠেকা দেবেন না- বাঙলাদেশের প্রধানমন্ত্রী | কালান্তর - সংগ্রামের নোটবুক

পাক-সামরিক চক্রের ভেঙে পড়া অর্থনীতিকে ঠেকা দেবেন না
বিশ্বের শক্তিবর্গের কাছে বাঙলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর বেতার আবেদন

মুজিবনগর, ১৩ জুন বাঙলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী জনাব তাজউদ্দিন আহমদ আজ রাত্রে স্বাধীন বাঙলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত এক ভাষণে বৃহৎশক্তি বর্গের কাছে আবেদন জানান যে, তারা যেন কখনই “বাঙলাদেশের মাটি থেকে সৈন্যবাহিনী প্রত্যাহার না করে নেওয়া পর্যন্ত পাকিস্তান সামরিক চক্রের ভেঙে পড়া অর্থনৈতিক বুনিয়াদকে ঠেকা দিয়ে খাড়া করার চেষ্টা না করেন।”
অবিলম্বে স্বাধীন বাঙলাদেশ প্রজাতন্ত্রকে স্বীকৃত দেবার জন্য ও মুক্তিযােদ্ধাদের অস্ত্র দিয়ে সাহায্য করার জন্য তিনি বিশ্ববাসীদের কাছে আবেদন জানান। জনাব তাজউদ্দীন আহমদ বিশ্বের সমস্ত দেশের কাছে “বাঙলাদেশের জনগণের অপ্রতিদ্বন্দ্বিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের নিরাপত্তা ও মুক্তির জন্য উদ্যোগী হতে আবেদন জানান। পাকিস্তান সামরিক তন্ত্রের রাষ্ট্রপতি ইয়াহিয়া খাঁর সেনাদলের বীভৎস অত্যাচার থেকে প্রাণরক্ষার জন্য বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী ভারত সরকারের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানান।
জনাব তাজউদ্দীন বলেন, পাক-সামরিক জুন্টার প্রতি যে সব শক্তি সাহায্য দিচ্ছেন, “তার যেন একথা মনে রাখেন যে, তাদের দেওয়া সাহায্য নিয়ে পাক যুদ্ধাস্ত্র আজ বাঙলাদেশের মানুষকে খতম করায় ইসলামবাদকে শক্তিশালীই করছে। এই ধরনের সাহায্যে দিয়ে ইসলামবাদে “পুজিবাদী প্রতিক্রিয়াশীল সামারিক শােষক চক্রের স্বৈরাচারকে জিইয়ে রাখায় সাহায্য করা হচ্ছে বলে তিনি অভিযােগ করেন। তিনি বলেন যে, মার্কিন জনগণ এখন নিজেরাই নিশ্চয় বুঝতে পারছেন যে, পাকিস্তানকে তাদের দেশ যে সামরিক ঐ অর্থনৈতিক সাহায্য দিয়ে এসেছে, তার ফলেই পাক জঙ্গীচক্র আজ বাঙলাদেশে এই নারকীয় বর্বরতা চালাতে পারছে।
জনাব তাজউদ্দীন মধ্যপ্রাচ্যের আরব ও মুসলিম দেশগুলির ভ্রাতৃবর্গের প্রতি এক বিশেষ… পাক সরকারের গণহত্যার নিন্দা করতে এগিয়ে আসতে পারলেন না। এটা তাদের পক্ষে ভাবা খুবই মর্মান্তিক ও ভুল হচ্ছে যে, ইয়াহিয়া খাঁ বুঝি বাঙলাদেশে এক এক “ঐশ্লামিক ন্যায়ের যুদ্ধ চালাচ্ছে। জেনারেল ইয়াহিয়া খাঁ যা করছে তা আসলে “ইসলামের নামে জনগণের ন্যায় সমস্ত অধিকার ও মানবিক অধিকারের নির্মমভাবে দলন। আরব ও মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম দেশগুলির এই নীরবতা তাই উপনিবেশবাদ ও বর্বরতায় অপরাধকেই ক্ষমা করে যাওয়া হয়ে দাড়াচ্ছে। তিনি বলেন, “আরব দেশগুলির জনগণকে আমি এটা স্মরণ করতে বলি যে, তুর্কীর ঔপনিবেশিক শাসনের জন্য যে মুসলিম জনগণই একদিন সংগ্রাম করেছিল, সে সগ্রাম কি ছিল? পশ্চিম পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক শােষণের বিরুদ্ধে বাঙলাদেশের সগ্রামকে এই পরিপ্রেক্ষিতেই তাদের বােঝা উচিত।
বাঙলাদেশের মুক্তিযােদ্ধাদের বীরত্বপূর্ণ সংগ্রামের প্রতি অভিনন্দন জানিয়ে জনাব তাজউদ্দিন বলেন যে, এই ন্যায় সঙ্গত গণ সগ্রামকে “ভারতের দ্বারা প্ররােচিত” বলে রক্ত পিপাসু পাক জঙ্গীচক্র এক কুৎসার বন্যা বহাচ্ছে।
‘আমাদের সংগ্রাম এক ন্যায়ের সংগ্রাম, মাটিতে জন্মানাে গাছের মতই এই সংগ্রাম বাঙলাদেশের নিজস্ব। আমাদের সংগ্রাম অন্য কোন ভাষা-গােষ্ঠীর বিরুদ্ধে নয়। সিন্ধী, বেলুচ, পাঠান প্রভৃতি পাকিস্তানের অন্য যে সমস্ত জাতি পাক সামরিক চক্রের শােষণ শাসনের হেয় হয়ে তাদের তিনি বাঙলাদেশের মুক্তি সগ্রামের সমর্থনে ও “আমাদের সাধারণ শত্রু জঙ্গী শাসকদের বিরুদ্ধে জাগ্রত হতে আহ্বান করেন।
বাঙলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের এক নতুন অধ্যায় শুরু হয়েছে এই উল্লেখ করে তিনি বলেন যে, বাঙলাদেশের শরণার্থীরা অচিরেই তাদের স্বাধীন স্বদেশে ফিরে যেতে চান। মুক্তিযুদ্ধ সেই দিনটিকেই এগিয়ে আনছে।
আগত শরণার্থীদের প্রতি ভারত সরকারের সহানুভূতিশীল আচরণের জন্য কৃতজ্ঞতা জানিয়ে তিনি বলেন যে, জাতিসঙ্ঘের সেক্রেটারি জেনারেল উ-থান্টের আবেদনের পরও এই শরণার্থী সমস্যার বিরাটত্বের তুলনায় বিদেশ থেকে যতটা সাহায্য এসে পৌছােন উচিত ছিল, তা এখনও আসেনি এটা দুঃখের।
বাঙলাদেশ সরকারের পররাষ্ট্র মন্ত্রী খােন্দকার মুস্তাক আহমদ আজ সহসা কলকাতাস্থ বাঙলাদেশ মিশন পরিদর্শন করে যান। মিশনের কাজকর্ম সম্পর্কে আলােচনার পর তিনি সন্ধ্যায় মুজিবনগর প্রত্যাবর্তন করেন।

সূত্র: কালান্তর, ১৪.৬.১৯৭১