বাঙলাদেশকে নেপালের স্বীকৃতি দান
নয়াদিল্লী, ৬ জানুয়ারি (ইউ এন আই)-নেপাল আজ গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতি দিয়েছে।
নেপাল রাজের দূতাবাসের পথ থেকে স্বীকৃতিদানের সংবাদটি নয়াদিল্লীর বাঙলাদেশ মিশনকে জানানাে হয়েছে।
নেপাল সহ এপর্যন্ত পৃথিবীর আটটি রাষ্ট্র বাঙলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতি দিয়েছে। স্বীকৃতিদানের ক্ষেত্রে এশিয়ায় নেপালের স্থান চতুর্থ।
উল্লেখযােগ্য, গত ৬ ডিসেম্বর ভারতবর্ষ সর্বপ্রথম বাঙলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়, তারপর দিনই ভূটান। এশিয়ার অপর একটি রাষ্ট্র বার্মা গত ১৩ জানুয়ারি স্বীকৃতি দেয়।
নেপাল সরকারের পররাষ্ট্র দফতর জানান
নেপাল পাকিস্তানের সঙ্গে সু প্রতিবেশীর সম্পর্ক বজায় রাখতে চায়। তিনি আশা করেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের নেতৃত্বে বাঙলাদেশ আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে যথােপযুক্ত ভূমিকা পালন করবে এবং তার কষ্টার্জিত স্বাধীনতা রক্ষায় সমর্থ হবে।
বাঙলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর আনন্দ প্রকাশ
বাঙলাদেশকে নেপালের স্বীকৃতি দানের সংবাদ সম্পর্কে মন্তব্যকালে আজ বাঙলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবদুস সামাদ আজাদ বলেন, “আমাদের এ এক আনন্দের দিন। আনন্দের কারণ আমাদের সব প্রতিবেশীই বাঙলাদেশের বাস্তবতা উপলব্ধি করতে পেরেছেন।
মুজিব-পােপােভ আলােচনা
ঢাকা, ১৬ জানুয়ারি (ইউ এন আই) বাঙলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবর রহমানের সঙ্গে ঢাকার সােভিয়েত কনসাল জেনারেল পােপােভের প্রথম সরকারী বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। এই বৈঠকে সােভিয়েতবাঙলাদেশ সম্পর্কের সব দিক নিয়ে আলােচনা হয়।
দ্বিপাক্ষিক আলােচনা ৪৫ মিনিট চলে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবদুস সামাদ আজাদ বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন।
সভা শেষ হবার পর পররাষ্ট্রমন্ত্রী সামাদ পােপােভকে বলেন, শেখ মুজিব ও তিনি আলােচনায় অত্যন্ত খুশী হয়েছেন সােভিয়েত দূত পাল্টা অভিনন্দন জানান।
পরে শ্রী সামাদ বলেন, ভারত ও সােভিয়েত ইউনিয়ন স্বতঃপ্রণােদিত হয়ে আমাদের মুক্তিসংগ্রামে সহায়তা করেছেন।
স্বীকৃতিদানের এইতাে সময়
বাঙলাদেশের মুক্তিসংগ্রাম যতই সাফল্যের পথ অগ্রসর হচ্ছে, সংগ্রামী জনসাধারণ এবং তাদের বিভিন্ন রাজনৈতিক ও গণতান্ত্রিক সংস্থার ঐক্যও ততই দৃঢ়ভিত্তিক হয়ে উঠেছে। মুক্তিসংগ্রাম পরিচালিত করার জন্য বাঙলাদেশ সরকারের যুক্ত উপদেষ্টা কমিটি গঠিত হওয়ায় সেখানকার জনসাধারণ ও মুক্তিবাহিনীর মনােবল বহুল পরিমাণে বেড়েছে। বাঙলাদেশের দুটি মুখ্য ছাত্রসংস্থা ছাত্র ইউনিয়ন ও ছাত্রলীগ সর্বস্তরে যুক্ত-কমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এই দুটি ছাত্র সংস্থা ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র-সংসদের নেতৃবৃন্দ এক যুক্ত বিবৃতিতে যৌথকার্যক্রম গ্রহণের ঘােষণা করায় ছাত্র ও যুবসমাজে প্রভূত উৎসাহের সঞ্চার হয়েছে। পাকিস্তানের জন্মের পর থেকেই বাঙলাদেশের যাবতীয় গণতান্ত্রিক আন্দোলনে ছাত্রসমাজ সামনের সারিতে দাঁড়িয়ে বুক দিয়ে লড়ে আসছেন এবং বর্তমান মুক্তিসংগ্রামেরও পুরােভাগে দাঁড়িয়েই তারা লড়ছেন। সুতরাং তাদের ঐক্যবদ্ধ কার্যক্রম যে তরুণ সমাজ ও সাধারণ মানুষের মধ্যে উৎসাহ-উদ্দীপনা সৃষ্টি করবে, একথা বলাই বাহুল্য।
মুক্তিবাহিনী যখন বিভিন্ন এলাকায় মুক্তাঞ্চল সৃষ্টি করে চলেছে তখন শক্তির সংহতি ও বৃদ্ধির জন্যই ঐক্যের প্রয়ােজন আরাে বেশি। মেহেরপুর, চুয়াডাঙ্গা ও কুষ্টিয়া মহকুমার এক বিস্তীর্ণ অঞ্চল আজ মুক্ত এবং সেখানে অসামরিক শাসন প্রতিষ্ঠিত। অচিরেই এ ধরনের আরাে অনেক অঞ্চলই মুক্ত হবে বলে আশা করা যায়। মুক্তাঞ্চলগুলিকে সংগঠিত করার দায়িত্ব দ্বিবিধ। প্রথমতঃ সেখানে জনজীবনকে সুষ্ঠুভাবে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করতে হবে। জঙ্গী আক্রমণে যে আর্থিক বিপর্যয় ঘটেছে তা থেকে তাদের মুক্ত করার জন্য অর্থনীতিকে পুনর্বাসন ও নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করা দরকার। অসামরিক প্রশাসনকে এমনভাবে চালাতে হবে যা জনসাধারণ পাক-শাসন ও নতুন জনদরদী সরকারের পার্থক্য স্পষ্টভাবে হৃদয়ঙ্গম করতে পারে। দ্বিতীয়তঃ, এসব মুক্তাঞ্চলকে প্রতিরক্ষার দিক দিয়ে দুর্ভেদ্য দূর্গে পরিণত করা চাই। তার প্রাথমিক শর্ত মুক্তাঞ্চলবাসীদের অটুট মনােবল। মুক্তাঞ্চল সম্প্রসারণের এগুলােই হবে প্রধান ঘাঁটি। সুতরাং মুক্ত অঞ্চলগুলাের জনসাধারণ যাতে মুক্তি সংগ্রামকে সর্বতােভাবে সাহায্য করার উপযুক্ত হয়ে ওঠে তার জন্য অবিরাম চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে।
এসব কাজে একটা বড় ভূমিকা ছাত্রসমাজকে নিতে হবে। সুতরাং একদিকে যেমন সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ চালাবার দায়িত্ব, তেমনি আরেক দিকে অসামরিক প্রশাসনকে মুক্তি সংগ্রামের অনুকূল করে তােলাও গুরু কর্তব্য। একটির সঙ্গে অন্যটি অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। এই বিরাট দায়িত্ব পালন ঐক্যের দ্বারাই সম্ভব। বাঙলাদেশের সংগ্রামী রাজনৈতিক ও গণতান্ত্রিক সংস্থাগুলাের নেতারা এই দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন বলেই অপরিহার্য ঐক্যের পথে অগ্রসর হচ্ছেন। সংগ্রামের অভিজ্ঞতায় যে ঐক্য গড়ে উঠছে উত্তরােত্তর তা নিচ্ছিদ্র ও নিটোল হয়েই উঠবে।
শরণার্থীদের প্রত্যাবর্তনের একমাত্র সুনিশ্চিত স্থান বাঙলাদেশের মুক্তাঞ্চল। সুতরাং মুক্তাঞ্চলের আয়তন যত দ্রুত বাড়বে এবং তা যত বেশি নিরাপদ হবে, শরণার্থীদের প্রত্যাবর্তনের সম্ভাবনাও তত বেশী বৃদ্ধি পাবে। প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা বার বার বলছেন, নব্বই লক্ষাধিক শরণার্থীর চাপে ভারতের নিরাপত্তাও বিপন্ন হয়ে উঠেছে। সুতরাং ভারতের নিরাপত্তার জন্য অবিলম্বে বাঙলাদেশ সরকারকে নির্দ্বিধায় স্বীকৃতি দিবে তার হাত এমনভাবে শক্ত করা দরকার যাতে সে দ্রুত মুক্ত অঞ্চল সম্প্রসারিত করে শরণার্থীদের নিরাপদে ফিরিয়ে নেবার স্থান করতে পারে। শরণার্থীদের আবার বাঙলাদেশে পাঠাবার এটাই একমাত্র উপায়। এই অনুকূল অবস্থাকে কাজে লাগিয়ে কাঁধ থেকে শরণার্থীর বােঝা না নামালে ভারত-সরকার সব দিক দিয়ে দেশের অভ্যন্তর জীবনকেই আরাে বিপন্ন করে তুলবেন।
সূত্র: কালান্তর, ১৭.১২.১৯৭১