স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের জন্য কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দৃষ্টান্ত গড়ে তুলব
সংসদ কক্ষে প্রধানমন্ত্রীর বাঙলাদেশ সরকারের স্বীকৃতির ঘােষণাপত্র
[ সোমবার, ৬ ডিসেম্বর সংসদে বাঙলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতি দান করে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী এই ঐতিহাসিক ঘঘাষণাটি পাঠ করেন]
“প্রচণ্ড প্রতিকূলতা সত্বেও বাঙলাদেশের জনগণের নির্ভীক সংগ্রাম মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে বীরত্বের এক নব অধ্যায় উন্মোচিত করেছে।
“ইতােপূর্বেই, তারা তাদের নির্বাচনে একটা বিরাট গণতান্ত্রিক বিজয় চিহ্নিত করেছিল এবং এমন কি পাকিস্তানের প্রেসিডেন্টও শেখ মুজিবর রহমানের পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হবার অধিকার স্বীকার করেছিলেন।
“আমরা কোনদিনই জানতে পারব না, কি কারণে এই মহানুভবতা ও বাস্তব দৃষ্টিভঙ্গী (যদি সত্যিই থেকে থাকে) ছিল না ও প্রকাশ্য ঘৃণায় পরিণত হল।
“আমাদের বলা হল, শেখ মুজিবর রহমান এবং তাঁর দল আওয়ামী লীগ পশ্চিম পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে অহিংস প্রতিরােধ আন্দোলন গড়ে তােলার পরিকল্পনা করেছেন। তাঁদের হঠাৎ গ্রেপ্তার করা হল এবং নির্মম সামরিক জঙ্গী নিষ্পেষণে পিষ্ট করা হল। তাদের স্বাধীনতা ঘােষণা ভিন্ন অন্য কোন পথ ছিল না।
“পূর্ব পাকিস্তান রাইফেলস এবং পূর্ববঙ্গ রেজিমেন্ট মুক্তি ফৌজে পরিণত হল এবং অত:পর হাজার হাজার তরুণের যােগদানপুষ্ট মুক্তিবাহিনী স্বাধীনতা ও নিজেদের ভবিষ্যৎ নির্ধারণের অধিকারের জন্য জীবন বলিদানের শপথ গ্রহণ করল।
“ঐক্য, প্রতিজ্ঞা ও নির্ভীকতা, যার ওপর ভর করে বাঙলাদেশের সমগ্র জনসাধারণ লড়াই করছে, পৃথিবীর সমস্ত সংবাদপত্রে সেকথা উল্লেখিত হয়েছে।
“এসমস্ত ঘটনা আমাদের দোর গােড়ায় ঘটেছে এবং তার ফলে আমাদের সীমানায় শরণার্থী স্রোত আসছে—আমাদের দেশে যার ফল দূরপ্রসারী।
“স্বাভাবিক কারণেই তাদের ন্যায়যুদ্ধে আমাদের সহানুভূতি বাঙলাদেশের জনগণের ওপরই থাকা উচিত।
কিন্তু আমরা স্বীকৃতির ব্যাপারে তাড়াহুড়াে করিনি। আমাদের সিদ্ধান্তসমূহ শুধুমাত্র আবেগ দ্বারা চালিত হয় নি। বরং বর্তমান ও ভবিষ্যতের বাস্তব অবস্থাসমূহ বিবেচনা করেই এগিয়েছি।
বাঙলাদেশের সমগ্র জনগােষ্ঠীর সর্বসম্মত বিদ্রোহ এবং তার সাফল্যের সঙ্গে সঙ্গে একথা ক্রমাগত প্রতীয়মান হয়ে উঠেছে যে, তথাকথিত পাকিস্তান মাতৃভূমি বাঙলাদেশের জনগণের নিজ নিয়ন্ত্রণে আনতে সম্পূর্ণভাবে অক্ষম।
“বাঙলাদেশ সরকারের বৈধতা সম্পর্কে একটি কথাই যথেষ্ট, সমগ্র বিশ্ব নিশ্চয়ই এখানে অবহিত আছেন যে, এই সরকার জনগণের যতটা নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠের ইচ্ছা প্রতিফলিত করে বহু সরকারেরই ততটা প্রতিনিধিত্ব দাবি করার ক্ষমতা নেই।
“গভর্ণর মরিসের কাছে জেফারসনের সেই বিখ্যাত উক্তি—বাঙলাদেশ সরকারের পিছনে রয়েছে সমগ্র জাতির ইচ্ছা, খুব দৃঢ়ভাবেই যার প্রকাশ ঘটেছে। এই নীতি অনুসারে পাকিস্তানের সামরিক শাসকবর্গের পিছনে তাদের দেশের নগণ্য সংখ্যক লােকের সমর্থন রয়েছে। তবুও এখন পাকিস্তান ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালাচ্ছে। স্বাভাবিক কারণেই আমাদের কিছু দ্বিধা ছিল যে আমরা এমন কিছু করব না যা শান্তিপূর্ণ সমাধানের পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়, যা হস্তক্ষেপ বলে চিহ্নিত হয়। এখন সে দ্বিধার কোন মূল্য নেই।
“বাঙলাদেশের জনগণ তাদের অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই করছেন এবং ভারতের জনগণ আক্রমণকারীকে পরাস্ত করার লড়াই করছেন। তাই এখন উভয় দেশ সম কারণে লড়াই করছে।
“আমি আনন্দ সহকারে সংসদ কক্ষে একথা জানাতে চাই, বর্তমান অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে এবং বাঙলাদেশ সরকারের পুনঃপৌনিক অনুরােধে ভারত সরকার অনেক বিবেচনা শেষে গণপ্রজাতন্ত্রী বাঙলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতিদানের সিদ্ধান্ত করেছেন। আমাদের আশা আরাে কিছুকাল পর আরাে অনেক দেশ স্বীকৃতি দেবে এবং গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ অনতিবিলম্বে বিশ্বজাতি পরিবারভূক্ত হবে।
“এই মুহুর্তে আমরা ভাবছি এই নবীন রাষ্ট্রের জনক শেখ মুজিবর রহমানের কথা।
আমার দৃঢ় বিশ্বাস, আপনারা বাঙলাদেশের মহামান্য কার্যনির্বাহী রাষ্ট্রপতি এবং প্রধানমন্ত্রী ও তার সতীর্থদের উচ্চ অভিনন্দন জানাবার ভার আমাকে দেবেন।
“বাঙলাদেশ সরকার আমাদের কাছে যে-বার্তা পাঠিয়েছেন আমি সভা কক্ষের টেবিলে তার কপিগুলি রাখছি।
মাননীয় সদস্যরা জেনে খুশি হবেন যে, বাঙলাদেশ সরকার তাঁদের রাষ্ট্রনীতির বুনিয়াদী সূত্র হিসাবে ঘােষণা করেছেন, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা এবং ন্যায়নীতি ভিত্তিক সমাজ। যেখানে জাতি, ধর্ম বর্ণের কোন ভেদ থাকবে না।
“বাঙলাদেশ সরকার ঘােষণা করেছেন, পররাষ্ট্রনীতির সম্পর্কের ক্ষেত্রে তারা দৃঢ়ভাবে জোটনিরপেক্ষ ও শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান নীতি অনুসরণ করবেন এবং সর্বপ্রকারে উপনিবেশিকতা, বর্ণবিদ্বেষ ও সাম্রাজ্যবাদের বিরােধিতা করবেন।
এই আদর্শগুলির প্রতি ভারতও নিষ্ঠাবান।
বাঙলাদেশ সরকার বারংবার ঘােষণা করেছেন, আমাদের দেশে সাময়িকভাবে আশ্রিত তাদের নাগরিকদের যত তাড়াতাড়ি সম্ভব নিজ দেশে ফিরিয়ে নিতে এবং তাদের জায়গা-জমি ও বিষয় আসয় ফিরিয়ে দিতে বিশেষ উদ্বিগ্ন। আমরা স্বাভাবিক কারণেই এই সমস্ত ব্যবস্থায় তাদের সর্বতােভাবে সাহায্য করব।
“আমার দৃঢ় বিশ্বাস, উভয়ের সার্বভৌমত্ব, ভূমিগত অখণ্ডতা, অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ না করা, সমতা ও পারস্পরিক সুবিধা—এই নীতিগুলির প্রতি মর্যাদা দিয়ে ভবিষ্যতে এক দৃঢ় সম্পর্কের বন্ধনডাের গড়ে তুলবে। ভারত ও বাঙলাদেশের সরকার ও জনগণ যারা সাধারণ আদর্শ ও ত্যাগ তিতিক্ষার অংশীদার।
“স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের জন্য এক সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে চলে আমরা সুপ্রতিবেশীয় দৃষ্টান্ত গড়ে তুলব। আর এভাবেই এই অঞ্চলে শান্তি, স্থায়িত্ব ও অন্যান্য প্রগতি সুনিশ্চিত হবে।”
ধাপে ধাপে
* ২৫ মার্চ, ১৯৭১; প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার পাক-বাহিনী কর্তৃক বাঙলাদেশের জনগণের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক যুদ্ধ ঘােষণা।
* ১৭ এপ্রিল, ১৯৭১; মুজিব নগরে গণপ্রজাতন্ত্রী বাঙলাদেশের জন্ম; বাঙলাদেশের স্বাধীনতা সনদ ঘােষণা।
* ৯ আগস্ট ১৯৭১; বাঙলাদেশের মুক্তি সংগ্রামের রক্ষাকবচ ভারত-সােভিয়েত মৈত্রী চুক্তি স্বাক্ষরিত।
* ৪ ডিসেম্বর, ১৯৭১; ভারতের বিরুদ্ধে পাক সরকারের সর্বাত্মক যুদ্ধ ঘােষণা।
* ৬ ডিসেম্বর ১৯৭১; ভারত সরকার কর্তৃক গণপ্রজাতান্ত্রিক বাঙলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতি দান।
ভারত সরকার কর্তৃক আমাদের মুক্তিযুদ্ধে প্রত্যক্ষ সাহায্যদান ও বাঙলাদেশের রাজনৈতিক স্বীকৃতি আমাদের দেশবাসী ও মুক্তিযােদ্ধাদের মনে গভীর অনুপ্রেরণা ও উৎসাহ সৃষ্টি করেছে। বাঙলাদেশের মুক্তিসংগ্রাম ভারতের মহান অবদানের জন্য আমাদের দেশবাসী কৃতজ্ঞ।
“ভারত কর্তৃক বাঙলাদেশের স্বীকৃতির ফলে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের সহযােগী ও চীনের সাহায্যপুষ্ট পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে আমাদের মুক্তিবাহিনী ও ভারতের প্রতিরক্ষা বাহিনীর ন্যায্য লড়াই ঐক্যবদ্ধভাবে পরিচালিত হওয়ার ভিত্তি রচিত হলাে। সাধারণ শত্রুর বিরুদ্ধে এই সংগ্রামের মধ্য দিয়ে আমাদের দুইটি দেশ ও জাতির ভ্রাতৃত্ববন্ধন সুদৃঢ় হবে।
“আমাদের মুক্তিসংগ্রাম সাম্রাজ্যবাদ ও প্রতিক্রিয়ার বিরুদ্ধে বিশ্ববাসীর মুক্তি সংগ্রামেরই অঙ্গ। আমাদের মুক্তি সংগ্রাম ও ভারতের বিরুদ্ধে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদীদের ও চীন সরকারের তরফ থেকে হস্তক্ষেপের এবং সমগ্র ভারতীয় উপমহাদেশে ব্যাপক যুদ্ধের দাবানল ও অশান্তি সৃষ্টির যে চক্রান্ত চলছে, তাকে প্রতিহত করার জন্য আমরা বিশ্বের সকল সমাজতান্ত্রিক ও সাম্রাজ্যবাদ-বিরােধী শক্তির কাছে আহ্বান জানাচ্ছি। এই চক্রান্তকে প্রতিহত করার জন্য সমাজতান্ত্রিক সােভিয়েত ইউনিয়ন কর্তৃক জাতিসঙ্ঘে ভেটো প্রয়ােগ এবং সােভিয়েত ইউনিয়ন, পােল্যান্ড ও অন্যান্য সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র যে বলিষ্ঠ ভূমিকা গ্রহণ করেছে তাকে আমরা আন্তরিকভাবে অভিনন্দন জানাচ্ছি।
“বর্তমান অবস্থায় বাঙলাদেশ রাষ্ট্র ও সরকারকে অবিলম্বে সােভিয়েত ইউনিয়নসহ সকল সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র এবং সকল সাম্রাজ্যবাদ-বিরােধী দেশগুলির প্রতি আবেদন জানাচ্ছি।”
সূত্র: কালান্তর, ৭.১২.১৯৭১