You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.12.06 | ভারত গণপ্রজাতন্ত্রী বাঙলাদেশকে স্বীকৃতি দিল | কালান্তর - সংগ্রামের নোটবুক

ভারত গণপ্রজাতন্ত্রী বাঙলাদেশকে স্বীকৃতি দিল
(বিশেষ প্রতিনিধি)

সােমবার সকালে কয়েক মিনিটের অধিবেশন। আবেগ চঞ্চল লােকসভা সদস্যদের জয়বাংলা ধ্বনির মধ্যে প্রধানমন্ত্রীর কণ্ঠস্বর ডুবে গেল। ঐ দীর্ঘস্থায়ী হর্ষধ্বনির মাঝে ভেসে এল ভারত বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতি দিচ্ছে। শােনা গেল এখন থেকে ঐ সরকার বাংলাদেশ গণ-প্রজাতন্ত্রী সরকার নামে পরিচিত হবে। লক্ষ লক্ষ বাঙ্গালী নদী নদী রক্ত বইয়ে ইতােমধ্যে যে নতুন রাষ্ট্রের যে নতুন সরকার প্রতিষ্ঠা করেছেন এই ঘােষণা তার অস্তিত্বকে আন্তর্জাতিক দুনিয়ার প্রতিষ্ঠিত করল।

বিশ্বের রাষ্ট্রদরবারে আর একটি নতুন রাষ্ট্র
প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বললেন ভারত সরকার সযত্ন বিবেচনার পর বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতি দানের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। এই ঘােষণার সঙ্গে সঙ্গে সদস্যরা দাঁড়িয়ে ঘােষণাটিকে অভিনন্দন জানান।
প্রধানমন্ত্রী ঘােষণা করলেন এই সরকার বাংলাদেশ গণ-প্রজাতন্ত্রী নামে অভিহিত করা হবে। সদস্যরা জয়বাংলা ধ্বনি দিয়ে প্রধানমন্ত্রীর কণ্ঠস্বরকে ডুবিয়ে দেন। সভার অধ্যক্ষ জি এস ধীলনকে দেখা গেল টেবিল চাপড়িয়ে আনন্দ প্রকাশ করতে।
প্রধানমন্ত্রী বললেন, বাংলাদেশ সরকারের রাষ্ট্রপতি হবে গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র এবং ন্যায়নীতির প্রতিষ্ঠিত। তিনি জানালেন বাংলাদেশ সরকার ভারত সরকারকে জানাচ্ছেন এই সরকার ধর্ম, জাতি বা সম্প্রদায় নিরপেক্ষভাবে দেশ শাসন করবে। এই সরকার জোট নিরপেক্ষ নীতি অনুসরণ করবে। বাংলাদেশ সরকার শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান, ঔপনিবেশিকতাবাদ, বর্ণবিদ্বেষ এবং সাম্রাজ্যবাদ বিরােধী নীতি অনুসরণ করবে।
প্রধানমন্ত্রীর ঐতিহাসিক ঘােষণার পর বিভিন্ন দলের নেতারা একের পর এক উঠে দাঁড়িয়ে এই সিদ্ধান্ত কে স্বাগত জানালেন। এর পরই লােকসভার ও রাজসভার অধিবেশন মুলতবি হয়ে যায় এখন শুরু হয়েছে সারা দেশ জুড়ে জনতার সােচ্ছবান অভিনন্দন। খবর আসছে এই ঘােষণা জনতাকে উদ্বেল করেছে।
প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী আজ যখন বাঙলাদশকে ভারত কর্তৃক স্বীকৃতিদানের ঐতিহাসিক ঘােষণা করেন তখন সংসদে এক অভূতপূর্ণ উদ্দীপনা দেখা যায়। উভয়ই বিপুল উল্লাসে এই ঘােষণা অভিনন্দিত হয়। উল্লাসধ্বনি আর থামতে চায় না। সদস্যরা দাঁড়িয়ে উঠে ‘জয় বাঙলা’ ও ইন্দিরা গান্ধী জিন্দাবাদ’ ধ্বনিতে ধ্বনিতে সভাকক্ষ মুখরিত করে তােলেন।
লােকসভায় অধ্যক্ষ শ্রীধলিন জোরে টেবিল চাপড়ে সদস্যদের সঙ্গে উল্লাস প্রমাণ করেন। শ্রীমতী গান্ধী স্বীকৃতিদানের বাক্যটি শেষ করার আগেই সদস্যরা আনন্দে ফেটে পড়েন। রাজ্যসভায় সদস্যরা জয় বাঙলা ধ্বনির সঙ্গে সংগ্রামী জনতা জিন্দাবাদ’ এবং গণআন্দোলন দীর্ঘজীবী হােক ধ্বনিও যুক্ত করেন।
স্বীকৃতি দানের জন্য বাঙলাদেশ সরকারের নিকট থেকে অনুরােধ করে ভারত সরকারকে যেসব চিঠিপত্র লেখা হয় শ্রীমতী গান্ধী তার কয়েকটি সংসদে পেশ করেন। গত ২৫ মার্চ পাকিস্তানের সামরিক শাসকরা বাঙলাদেশে নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ড ও নৃশংসতা শুরু করার পর ২৬ মার্চ বাংলাদেশ সরকার গঠিত হয়। ইয়াহিয়া চক্র ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘােষণা করলে গত ৪ ডিসেম্বর বাংলাদেশ সরকারের কাছ থেকে শেষ চিঠিখানি পাওয়ার পর প্রধানমন্ত্রী তাঁর দেশের লােককে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন যে উপযুক্ত সময় এলেই ভারত সরকার বাঙলাদেশকে স্বীকৃতি দেবেন। তিনি তার সেই প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেছেন।
শ্রীমতী গান্ধী বলেছেন, এই নতুন সরকার গণপ্রজাতন্ত্রী বাঙলাদেশ রূপে অভিহিত হবে।
যে তিনটি মূল নীতির ওপর বাঙলাদেশ দাঁড়িয়ে থাকবে তা হলাে গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষ সমাজ স্থাপন। প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাঙলাদেশ সরকার তাঁকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন যে, তারা গােষ্ঠী নিরপেক্ষ, শান্তিপূর্ণ সহ অবস্থান এবং উপনিবেশবাদ, জাতিবৈষম্য ও সাম্রাজ্যবাদবিরােধী নীতি অনুসরণ করে চলবেন।

ঐতিহাসিক ঘােষণা
শ্ৰীমতী ইন্দিরা গান্ধীর ঐতিহাসিক ঘােষণার পূর্ণ বয়ান : প্রচণ্ড প্রতিকূলতা সত্বেও বাঙলাদেশকে জনগণের নির্ভীক সংগ্রাম মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে বীরত্বের এক নব অধ্যায় উন্মাচিত করেছে।
ইতােপূর্বেই, তাঁরা তাঁদের নির্বাচনে একটা বিরাট গণতান্ত্রিক বিজয় চিহ্নিত করেছিল এবং এমনকি পাকিস্তানের প্রেসিডেন্টও শেখ মুজিবর রহমানের পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হবার অধিকার স্বীকার করেছিলেন।
আমরা কোনদিনই জানতে পারব না কি কারণে এই মহানুভবতা ও বাস্তব দৃষ্টিভঙ্গী (যদি সত্যিই থেকে থাকে) ছলনা ও প্রকাশ্য ঘৃণায় পরিণত হল।
আমাদের বলা হল, শেখ মুজিবর রহমান এবং তাঁর দল আওয়ামী লীগ পশ্চিম পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে অহিংসা প্রতিরােধ আন্দোলন গড়ে তােলার পরিকল্পনা করেছে। তাঁদের হঠাৎ গ্রেপ্তার করা হল এবং নিরস্ত্র সামরিক জঙ্গী নিষ্পেষণে তাদের পিষ্ট করা হল। তাদের স্বাধীনতা ঘােষণা ভিন্ন অন্য কোন পথ ছিল।
পূর্ব পাকিস্তান রাইফেলস এবং পূর্ববঙ্গ রেজিমেন্ট মুক্তি ফৌজে পরিণত হল এবং অত:পর হাজার হাজার তরুণের যােগদানপুষ্ট মুক্তিবাহিনী স্বাধীন ও নিজেদের ভবিষ্যৎ নির্ধারণের অধিকারের জন্য জীবন বলিদানের শপথ গ্রহণ করল।

আবার সােভিয়েতের ভেটো
জাতিসংঘ, ৬ ডিসেম্বর, এপি -গত রাতে নিরাপত্তা পরিষদ মার্কিন প্রস্তাবেরই অনুরূপ আরেকটি প্রস্তাবকেও সােভিয়েত ইউনিয়ন ভেটো প্রয়োেগ করে নাকচ করে দেয়। এতেও ভারত ও পাকিস্তানকে অবিলম্বে যুদ্ধ বন্ধ করতে এবং সৈন্য বাহিনী সরিয়ে আনতে বলা হয়েছিল। প্রস্তাবটি পেশ করেছিল পরিষদের আটজন অস্থায়ী প্রতিনিধিরা।
এনিয়ে নিরাপত্তা পরিষদে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে সােভিয়েত ইউনিয়ন দুবার ভারত বিরােধী, বাংলাদেশ বিরােধী চক্রান্ত ব্যর্থ করল।
আগেকার প্রস্তাবের মতই পােল্যান্ড এ প্রস্তাবের বিরােধিতা করে। অন্যদিকে অতি বিপ্লবী চীন এ প্রস্তাবেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পদাঙ্ক অনুসরণ করে প্রস্তাবের সমর্থন করে।
অপর দুই মহাশক্তি ফ্রান্স এবং বৃটেন এ প্রস্তাবেরও ভােটদানে বিরত থাকে।
তার আগে সােভিয়েত ইউনিয়ন নিরাপত্তা পরিষদের অধিবেশনে বাংলাদেশের প্রতিনিধিকে আমন্ত্রণ করার দাবি জানালে চীন তারও বিরােধিতা করে।

ধাপে ধাপে
* ২৫ মার্চ, ১৯৭১; প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার পাক-বাহিনী কর্তৃক বাঙলাদেশের জনগণের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক যুদ্ধ ঘােষণা।
* ১৭ এপ্রিল, ১৯৭১; মুজিব নগরে গণপ্রজাতন্ত্রী বাঙলাদেশের জন্ম; বাঙলাদেশের স্বাধীনতা সনদ ঘােষণা।
* ৯ আগস্ট ১৯৭১; বাঙলাদেশের মুক্তি সংগ্রামের রক্ষাকবচ ভারত-সােভিয়েত মৈত্রী চুক্তি স্বাক্ষরিত।
* ৪ ডিসেম্বর, ১৯৭১; ভারতের বিরুদ্ধে পাক সরকারের সর্বাত্মক যুদ্ধ ঘােষণা।
* ৬ ডিসেম্বর ১৯৭১; ভারত সরকার কর্তৃক গণপ্রজাতান্ত্রিক বাঙলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতি দান।

সূত্র: কালান্তর, ৬.১২.১৯৭১