বিনামূল্যের পরামর্শ
সরকারী প্রজা সমাজতন্ত্রীদলের নেতা ও সংসদ সদস্য শ্রীসমর গুহর সমাজতন্ত্রের প্রতি বিদ্বেষ সুবিদিত। মাঝে মাঝে তিনি জাতির পক্ষে গুরুত্বপূর্ণ এমন সব প্রশ্নে সমাজতান্ত্রিক দেশগুলির সম্পর্কে বিষােদগার করেন যে তখন আর দলের সমাজতন্ত্রের নামাবলিটা গায়ে থাকলেও তার পরিচয়টা লুকানাে থাকে না।
সম্প্রতি বাঙলাদেশ প্রসঙ্গে তিনি আর একবার মুখ খুলেছেন। বাঙলাদেশের মুক্তি সংগ্রামকে ব্যাপকতম গণভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত করার এবং ঐ সংগ্রাম পরিচালনার জন্য ঐক্যবদ্ধ কম্যান্ডের প্রয়ােজনীয়তা রণক্ষেত্রের মুক্তিযােদ্ধারা জীবনের মূল্য অনুভব করেছেন তখন শ্রী গুহ এর মধ্যে সােভিয়েতের রাজনৈতিক চাপ লক্ষ্য করেছেন। সেজন্য বাঙলাদেশে কর্মরত মােজাফফর আমেদ পন্থী ন্যাপ, ভাসানী ন্যাপ, কমিউনিস্ট পার্টি প্রভৃতি রাজনৈতিক দলগুলির এক একজন প্রতিনিধি নিয়ে যে পরামর্শদাতা কমিটি গঠিত হয়েছে শ্রীগুহ তার বিরুদ্ধে সােভিয়েত বিদ্বেষের কামান দেগেছেন।
এরদ্বারা তিনি যে বাঙলাদেশের বিপ্লবী জনতা ও তার নির্বাচিত সরকারের রাজনৈতিক বিচার বুদ্ধিকে খেলাে করেছেন একথা বােঝার মত কাণ্ডজ্ঞান তার না থাক অন্যদের আছে।
সমরবাবুর আক্রমণের মূল লক্ষ্য হলাে ভারত-সােভিয়েত মৈত্রী, শান্তি ও সহযােগিতার চুক্তি। এই চুক্তি
হলে বাঙলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের যে দ্রুত রূপান্তর হতাে না একথা তিনি বােঝেন। শুধু সমর বাবু নন, একথা বােঝে ইয়াহিয়ার দুই দোসর মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ, বােঝে চীন সরকার। তফাত এই ওরা দেশের বাইরে থেকে বলে আর সমরবাবু দেশের মধ্যে সাংবাদিক সম্মেলন করে বলেন।
বাঙলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সমস্যা, তার জাতীয় ফ্রন্ট গঠনের প্রয়ােজনীয়তা, তার গেরিলা যুদ্ধের ট্রেনিং ও পরিচালনা প্রভৃতি বিষয়গুলি সমরবাবুর মত বাঙলাদেশ হিতৈষীরা ওদের হাতেই ছেড়ে দেন তবে ওদেরটা ওরাই বুঝে নিতে পারবেন। তাছাড়া অন্যেরা যখন বিনামূল্যের এই পরামর্শ উপেক্ষা করেই পরামর্শদাতা কমিটি গঠন করেছেন এবং নিজেদের প্রয়ােজনমত কাজ করে যাচ্ছেন তখন প্রসঙ্গটা চেপে যাওয়াই তাে বুদ্ধিমানের কাজ। নয় কি?
ভারত-সােভিয়েত সাংস্কৃতিক চুক্তি
মৈত্রী ও সহযােগিতার ভিত্তিতে ভারত-সােভিয়েত চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ায় তিন সপ্তাহের মধ্যে ভারতসােভিয়েত সাংস্কৃতিক চুক্তি স্বাক্ষরিত হল। এই চুক্তির মূল উদ্দেশ্য উভয় দেশের মধ্যে বৈজ্ঞানিক কারিগরি ও সাংস্কৃতিক বিনিময়। বলা বাহুল্য, এতে অধিক লাভবান হবে ভারতই। বিশেষতঃ সােভিয়েত দেশের উন্নত বিজ্ঞান ও কারিগরি শিক্ষা আমাদের উন্নয়নশীল দেশের ব্যবহারিক জীবনে যথেষ্ট পরিমাণ অগ্রগতির বেগ সঞ্চার করবে। আধুনিক যন্ত্র যুগে সমাজতান্ত্রিক দুনিয়ার নেতা সােভিয়েত আর্থ-নীতিক ও সামাজিক প্রগতির শীর্ষাভিমুখী। ঐ দেশের বিশেষজ্ঞরা আমাদের দেশের বিভিন্ন শিল্পকে তাদের অভিজ্ঞতা ও সহযােগিতা দিয়ে যথেষ্ট পরিমাণে উন্নত করে তুলতে পারবেন।
আমরা নির্দ্বিধায় একথা বার বার ঘােষণা করেছি, জোট নিরপেক্ষ এবং উন্নয়নশীল দেশগুলির প্রগতির প্রশ্ন নিহিত আছে সমাজতান্ত্রিক দেশগুলির সঙ্গে সার্বিক সম্পর্কের ঘনিষ্ঠকরণের মধ্যে। আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক ঘাত-প্রতিঘাতের মাধ্যমে এ কথা আজ সুপ্রমাণিত হয়েছে যে, সদ্য স্বাধীন ও মুক্তিসংগ্রামী দেশগুলির গণতান্ত্রিক অস্তিত্বের সবচেয়ে বড় গ্যারান্টি সমাজতান্ত্রিক দুনিয়া ও তার মহান নেতা সােভিয়েত ইউনিয়ন। বিশেষতঃ বাঙলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষে সমাজতন্ত্র এবং বিপক্ষে সাম্রাজ্যবাদ ও মাওবাদের মিলিত ভূমিকা ভারতবর্ষের বিস্তীর্ণ উপমহাদেশের আপামর জনতার কাছে উপরােক্ত সত্যটিকে নতুন করে প্রমাণিত করেছে।
আমাদের দেশের শাসকেরা দীর্ঘকাল পশ্চিমী ধনতান্ত্রিক শিবিরের বিকৃত সংস্কৃতি এবং মাথাভারী কারিগরি, কৃষি ও বৈজ্ঞানিক শিক্ষাকে জাতীয় জীবনে চালু করার চেষ্টা করেছেন। এর ফলে আমাদের সামাজিক ও অর্থনীতিক জীবনে ধনী দরিদ্রের ব্যবধান আরও ব্যাপক হয়েছে মাত্র। বিজ্ঞান, শিল্প ও সংস্কৃতিকে মানব-মুখীন পরিণতি দিতে হলে সমাজতন্ত্রের পথে পদক্ষেপ ছাড়া অন্য কোনাে বিকল্প নেই। আমরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, সােভিয়েত-ভারত সাংস্কৃতিক চুক্তি আমাদের সমাজ-জীবনে সেই পথেরই নির্দেশ করবে।
তথাকথিত জোটনিরপেক্ষতা
মিঃ কাউল বলেছেন যে বাঙলাদেশে বৃহত্তম মানবিক বিপর্যয় সম্পর্কে জোটনিরপেক্ষ দেশগুলি যদি ইতিবাচক মনােভাব প্রকাশ না করে তাহলে ভারত তাদের সম্মেলনে যােগ দেবে না। কয়েকটি জোট নিরপেক্ষ দেশ ইতিপূর্বে বলেছে যে পাকিস্তানে যা ঘটছে তাহল ঐ দেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার।
বাঙলাদেশ থেকে ভারতে লক্ষ লক্ষ শরণার্থীর আগমন এবং ভারতের উপর এক অস্বাভাবিক চাপ সৃষ্টি করা নিশ্চয় পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার নয়। দেশ ছাড়া ঘর ছাড়া শরণার্থীরা ভারত এবং পাকিস্তানের সম্পর্কে প্রতিভূ হয়ে দাঁড়িয়েছেন। এই শরণার্থীদের জন্য বিভিন্ন দেশ থেকে সাহায্যও এসেছে। আর এটা স্বীকৃত যে বিশ্বের কোন দেশই এ ধরনের বিপুল শরণার্থী সমস্যার সম্মুখীন হয়নি। অতএব এটা পাকিস্তানের আভ্যন্তরীণ ব্যাপার নয়।
উপরন্তু কোন দেশে জাতিহত্যার অনুষ্ঠান হলে জাতিসংঘের বিধি অনুসারে তা একটা দেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার বলে গণ্য হতে পারে না।
সূত্র: কালান্তর, ১৯.৯.১৯৭১