রাষ্ট্রসঙ্ঘে চীন
নির্মল সেন
শেষ পর্যন্ত বিশ বছরের এক অন্যায়ের সংশােধন হলাে। বিশ বছর ধরে বিশ্বের সমস্ত সমাজতন্ত্রী রাষ্ট্র ও গণতন্ত্রে বিশ্বাসী দেশ যে সংগ্রাম করে এসেছে আজ তার বিজয়ের দিন। চীনের লােকায়ত্ত প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রসঙ্ঘে প্রবেশাধিকারের পথে বিশ বছর ধরে বাধা দিয়ে এসেছিল আমেরিকার নেতৃত্বে যে শক্তিরা, তাদের এই পরাজয় অনিবার্যভাবেই গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রের শিবিরের জয়। শুধুমাত্র আমেরিকার গায়ের জোরে চিয়াং কাই-শেক এতদিন রাষ্ট্রসঙ্ঘের চীনের প্রাপ্য আসন জবরদখল করে ছিল। সেই লােলচর্ম বুদ্ধের বিকৃত আকাক্ষা এবার গলাধাক্কা খেয়েছে।
কিন্তু এ শুধু তাইওয়ানের নির্বাসন নয়—নির্বাসন খােদ আমেরিকারও। আমেরিকা এতদিন বিশ্বের যে কোন বৃহৎ সমস্যার সমাধানের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রসঙ্রে স্বাধীনভাবে কাজ করার অধিকার চেপে বসে ছিল। মার্কিন একাধিপত্যের ফলে রাষ্ট্রসংঘ প্রায় প্রাক্-দ্বিতীয়-বিশ্বযুদ্ধ-কালের অকর্মণ্য লীগ অব নেশনস্-এর অবস্থায় যেতে বসেছিল। অবশ্য রাষ্ট্রসঙ্ঘের এই অকর্মণ্যতার কোন কারণ ছিল না। লীগ অব নেশনস-এর নিষ্ক্রিয়তার লক্ষণগুলাে রাষ্ট্রসঙ্ঘের সনদ, তার গঠনতন্ত্র ও অধিকার থেকে সযত্নে পরিহার করা হয়েছিল।
চীনের রাষ্ট্রসঙ্ঘে প্রবেশে বিশ বছর ধরে আমেরিকা যে বাধা সৃষ্টি করে এসেছিল তা কিন্তু চীনকে দুর্বল করেনি করেছে খােদ রাষ্ট্রসংঘকেই। রাষ্ট্রসঙ্ েচীনের প্রবেশে বাধা দিয়ে অন্যদিকে আমেরিকা গােপনে চীনের সঙ্গে যােগাযােগ রক্ষা করে গেছে।
বিশ বছর বাদে হলেও চীনের আজ রাষ্ট্রসঙ্ঘে প্রবেশের ঘটনা নিছক ভােটের জয় নয়—এর অন্যতার, গুরুতর আন্তর্জাতিক তাৎপর্যও রয়েছে। রাষ্ট্রসঙ্ েআমেরিকা এতদিন তার সমস্ত শয়তানি মতলবে যে সব রাষ্ট্রশক্তির সাহায্য চোখ বুজে পেয়ে এসেছিল তারা অনেকেই আমিরিকার ইচ্ছা পূরণ করেনি এবার, কিছু দুর্বল বশংবদ ছাড়া। সাম্রাজ্যবাদের শিবিরে এই ভাঙন আদৌ কিন্তু উপেক্ষার নয় এটা, একেবারেই আকস্মিকও নয়। এ ভাঙন সাম্রাজ্যবাদের অন্তর্দ্বন্দ্বের ফল, পারস্পরিক দ্বন্দ্বের ফল। রাষ্ট্রসঙ্ঘে চীনের আসনপ্রাপ্তি প্রমাণ করে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের একাধিপত্যের দিন শেষ হয়ে এসেছে।
দ্বিতীয়ত, রাষ্ট্রঘংঘে শেষপর্যন্ত চীনের আসন জয়ের বিজয়-আনন্দে এর আরও কতগুলাে গুরুত্বপূর্ণ তাৎপর্যের দিক ভুলে গেলে চলবে না। সাম্রাজ্যবাদের শিবিরে ভাঙন ও শক্তি ক্ষয় যেমন এর অন্যতম তাৎপর্য তেমনি অন্যদিকে এই প্রসঙ্গে গণতান্ত্রিক ও সমাজতান্ত্রিক দেশগুলাের বৈদেশিকনীতি ও কূটনীতিতে আদর্শনিষ্ঠা ও একনিষ্ঠাও এই ঘটনার অন্যতম শিক্ষা।
ভারতের কথাই প্রথম ধরা যাক। ভারতের স্বাধীনতা লাভের পর চীনের সঙ্গে তার সম্পর্ক ছিল বন্ধুত্বের। কিন্তু সে সম্পর্কের মর্যাদা চীন শেষ পর্যন্ত রাখতে পারেনি। ধীরে ধীরে তিক্ততায় রূপান্তরিত সেই সম্পর্ক শেষ পর্যন্ত চীনের জবরদস্তি ভারত আক্রমণে এসে পৌছায়। চীন-ভারত এই সম্পর্কের দিনও কিন্তু যতবার চীনের রাষ্ট্রসঙ্ঘে প্রবেশের প্রশ্ন উঠেছে ততবারই ভারত চীনের পক্ষে দাড়িয়েছে। জাতাভিমান বা ক্রোধ ভারতকে অন্ধ করেনি। ভারত তার শান্তি ও ন্যায় অধিকারের বৈদেশিক নীতিতে অবিচল থেকেছে।
চীনের রাষ্ট্রসঙ্ েপ্রবেশাধিকারের পক্ষে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে যে শক্তি সবচেয়ে কঠিন লড়াই লড়ে এসেছে গত বিশ বছর ধরে সে সােভিয়েত ইউনিয়ন। চীন যখন সােভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে ক্রামাগত আক্রমণাত্মক কুৎসা ও আক্রমণ চালিয়ে এসেছে, চীন নেতারা যেদিন সােভিয়েত ইউনিয়নকে সাম্রাজ্যবাদের দোসর বলে ক্রমাগল চেঁচিয়ে চলেছিল সেদিন অবিচলিত সােভিয়েত ইউনিয়ন এক মুহূর্তের জন্য চীনের প্রতি তার আন্তর্জাতিক দায়িত্বের কথা ভােলেনি। তার সমাজতান্তিক মর্যাদা ও দায়িত্ববােধ থেকেই সে নিরলস রাষ্ট্রসঙ্ঘে চীনের আসনের পক্ষে লড়াই করেছে। তৃতীয়ত, এই প্রসঙ্গে এ কথাটাও স্মরণ করা দরকার, শুধু সােভিয়েত ইউনিয়ন নয় সমগ্র সমাজতান্ত্রিক দেশই সর্বপ্রথম চীনের পক্ষে রাষ্ট্রসঙ্ঘের আসনের জন্য সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম শুরু করেছিল।
ইতিহাসকে অনেক সময়েই আমরা আলঙ্কারিক অর্থে কষ্টিপাথর বলে বর্ণনা করি। সেই কষ্টিপাথরেই যাচাই হয় ঐতিহাসিক সত্য। হাজার বক্তৃতায়, ক্রমাগত বেতার ভাষণে যে মিথ্যাচার সাময়িকভাবে প্রতিষ্ঠা লাভ করে ইতিহাসের কষ্টিপাথরের এক আঁচড়ে সে আবার মিথ্যার পর্যবসিত হয়ে যায়।
যাই হােক রাষ্ট্রসঙ্ঘে চীনের আসন লাভ আজ সমগ্র পৃথিবীর ঘরে ঘরে গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রের শক্তির বিজয়ের উৎসব-দিনরূপে উদ্যাপিত হবে। এই বিজয়ের আনন্দে আরও কিছু কথা আছে যা ভুললে ইতিহাস ক্ষমা করবে না।
রাষ্ট্রসঙ্ েচীনের প্রবেশের অধিকার আজ চীনের নেতৃত্বের কাঁধেও কিছু বৃহত্তর দায়িত্ব অর্পণ করেছে। সােজা কথায় এতদিন চীনের নেতৃত্বে যেভাবে ব্যবহার করে এসেছে বা আসছে সেই ব্যবহার চলবে না। এই সেদিনও আমরা দেখতে পেয়েছি মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ এবং তার তাঁবেদার যুদ্ধবাজদের সঙ্গে চীনের গলাগলির বহর। দেখেছি সমাজতান্ত্রিক শক্তি বিশেষ করে সােভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে চীনের নেতাদের কুৎসা ও বিরােধীতা। চীনের সেই নেতৃবৃন্দকে আজ মনে রাখতে হবে যে রাষ্ট্রসঙ্ঘে তার আসনের জন্য লড়াই সাম্রাজ্যবাদবিরােধী লড়াইয়েরই বিজয়। সুতরাং সাম্রাজ্যবাদ অথবা সাম্রাজ্যবাদী তাঁবেদারদের সঙ্গে মাখামাখি করে সেই বিজয়ের মর্যাদা রক্ষা করা যাবে না। রাষ্ট্রসঙ্ঘে চীনের প্রতিনিধিকে মনে রাখতে হবে একমাত্র সমাজতান্ত্রিক ও গণতান্ত্রিক দেশগুলাের সঙ্গে একজোটে চললেই সেই সাম্রাজ্যবাদবিরােধী লড়াইকে তার চূড়ান্ত বিজয়ের পথে নিয়ে যাওয়া যায়। উগ্রজাতীয়তাবাদ বা অন্ধ সােভিয়েত বিদ্বেষ এক্ষেত্রে আবর পরাজিত সাম্রাজ্যবাদকেই সসম্মানে ফিরিয়ে আনবে। চীনা নেতাদের এ কথা স্মরণে রাখতে হবে যদি তারা এ বিজয়কে চিরস্থায়ী করার ইচ্ছা রাখেন।
সূত্র: সপ্তাহ, ১২ নভেম্বর ১৯৭১