এতদিনে নিদ্রাভঙ্গ!
জাতিসংঘের প্রধান সচিব উথান্ট বলেছেন, পূর্ববঙ্গে যা ঘটেছে তা মানবজাতির ইতিহাসের সর্বাপেক্ষা মর্মান্তিক অধ্যায়গুলির একটি এবং একটা বিষম কলঙ্ক। উথান্টের এই উক্তিতে ঘটনার গুরুত্বই প্রকাশ পেয়েছে। এই ভয়াবহ অবস্থা সৃষ্টির জন্যে যারা দায়ী পাকিস্তানের সেই সব শাসকদের নামােল্লেখ না করলেও উথান্ট কার্যত পাক জঙ্গী-শাহীকেই আসামীর কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছেন। কোনাে প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে এই মর্মান্তিক অধ্যায়’ এর সৃষ্টি হয় নি; হয়েছে পাকিস্তানের জঙ্গী রাষ্ট্রপতি জেনারেল ইয়াহিয়া খানের বাহিনীর বর্বর হত্যাকান্ত্রে ফলে। সেই অমানুষিক অত্যাচারের ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে লক্ষ লক্ষ নর-নারী ভারতের বুকে এসে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছে।
উ থান্ট যাকে চরম মর্মান্তিক ঘটনা বলেছেন, তার সংসার জাতিসংঘ কিন্তু অদ্যাবধি সে সম্বন্ধে উদাসীন। তিনি নিজে শরণার্থীদের সাহায্যের জন্যে আন্তর্জাতিক দরবারে আবেদন জানিয়েও তেমন সাড়া পাননি। জাতিসংঘের ত্রাণসংস্থার পক্ষ থেকে একটি মিশনও এসেছিল ভারতে আগত শরণার্থীদের অবস্থা সম্পর্কে চাক্ষুষ অভিজ্ঞতা অর্জনের উদ্দেশ্যে। সেই মিশনের রিপাের্টের ফলাফলও আজ পর্যন্ত কিছু দেখা যায়নি। অথচ এমন একটা ঘটনা ইউরােপে ঘটলে তা নিয়ে জাতিসংঘে হৈ চৈ পড়ে যেত। এত বড় একটা ট্রাজেডি ঘটে যাচ্ছে পাক-ভারত উপমহাদেশে তা নিয়ে আন্তর্জাতিক মহলে বা জাতীসংঘে কারাে তেমন মাথা নেই। সবাই যেন এই ট্রাজেডির নীরব দর্শক। এটা যে পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার নয়, আন্তর্জাতিক সমস্যা, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র কমিটির এশীয় ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় বিষয়ক উপ-সমিতির চেয়ারম্যান মিঃ করনিলাস ই গ্যালাঘেরও তা বলেছেন। তার মতে, বাংলাদেশ থেকে বাঙালী উৎসাদন যদি বন্ধ না হয় তবে বাঙলাদেশ আরেকটি ভিয়েতনামে পরিণত হবে। তিনি একথাও বলেছেন যে, এই উৎসাদন অবিলম্বে বন্ধ করার উপায় হলে, পাকিস্তানের উপর আন্তর্জাতিক শক্তিসমূহের চাপ দেয়া।
বলা বাহুল্য, এ ব্যাপারে জাতিসংঘেরই সর্বাগ্রে উদ্যোগ নেওয়া উচিত ছিল। ঘটনার গুরুত্ব সদস্য রাষ্ট্রগুলির গােচরীভূত করার জন্যে জাতিসংঘের প্রধান সচিব এযাবত কতখানি তৎপরতা দেখিয়েছেন, বা তাদের গােচরে নিয়েও বিভিন্ন সদস্য রাষ্ট্রের কাছে থেকে তিনি কী মনােভাবের পরিচয় পেয়েছেন আজো পর্যন্ত বিশ্ববাসী সে সম্বন্ধে অন্ধকারে। বাঙলাদেশে রক্তপাত অবিলম্বে বন্ধ করার জন্যে জাতিসংঘের পক্ষ থেকে প্রত্যক্ষ কোনাে উদ্যম এযাবত দেখা যায় নি। সবাই দেখছে একটা দেশে অবাধ নরমেধ যজ্ঞ চলছে আর জাতিসংঘ খুঁটো জগন্নাথ হয়ে বসে আছে। অবস্থার গুরুত্ব সম্পর্কে সদস্য রাষ্ট্রগুলি যে যথােচিত অবহিত নয় প্রধান সচিবের আবেদনে উল্লেখযােগ্য সাড়া না পাওয়াই তার কারণ। সুতরাং উ থান্ট তার পদোচিত দায়িত্ব পালন করেছেন কিনা স্বাভাবিকভাবেই এই প্রশ্ন ওঠে।
বাঙলাদেশের ঘটনা আন্তর্জাতিক প্রশ্ন এই কারণে যে, কোনাে রাষ্ট্রের এক সংখ্যালঘিষ্ঠ অংশ অস্ত্র বলের দ্বারা সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশের গণতান্ত্রিক অধিকারের অপমৃত্যু ঘটাতে পারে কিনা? তা যদি জাতিসংঘের সনদ বিরুদ্ধ কাজ হয় তবে প্রধান সচিবেরই দায়িত্ব সদস্য রাষ্ট্রগুলিকে সে সম্বন্ধে ওয়াকিবহাল করা এবং বলপ্রয়ােগ যাতে অবিলম্বে বন্ধ হয় তার জন্যে আন্তর্জাতিক শক্তিগুলিকে সচেতন করে তােলা। প্রধান সচিব যদি এই কর্তব্য পালন না করেন এবং মুরুব্বি রাষ্ট্রগুলির মুখ চেয়ে বসে থাকেন, তবে ঘটনার গুরুত্ব সম্পর্কে তিনি যত বিবৃতিই দেন না কেন, তাতে কোনাে কাজ হবে না। খালি মৌখিক সহানুভূতি ও উদ্বেগ প্রকাশ করা নিরর্থক। ঘটনার গতিরােধ জাতিসংঘকে সজাগ ও সক্রিয় করতে না পারলে শুধু বেতনভুক করণিকরূপে প্রধান সচিবের পদ অলঙ্কত করে বসে থাকার সার্থকতা কোথায়?
সূত্র: কালান্তর, ৫.৬.১৯৭১