You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.07.15 | অদৃষ্টের পরিহাস | কালান্তর - সংগ্রামের নোটবুক

অদৃষ্টের পরিহাস

বিশ্ব-ব্যাঙ্কের বিশেষ প্রতিনিধিদল বাঙলাদেশের অবস্থা পর্যবেক্ষণের পর তাদের রিপাের্টে পাকিস্তানকে আন্তর্জাতিক সাহায্যদান স্থগিত রাখার সুপারিশ করেছেন। বলা হয়েছে, অন্তত এক বছর সাহায্যদান স্থগিত রাখা উচিত। তাঁদের মতে পূর্ববঙ্গের উন্নয়নের জন্য নির্দিষ্ট সাহায্য দিলেও তা গিয়ে ইয়াহিয়ার কবলেই পড়বে। বাঙলাদেশে সামরিক অভিযান চালাবার দরুন পশ্চিম-পাকিস্তানের অর্থনৈতিক কাঠামাে ধসে পড়েছে। অতএব বাঙলাদেশের জন্য নির্দিষ্ট অর্থ হাতে পেলে তিনি তা পশ্চিম পাকিস্তানেই ঢালবেন।
প্রতিনিধিদলের পক্ষ থেকে বিশ্ব-ব্যাঙ্কের দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া বিভাগের বৃটিশ ডিরেক্টর মিঃ কারগিল যে রিপাের্ট পেশ করেছেন, তা থেকে একথাই স্পষ্ট হয়ে উঠেছে যে, হাজার চেষ্টা করেও পাকিস্তানের কার্যত পুঁজিবাদী দেশগুলিরই কুক্ষিগত প্রতিষ্ঠান। কিন্তু ইয়াহিয়া খান বাঙলাদেশে এমন ধ্বংসলীলাই চালিয়েছেন যা দেখে পুঁজিবাদী দেশের প্রতিনিধিরাও তাঁর প্রতি বিরূপ না হয়ে পারেন নি। যে নয়া উপনিবেশবাদকে এগিয়ে নিয়ে যাবার জন্য বিশ্ব-ব্যাঙ্ক ও অনুরূপ তহবিলগুলি থেকে অকাতরে টাকা ঢালা হয়েছে, অদৃষ্টের এমনই বিড়ম্বনা যে, নয়া উপনিবেশবাদীদের তাঁবেদাররা সেই অর্থ এমনভাবে জলে ফেলেছে যার ফল সেই নয়া উপনিবেশবাদীকেই নতুন করে অর্থ দিতে বেঁকে বসেছে।
বাঙলাদেশে ভয়াবহ অবস্থার বিবরণ দিতে গিয়ে বিশ্ব-ব্যাঙ্কের প্রতিনিধিদলের সদস্য মিঃ হেগুরিক হাইজডেন বলেছেন-ধ্বংস লীলার দৃশ্য ভয়ঙ্কর ; দেখে মনে হচ্ছিল যেন পারমাণবিক আক্রমণের পরবর্তী প্রভাতের দৃশ্য। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে মিত্র শক্তিবর্গের বােমায় বিধ্বস্ত কোন জার্মান শহরের কথাই মনে করিয়ে দিচ্ছিল কুষ্টিয়া। শতকরা নব্বইটি বাড়ি, দোকান, ব্যাঙ্ক ও অন্যান্য গৃহ বিধ্বস্ত। শহরে লােক চল্লিশ হাজার থেকে পাঁচহাজারে এসে দাঁড়িয়েছে। যারা আছে তারা অসহায় দৃষ্টিতে পথে বসে। প্রতিনিধিদের দেখে তারা ভয়ে পালিয়ে যায়। দেড় ঘণ্টা খুঁজেও একটি খাবারের দোকান পাওয়া যায়নি। যশােহর সম্পর্কেও উক্ত প্রতিনিধি একই রূপ বর্ণনা দিয়েছেন। তিনি বলেছেন যে বিমান থেকে বােমা ফেলে সেখানে সব ছাতু ছাতু করা হয়েছে এবং মারা গেছে প্রায় বিশ হাজার লােক।
আর বেশি উদ্ধৃতি দিয়ে লাভ নেই। ইয়াহিয়া খানের চণ্ডনীতি বুঝবার পক্ষে একজন বিদেশী প্রতিনিধির দেওয়া এটুকু বিবরণই যথেষ্ট। এর পরেও যদি আন্তর্জাতিক ধনভাণ্ডার থেকে পাকিস্তানী খুনীদের সাহায্য করার সুপারিশ করা হত তবে বিশ্ব-বিবেক একেবারে রসাতলে গিয়েছে বলা ছাড়া উপায় ছিল না। জঙ্গীশাহীর পক্ষ থেকে বার বার বলা হচ্ছে যে, বাঙলাদেশের অবস্থা স্বাভাবিক হয়ে এসেছে। কিন্তু সেই স্বাভাবিকতার এই চিত্র দেখে শিউরে উঠতে হয়। ইয়াহিয়া খান যে কেবল বাঙলাদেশকেই ধ্বংস করেছেন এমন নয়, পশ্চিম পাকিস্তানের অর্থনীতিকেও অগাধ সলিলে ডুবিয়েছেন। পূর্ববঙ্গ শশাষণ করে পশ্চিম পাকিস্তানে ঐশ্বর্যের সৌধ নির্মাণের স্বপ্ন তার বিলীয়মান। বিশ্ব ধন-ভাণ্ডার আজ তাঁর প্রতি বিমুখ।
বিশ্ব-বিবেক বিরুদ্ধে গেলেও তাঁর এই দস্যুতার সহায়ক শক্তি না আছে এমন নয়। বুর্জোয়া দেশগুলিকে জনমত অগ্রাহ্য করে যে যুদ্ধবাজ কুচক্রীর দল প্রশাসন যন্ত্র চালায় তাদের বিবেক তাে দূরের কথা, চক্ষুলজ্জারও বালাই নেই। সেই গােষ্ঠীর শিরােমণি মার্কিন শাসকবৃন্দ। ভিয়েতনামে বর্বরতা বন্ধ করার জন্য বিশ্বের গণতান্ত্রিক জনমত সােচ্চার, এমন কি খাস মার্কিন মুলুকেও নিক্সনের ভিয়েতনাম নীতির বিরুদ্ধে তীব্র ধিক্কার; কিন্তু মার্কিন শাসকগােষ্ঠীর তাতে ভ্রুক্ষেপও নেই। ভিয়েতনামে সেই বর্বরতা অবাধেই চলেছে। ইয়াহিয়া এরই মধ্যে এই কুচক্রীদের নতুন অস্ত্রবল লাভ করেছেন। নৃশংসতার ইনাম তিনি নিশ্চয়ই আরাে পাবেন। নানান পক্ষে অর্থ ও অস্ত্র তার হাতে আসবে। সি-আই-এর বিরাট তহবিল আছে। খুন চালিয়ে যাবার জন্য সেই তহবিল থেকে অর্থদানে কার্পণ্য হবে না। দেখা যাবে বিশ্ব-ব্যাঙ্কের প্রতিনিধিদের এই সুপারিশ কার্যতঃ নেমন্তন্ন বাড়ির এটো পাতায় পরিণত হয়েছে।
এই ষড়যন্ত্রকারীরা বিশ্ব-বিবেকের স্তব্ধ ও নিষ্ক্রিয় করে রাখে অস্ত্র ও অর্থবলে। অর্জুন বৃহন্নলায় পরিণত হয়। সুতরাং যারা মনে করেন বিশ্ব-বিবেক জাগ্রত হলেই অনায়াসে বাঙলাদেশের সুরাহা হয়ে যাবে তারা একচক্ষু হরিণের মত শুধু একটা দিকই দেখছেন। একমাত্র বিশ্ব-জনমতের চাপেই যদি নয়া উপনিবেশবাদী ও তাদের পদলেহীরা হননে নিরস্ত হত তবে ভিয়েতনামে মুক্তিযােদ্ধাদের অস্ত্র নিয়ে এত দীর্ঘকাল লড়তে হত না এবং এত রক্তের বন্যাও সেখানে বইত না। বাঙলাদেশের অনুকূলে বিশ্ব-জনমত গড়ে ওঠার প্রয়ােজন নিশ্চয়ই আছে; কিন্তু আন্তর্জাতিক যুদ্ধবাজদের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে অস্ত্র হাতে ইয়াহিয়ার জঙ্গীচক্রকে শেষ আঘাত হেনেই আনতে হবে বাঙলাদেশের স্বাধীনতা। এর মাঝখানে কোন রফার অর্থ হবে দাসত্ব ভাগ করে নেওয়া।

সূত্র: কালান্তর, ১৫.৭.১৯৭১