পাকিস্তানের সর্বাত্মক ৭টি অগ্রবর্তী বিমান ঘাঁটি
(বিশেষ প্রতিনিধি)
নয়াদিল্লী, ৩ ডিসেম্বর পাকিস্তান ভারতের ওপরে নগ্ন আক্রমণ শুরু করল। আজ পাকিস্তানী বিমান পশ্চিম সীমান্তের কাশ্মীরের শ্রীনগর ও অবন্তীপুরে পাঞ্জাবের পাঠানকোট, অমৃতসর, আম্বালা ও ফরিদকোটে রাজস্থানের উত্তর লাই এবং উত্তর প্রদেশের আগ্রা বিমান বন্দরগুলির উপরে বােমাবর্ষণ করেছে।
পূর্ব সীমান্তের আগরতলা বিমানবন্দরেও পাক বিমান হানা দিয়ে রকেট বর্ষণ করেছে।
পাকিস্তানী বিমান হামলাকে ‘যুদ্ধ’ বলে অভিহিত করে ভারতের বিমানবাহিনীর প্রধান এয়ার মার্শাল ইঞ্জিনীয়ার ভারতীয় বিমানবাহিনীকে নির্দেশ দিয়েছেন পাকিস্তানী সমরযন্ত্রকে ধ্বংস করাে।
পাকিস্তানী অতিক্রমণের ফলে উদ্ধত গুরুতর পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে আগামীকাল পার্লামেন্টের উভয় সভার বিশেষ অধিবেশন ডাকা হয়েছে সকাল ১১ টায়।
পশ্চিম সীমান্তের প্রায় সবকটি গুরুত্বপূর্ণ বিমান বন্দরে পাক বিমান বােমাবর্ষণ করার সঙ্গে সঙ্গে নটি ভারতীয় সীমান্ত ফাঁড়ির উপরেও পাকিস্তানীরা প্রচণ্ড গােলাবর্ষণ শুরু করেছে। এই ফাঁড়িগুলি পাঞ্জাবের অমৃতসর-ফিরােজপুর অঞ্চল ও কাশ্মীরের ছম্ব-জুরিয়ান অঞ্চলে অবস্থিত।
পাকিস্তানী বিমান হামলার খবর সঙ্গে সঙ্গে কলকাতায় প্রধানমন্ত্রীকে জানানাে হয়েছে। তিনি আজ রাতেই দিল্লী ফিরেছেন। পাটনা থেকে দেশরক্ষামন্ত্রী শ্রীজগজীবনরাম ও বােম্বাই থেকে অর্থমন্ত্রী শ্রীচ্যবনও বিশেষ বিমানে রাজধানী ফিরে আসছেন। আজ রাতে তাদের মধ্যে এক উচ্চ পর্যায়ের বৈঠক হবে। ইউ এন আই জানাচ্ছে : সন্ধ্যা ৫-৪০ থেকে ৬-৮-এর মধ্যে ১৮টি পাকিস্তানী বিমান ভারতের শ্রীনগর, অবন্তীপুর, পাঠানকোট ও অমৃতসর বিমান বন্দরের উপরে আক্রমণ চালায়।
রাজস্থানের বারমার জেলার উত্তর লাই বিমান অবতরণ ক্ষেত্রে রাত ৮টায় পাকিস্তানীরা তিনটি বােমা বর্ষণ করে। ভারতের বিমান বিধ্বংসী কামান গর্জে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে পাকিস্তানী বিমান পালিয়ে যায়। বােমাবর্ষণে এই বিমান অবতরণ ক্ষেত্রের কোনও ক্ষতি হয় নি।
শ্রীনগরে ও অবন্তীপুরে ৬টি পাক-স্যাবারজেট আক্রমণ চালায়, তাছাড়া শ্রীনগর থেকে ২২ কিলােমিটার দূরে ভারতীয় সামরিক বাহিনীর উপরেও তারা আক্রমণ করে। এই বিমানগুলি পেশােয়ার ঘাঁটি থেকে এসেছিল বলে অনুমান করা হচ্ছে। কোনও প্রাণহানির সংবাদ পাওয়া যায়নি। পাকিস্তানী আক্রমণের পরেই সামরিক কর্তৃপক্ষ শ্রীনগর বিমানঘাঁটিতে যাতায়াত বন্ধ করে দেন। এখানে ৪টি বােমা পড়েছে বলে জানা গেল। | শ্রীনগর থেকে ১২ কিঃ মিঃ দূরবর্তী পামপাের-এ একটি কামানের গােলা পড়ে।
পাকিস্তানের চারটি মিরেজ বিমান অমৃ তসর বিমান বন্দরের রাডার স্টেশনের উপরে আক্রমণ চালায়। বিমান অবতরণ ক্ষেত্রের ৩০০-৪০০ গজ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তবে বিমান বন্দরটি চালু আছে। রাডারের কোনও ক্ষতি হয় নি। | ফরিদকোটে পাকিস্তানী বােমার একটি হাল্কা বিমান ও একটি তিন-টনের গাড়ির ক্ষতি হয়। জনৈক সরকারী মুখপাত্র আরাে জানিয়েছেন, শতদ্রু নদীর সুলেমানকী ও ফিরােজপুরের মধ্যবর্তী বিভিন্ন জায়গায় পাক গােলাবর্ষণ চলছে। অমৃতসরে হানাদার বিমানগুলির মধ্যে একটিকে উচ্চতা হারাতে দেখা যায়। তিনি বলেন, আমরা এই সব জায়গায়ই পাল্টা গােলা বর্ষণ করেছি।”
পাকিস্তানী সেনাবাহিনী অমৃতসরের কাছের ওন, খুর্দ ও পুল কাঞ্জরীতে এবং খেমকরণের কাছে কালসিয়ান ও নারলিতে গােলাবর্ষণ করে। খেমকরণের প্রাচীর ও তার দক্ষিণের মেহদীপুরে পাকিস্তানীরা সাড়ে ৬টায় গােলাবর্ষণ করতে শুরু করে।
পশ্চিম সীমান্তের বিমান বন্দরগুলিতে পাক হামলার সঙ্গে সঙ্গে নয়াদিল্লীতেও তিনবার বিমান হামলার সংকেতধ্বনি বেজে ওঠে এবং কয়েক মিনিটের মধ্যেই ভারতীয় বিমান বাহিনীর বিমানগুলি শত্রু বিমানের খোঁজে আকাশে উঠে পড়ে। আজ সারা রাত এখানে নিপ্রদীপ পালিত হচ্ছে।
পাঞ্জাবের রাজধানী চণ্ডীগড়েও সন্ধ্যা ৬.৫ মিনিটে বিমান আক্রমণের সংকেতগুলি বেজে ওঠে ও সঙ্গে সঙ্গে নিপ্রদীপ হয়ে যায়। প্রতিরক্ষা দপ্তরের জনৈক মুখপাত্র পাকিস্তানী বিমান হামলাকে ‘নগ্ন আক্রমণ বলে অভিহিত করে বলেন, মনে হয় পাক প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান দশ দিনের মধ্যে ভারত আক্রমণ করার প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেছেন।
পূর্বাঞ্চলেও হামলা
আজ সারাদিনে তিনবার ত্রিপুরার আগরতলায় বিমান হানার বিপদ সঙ্কেত বেজে ওঠে।
আজ বিকাল সওয়া ৪টায় ৪টি পাকিস্তানী স্যাবার জেট আগরতলার দিকে যখন এগিয়ে আসছিল, তখন ভারতীয় নিরাপত্তা বাহিনী সীমান্তে সফলভাবে তাদের প্রতিহত করে। ৪টির মধ্যে তিনটি বিমান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে জানা গেছে। এর আগে বিকাল তিনটায় ৪টি পাক স্যাবার জেট আগরতলা বিমান বন্দরের উপরে রকেট বর্ষণ করে। | ভারতীয় সামরিক বাহিনীর ইস্টার্ন কম্যাণ্ডের জনৈক মুখপাত্র জানান, গত ১ ও ২ ডিসেম্বর যে সব পাকিস্তানী কামান আগরতলা শহরে গােলাবর্ষণ করছিল, ভারতীয় সেনাবাহিনী তাদের স্তব্ধ করে দিয়েছে। ভারতীয় বাহিনী প্রতিরক্ষামূলক ব্যবস্থা অবলম্বন করলে অগ্রবর্তী ঘাঁটি থেকে পলায়মান পাকিস্তানী ফৌজ একটি ১০৫ মিডিয়াম মেশিনগান ফেলে যায়।
গত কয়েকদিনে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর বেপরােয়া গােলাবর্ষণে বালুরঘাট মহকুমার কাদিমপুর এলাকায় কমপক্ষে ৪০ জন অসামরিক ব্যক্তি আহত হয়েছে। এই এলাকা থেকে অধিবাসীদের অপসারণ করা হচ্ছে এবং বালুরঘাট শহরের পৌরাঞ্চলে কাফু জারি করা হয়েছে। এখানকার জেলা কালেক্টরেট, ডাক ও তার ইউনিট, স্টেট ব্যাঙ্ক অব ইণ্ডিয়া ও অন্যান্য প্রয়ােজনীয় দপ্তর বিস্ফোরণমুখী পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।
প্রতিরক্ষা মন্ত্রিদপ্তরের জনৈক মুখপাত্র জানান, আগরতলা সেক্টরে যে প্রতিরক্ষামূলক ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল, তদনুযায়ী ব্যবস্থা অবলম্বন এখনাে চলছে। তিনি জানান, ভারতীয় সেনাবাহিনী আগরতলা সংলগ্ন বাঙলাদেশ এলাকায় প্রবেশ করতে বাধ্য হয়েছে। আগরতলার পশ্চিমে আখাউড়া এলাকায় যুদ্ধ চলছে।
তিনি জানান, পাকিস্তানী বাহিনীর ১২ জন সৈন্য ও আধা সামরিক বাহিনীর ১০ জন আখাউড়া এলাকায় ভারতীয় বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করেছে।
ভারতের বিভিন্ন বিমান বন্দরে পাক
হামলা তথ্যভিজ্ঞ মহলের খবরে প্রকাশ অবন্তীপুর বিমান ঘাঁটির রানওয়ে গতকালের বিমান হামলায় বেশ ভালরকম ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সর্ব মােট ১৭টি বােমা ঐ বিমান বন্দরে পড়ে। এর মধ্যে ৭টি বােমা আজ সকাল পর্যন্ত বিস্ফোরিত হয় নি।
শ্রীনগর থেকে ইউ, এন, আই জানিয়েছে এখান থেকে ২৫ কিলােমিটার দূরে ফাতে-হাল গ্রামের ওপর পাক বিমান বােমা বর্ষণ করে। একজন নিহত ও আর একজন আহত হওয়ার সংবাদ জানা গেছে।
মুখপাত্রটি জানান সম্ভবত শ্রীনগর বিমান বন্দরের দিকে বিমানটি আসছিল। আজ শ্রীনগরে ৪ বার বিমান আক্রমণ সঙ্কেতধ্বনি দেওয়া হয়।
আই, এ, এফের বিমানগুলি তাড়া করলে বিমানগুলি পালিয়ে যায়।
আগ্রায় বিমান হানা
উত্তর প্রদেশের মুখ্য সচিবের সংবাদ অনুযায়ী জানা যায় আজ সাপ্রা বিমান বন্দরের উপর পাক বিমানগুলি আক্রমণ করে। প্রথম আক্রমণ হয় সকাল ৮টা ৩০ মিঃ এবং সর্বশেষ আজ রাত্রির পর। গতকাল সন্ধ্যায় ফরিদকোট বিমানবন্দরে পাক বিমানের হামলায় একটি হাল্কা বিমান ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
সূত্র: কালান্তর, ৪.১২.১৯৭১