You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.12.16 | সপ্তম নৌবহর সম্পর্কে ভারত সরকার নীরব কেন | কালান্তর - সংগ্রামের নোটবুক

সপ্তম নৌবহর সম্পর্কে ভারত সরকার নীরব কেন

বঙ্গোপসাগরে মার্কিন সপ্তম নৌবহরের প্রবেশে ভারতবাসীর ধিক্কার, প্রতিবাদ এবং প্রতিশােধের গর্জন তীব্র হয়ে উঠেছে। প্রতিবাদীদের মধ্যে রয়েছে ভারতের প্রত্যেকটি দল। কংগ্রেস সদস্যরাও এই ধিক্কার জানাতে কারাের পেছনে নন। অথচ নয়াদিল্লীর কর্তৃপক্ষ সমগ্র জাতির এই ধিক্কার ধ্বনিকে পার্লামেন্টে ব্যক্ত করতে দ্বিধা করছেন। লােকসভা ও রাজ্যসভা উভয় কক্ষেই সদস্যরা বারবার দাবি জানিয়েও মন্ত্রীদের মুখ খােলাতে পারছেন না। ভারত সরকারের এই দ্বিধা আমাদের জাতীয় আকাংখার সঙ্গে বেমানান। সমগ্র জাতি যখন সাম্রাজ্যবাদ বিরােধী দেশরক্ষার যুদ্ধে সরকারের সঙ্গে সহযােগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে, তখন সরকার পক্ষেরও কর্তব্য হল দ্বিধাহীন নির্ভয়ে জাতির ভাষাকে ব্যক্ত করা। জাতীয় ঐক্যে কোনরূপ চিড় না ধরে সেদিকে লক্ষ্য রাখা সকলেরই পবিত্র কর্তব্য।
মার্কিন সপ্তম নৌবহর বাঙলাদেশ ও ভারতবর্ষে প্রত্যক্ষভাবে হস্তক্ষেপ না করলেই আমরা মহাখুশি বলে এমনটি ভাব অনেকে ফুটিয়ে তােলার চেষ্টা করছেন। সপ্তম নৌবহর সম্পর্কে ভারত সরকারের তৃষ্ণীম্ভাব সেই নির্বাক কূটনীতিরই অঙ্গ। গরম কথা বললে পাছে নিক্সন আরও রুষ্ট্র হন এই ভেবেই ভারত সরকার এই প্রসঙ্গে বােবা হয়ে থাকা সমীচীন বােধ করছেন। কিন্তু নয়াদিল্লী সরকারের ঐরূপ চিন্তাধারা যেমন ক্ষতিকর, তেমনই ভ্রান্ত।
সপ্তম নৌবহর মার্কিনীদের বােম্বেটে রাজনীতির হাতিয়ার। ভয় দেখিয়ে ও ব্লাকমেল করে কার্যোদ্ধার করাই সপ্তম নৌবহরের লক্ষ্য। সপ্তম নৌবহর প্রত্যক্ষভাবে হস্তক্ষেপ করবে কিংবা করবে না, এ নিয়ে যখন গবেষণার অন্ত নেই, তখন ঐ নৌবহর যে বাঙলাদেশ ও ভারতকে প্রত্যক্ষভাবে ভয় দেখাবার জন্যই বঙ্গোপসাগরে ঢুকেছে তা নিয়ে মত বিরােধের কোন অবকাশ নেই। আর সেই মার্কিন নৌবহরের দরুনই বাঙলাদেশ ও ভারতবর্ষে যে প্রত্যক্ষ দুর্ভোগগুলিতে আমরা ভুগছি তার তালিকা রীতিমত দীর্ঘ। বাঙলাদেশে ইয়াহিয়ার বিমান বাহিনী বলে কিছু আর নেই। মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনীর আঘাতে পাকিস্তানী জঙ্গীশাহীর বিমান শক্তি ছাতু হয়ে গেছে। অথচ পশ্চিম-বাঙলার শহর শিল্পাঞ্চল এবং বন্দর নিপ্রদীপের যে কোন শেষ নেই, তার একটি প্রধান কারণ হল শত শত বােমারু বিমান নিয়ে মার্কিন সপ্তম নৌবহরের বঙ্গোপসাগরে উপস্থিতি। ইয়াহিয়ার যুদ্ধসঙ্গীরা কবে তেতে উঠবে, তার প্রতিরােধী সতর্কতার জন্যই পশ্চিমবাংলার মানুষের দীর্ঘ কয়েকটি শ্রমঘণ্টা বিঘ্নিত হচ্ছে এবং দেশরক্ষার যুদ্ধের স্বার্থেই পশ্চাদ্ভাগে যে কর্মচাঞ্চল্য এত বেশি দরকারি, তা নানাভাবে ক্ষত্রিস্ত হচ্ছে।
তাছাড়া মার্কিন সপ্তম নৌবহর বাঙলাদেশে পাকিস্তানী ফৌজের মধ্যে, সম্পূর্ণ অকারণ ও নিরর্থক হলেও, সামরিক উল্লাসের সৃষ্টি করেছে। নতুবা পূর্ববাঙলার গভর্ণর ডঃ মালিকের সামরিক উপদেষ্টা মিঃ ফরমান আলির আত্মসমর্পণের পর এবং ডঃ মালিকের তথাকথিত সরকারেরও আত্মবিলুপ্তির পর বিনা রক্তক্ষয়ে ঢাকা মুক্ত হবার যে উজ্জ্বল সম্ভাবনা দেখা দিয়েছিল, তা একটা অগ্রসর হতে পারত। মার্কিন সপ্তম নৌবহর পাকিস্তানী ফৌজকে এই মিথ্যা আশ্বাস দিয়েছে যে, তাদের অবস্থা বুঝি তেমন বিপজ্জনক নয়। ভারতের প্রধান সেনাধ্যক্ষ মানেকশ বারবার পাকিস্তানী হানাদারদের যে হুঁশিয়ারি জানাচ্ছেন, নিরর্থক রক্তক্ষয় না করে আত্মসমর্পণের জন্য যে নির্দেশ তাদের দিচ্ছেন, তা অমান্য করার নির্বোধ সাহস পাকিস্তানী ফৌজেরা মার্কিন সপ্তম নৌবহরের নিকট থেকেই পাচ্ছে। কি তার ফল? তার কি পরিণতি হতে পারে? বেতনভুক পাকিস্তানী ফৌজেরা পােকা-মাকড়ে মতাে মরবে এবং সম্পূর্ণ অকারণ একটি সংঘের্ষে ভারতের জওয়ান ও বাঙলাদেশের মুক্তিবাহিনীর যুবক ও কিশোেররাও বেশ কিছু প্রাণ হারাবে। মার্কিন সপ্তম নৌবহরের বােম্বেটে রাজনীতির উদ্দেশ্যও হল তাই। পিছন থেকে উস্কিয়ে এশিয়ার মানুষকে এশিয়ার মানুষ দিয়ে খুন করা মার্কিনীদের যুদ্ধের প্রধান কৌশল, সেকথা পেন্টাগন কখনাে গােপন করেনি। মার্কিন সপ্তম নৌবহর বঙ্গোপসাগরে হাজির হয়ে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের সেই ঘৃণ্য চক্রান্তকেই প্রত্যক্ষভাবে হাসিল করছে।
এটাই মার্কিন সপ্তম নৌবহরের প্রত্যক্ষ আক্রমণ। আরও বেশি অগ্রসর হয়ে মার্কিন সপ্তম নৌবহরের নিক্ষিপ্ত বােমা কলকাতার মানুষকে না পােড়ালে যাহােক মন্দের ভাল বলে প্রচার সম্পূর্ণ উদ্ভট। মার্কিণ সপ্তম নৌবহর আরও বেশি প্রত্যক্ষ আক্রমণের যদি নামে, তবে ভারতে তার কবর রচনা হবে। আড়াই কোটি মানুষের দেশ ভিয়েতনামে মার্কিন নৌবহর প্রত্যক্ষ আক্রমণে নেমে তবু পিছু হঠতে পেরেছে, কিন্তু ৫৫ কোটি মানুষের দেশ ভারতবর্ষ এবং সাড়ে সাত কোটি মানুষের বাঙলাদেশে মার্কিন নৌবহর যুদ্ধে নামলে পালাবার সুযােগও পাবে না। নিক্সনও সেই বাস্তববােধ হয়তাে এখনাে হারাননি। কিন্তু মার্কিন সপ্তম নৌবহর ইতােমধ্যেই ভারত এবং বাঙলাদেশের ক্ষয়ক্ষতিকে যেভাবে বৃদ্ধি করেছে, তার পরিপ্রেক্ষিতেই ভারত সরকারকে ভারতের জনসাধারণের সঙ্গে গলা মিলিয়ে ধিক্কার, প্রতিবাদ এবং প্রতিশােধে এগিয়ে আসতে হবে।

সূত্র: কালান্তর, ১৬.১২.১৯৭১