সংগ্রাম ইপ্সিত লক্ষ্যে পৌছবেই জয় অবশ্যাম্ভাবী
বাঙলাদেশের উপর চিত্র প্রদর্শনী উদ্বোধনকালে ওপারের ছাত্র নেতা
(স্টাফ রিপাের্টার)
কলকাতা, ২৯ এপ্রিল-“পাকিস্তানের ক্ষমতাসীন সরকার ১৯৪৭ সালে রাষ্ট্রপ্রতিষ্ঠার পর থেকে সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থা বজায় রেখে বিদেশী সাম্রাজ্যবাদের সহায়তায় একচেটিয়া পুঁজির নির্মম শশাষণ চালিয়েছে। ২১টি একচেটিয়া পুঁজিবাদী পরিবার আজ দেশের সমগ্র ধনসম্পদ কুক্ষিগত করেছে। পাক শাসকগােষ্ঠি জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকারই খর্ব করেননি, প্রত্যেকটি জাতির ভাষা সাহিত্য সংস্কৃতি পদদলিত করেছে। এই পটভূমিতেই আমরা সকল দেশে গণতন্ত্র, জাতীয় অধিকার এবং অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে স্বাধীনতা ঘােষণা করেছি। আর সেজন্য শাসকগােষ্ঠী সামরিক চক্রের মাধ্যমে বাঙলাদেশে সংঘটিত করেছে এমন নির্বিচার হত্যাযজ্ঞ যা পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল।
সকল নৃশংসতা সত্ত্বেও একথা আমরা সুস্পষ্টভাবে ঘােষণা করতে চাই, সংগ্রাম ইপ্সিত লক্ষ্যে পৌছবেই-জয় আমাদের অবশ্যাম্ভাবী।”
আজ সন্ধ্যায় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গনে “বাঙলাদেশের হৃদয় হতে” শীর্ষক বাঙলাদেশের মুক্তি সংগ্রামের উপর আলােকচিত্র ও রেখাচিত্র প্রদর্শনীর সুবৃহৎ উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বাঙলা দেশ ছাত্র ইউনিয়নের (পূর্বতন ‘এফসুর) সভাপতি নুরুল ইসলাম উপরােক্ত বক্তব্য রাখেন। অনুষ্ঠানে ইসলামই সভাপতিত্ব করেন।
শ্রীইসলাম অকম্পিত কণ্ঠে বলেন, “আমাদের দেশের একমাত্র প্রতিনিধিমূলক ও আইনানুগ সরকার সম্প্রতি স্থাপিত হয়েছে গত নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে। এই সরকারকে পূর্ণ স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য আমরা বিশ্বের সকল প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক মানুষ ও ভারতীয় যুবছাত্র সমাজকে সচেষ্ট হওয়ার আহ্বান জানাচ্ছি।”
ভারতের জনগণ ও যুবছাত্র সমাজ বাংলাদেশের সংগ্রামের প্রতি যে আন্তরিকতা ও সহানুভূতি প্রকাশ করেছেন তার জন্য তিনি জ্ঞাপন করেছেন সংগ্রামী অভিনন্দন।
প্রদর্শনীর উদ্বোধন করেন ছাত্রলীগ নেতা এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদের সহকারী সম্পাদক সাজাহান কবীর। এক অনবদ্য আবেগপ্রবণ ভাষণে তিনি বলেন, “আজ ওপারের মানুষ অনাহারক্লিষ্ট। অভুক্ত অবস্থায় আমার মা তার লজ্জা নিবারণ করতে পারছে না। তবু আমরা চাই কবিগুরুকে যাতে আর কোনদিন অবমাননা না করা যায় তার জন্য বাঙালী জাতি হিসেবে তার ভাষা-সাহিত্য-সংস্কৃতি নিয়ে বেঁচে থাকুক। পৃথিবীর সমগ্র ছাত্র সমাজের কাছে আমাদের অনুরােধ : ন্যায় প্রতিষ্ঠার জন্য আমাদের সংগ্রামকে সমর্থন করুন।”
বাঙলাদেশের মুক্তি সংগ্রামে ভারতের ভূমিকার ভুয়সী প্রশংসা করে তিনি বলেন, “অনেকে আমায় প্রশ্ন করেছেন, আকাশবাণী থেকে যা প্রচারিত হয় তা কি অতিরঞ্জিত” আমি তাদের জানিয়েছি, না। তা কেবল নৃশংসতার শতকরা দশ ভাগ প্রকাশ করতে পারছে।”
পাকিস্তানের জন্মের পর থেকে সংগঠিত বিভিন্ন আন্দোলনের ইতিবৃত্ত দিয়ে শ্রীকবীর জানান ১৯৪৭ সালে ভারত দ্বিখণ্ডিত হওয়ার সময় আমরা ভুল করেছিলাম। ভাষা সংস্কৃতি উধ্ব রেখে কেবলমাত্র সম্প্রদায়ের ভিত্তিতে স্বাধীন হওয়া যায় না।”
প্রদর্শনীকে শুভেচ্ছা জানিয়ে বাঙলাদেশ কূটনৈতিক মিশনের প্রধান জনাব হােসেন আলীর এক ভাষণ টেপ শােনানাে হয়। তাতে জনাব আলী ভারতের কেন্দ্রীয় ও রাজ্য-সরকারগুলির নৈতিক সমর্থনের সপ্রশংস উল্লেখ করে দশলক্ষ শরণার্থীর সাহায্যে ভারত যা কিছু করছে তার জন্য আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জানান। “রাষ্ট্র হিসেবে গণ্য হওয়ার জন্য যে সকল শর্ত পালন করা আবশ্যক সে সব শর্ত বাঙলাদেশ পালন করেছে। বাঙলাদেশ এই অঞ্চলে স্থিতি ও শান্তির বিশিষ্ট উপাদান হয়ে উঠবে।”
কবি সুভাষ মুখােপাধ্যায় সাম্প্রতিক ভিয়েতনাম ভ্রমণের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে তা থেকে বাঙলাদেশের সংগ্রামের শিক্ষণীয় দিকগুলি তুলেধরেন।
ওপারে খ্যাতনামা তরুণ কবি সিকান্দর আবু জাফর একটি নতুন কবিতা “মৃত মা’কে” আবৃত্তি করেন।
পাঁচদিনব্যাপী এই প্রদর্শনীর উদ্যোক্তা বাঙলাদেশ সংগ্রাম সহায়ক কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র কমিটি’-র অন্যতম আহ্বায়ক চিত্র বন্দ্যোপাধ্যায় জানান, কমিটি গঠিত হয়েছে ছাত্র-ফেডারেশন ও ছাত্র পরিষদের যৌথ উদ্যোগে। “ওপারের মত এপারেও আমরা ঐক্যকে মূলমন্ত্র করে এগােতে চাই।”
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র ফেডারেশনের অনুপ মুখােপাধ্যায় প্রদর্শনীর বক্তব্য বিশ্লেষণ করেন।
এছাড়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আবদুর মান্নান এবং রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের মজিদুল রহমান ইয়াহিয়ার বর্বরতার নিদর্শন তুলে ধরেন।
সূত্র: কালান্তর, ৩০.৪.১৯৭১